দাসী কাকন মালার ষড়যন্ত্রে দাসী হিসেবে কাঞ্চনমালার দিন গুলো কাটছিল খুব দু:খে কষ্টে। তিনি আঁস্তাকুড়ে বসে মাছ কোটেন আর কাঁদেন, কাদেঁন আর মাছ কোটেন। কাদতে কাদতে বলেন-
"হাতের কাঁকণ দিয়া কিনলাম দাসী,
সেই হল রাণী, আমি হলাম বাঁদী।
কি বা পাপে সোনার রাজার রাজ্য গেল ছার
কি বা পাপে ভাঙ্গলো কপাল কাঞ্চনমালার?"
রাণী কাঁদেন আর চোখের জলে ভাসেন।
রাজার মনেও কষ্টের সীমা নাই। গায়ের উপরে মাছি ভনভন্ করে, সুঁচের জ্বালায় গা-মুখ চিন্চিন্ন করে। কিন্তু রানীবেশি কাকনমালা বাতাসও করেনা, ওষুধও দেয়না!
একদিন ময়লা কাপড় চোপড় ধূতে কাঞ্চনমালা নদীর ঘাটে গেছেন। যেয়ে দেখেন, একজন মানুষ একরাশ সুতো নিয়ে গাছতলায় বসে বসে বলছে,-
"যদি পাই এক হাজার সুঁচ,
তবে খাই তরমুজ!
ক্সদি সুঁচ পেতাম পাঁচ হাজার,
তবে যেতাম হাট-বাজার!
যদি পাই লাখ-
তবে দেই রাজ্যপাট!!"
এই কথা শুনে রাণী আস্তে আস্তে তার কাছে গিয়ে বললেন, "কে বাছা তুমি সুঁচ চাও? আমি দিতে কিন্তো তমাকে লাখ লাখ সুচ দিতে পারি! তবে সেগুলো তোমাকে তুলে নিতে হবে, তা সুঁচ কি তুমি তুলতে পারবে?"
সব শুনে, সেই বিচিত্র মানুষটা চুপ-চাপ সুতার পুঁটলি তুলিয়া রাণীর সঙ্গে চললো।
পথে যেতে যেতে কাঞ্চনমালা মানুষটির কাছে নিজের দুঃখের কথা সব খুলে বললেন। শুনে, মানুষ বললো,-"আচ্ছা!"
রাজপুরীতে যেয়ে সেই মানুষটা রাণীকে বললো,-"রাণীমা, রাণীমা, আজ পিঠা-পুলির ব্রত। এই ব্রতে সারা রাজ্যে পিঠা বিলাতে হয়। আমি লাল সুতা, নীল সুতা দিয়ে বাড়িঘর সাজিয়ে দেই, আর আপনি গিয়ে' আঙ্গিনায় আল্পনা একে পিড়ি সাজিয়ে দেন। আর কাঞ্চনমালাকে দেখিয়ে বললেন ঐ দাসী মানুষ যোগাড়-যোগড় দিক?"
রাণী আহলাদে আটখানা হয়ে বললেন,-"শুধু আমি কেন সকল দাসীই আজ পিঠা তৈরি করবে।"
তখন রাণী আর দাসী দুইজনেই পিঠা তৈরি করতে বসলেন।
তাদের তৈরি করা পিঠা দেখে সকলের তো চক্ষুচড়ক গাছ!!
ও মা! রাণী তৈরি করলেন, আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা!
আর দাসী বানিয়েছেন চন্দ্রপুরী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা!!
এই দেখেইতো মানুষ বুঝে ফেললো যে, কে রাণী আর কে দাসী।
যাই হোক পিঠে-সিটে তৈরি করার পরে দুইজনে আঙ্গিনায় আলপনা দিতে গেলেন। রাণী একমন চাল বেটে, সাত কলস জলে গুলো নিয়ে তাতে এক গোছা শনের নুড়ো ডুবিয়ে সারা আঙ্গিনা লেপতে লাগলেন। এখানে এক খাবলা দেন, ওখানে এক খাবলা দেন!!
আর দাসী আঙ্গিনার এক কোণে একটু ঝাড়-ঝুড় দিয়া পরিস্কার করে একটু চালের গুঁড়ায় খানিকটা জল মিশিয়ে, সরু একটু নেকড়া ভিজিয়ে, আস্তে আস্তে পদ্ম-লতা আঁকলেন। পদ্ম-লতার পাশে সোনার সাতটি কলস আঁকলেন; কলসের উপর চুড়া, দুই দিকে ধানের ছড়া একে, ময়ূর, পুতুল, মা লক্ষ্মীর সোনা পায়ের দাগ, এই সব একেঁ দিলেন।
তখন সেই বিচিত্র মানুষ কাঁকণমালাকে ডেকে বললো, "ও বাঁদী! এই মুখে রাণী হয়েছিস?
"হাতে কাঁকনের নাগন্ দাসী!
সেই হলো রাণী, রাণী হলেন দাসী!
ভাল চাস তো, স্বরূপ কথা বল।"
কাঁকণমালার গায়ে যেন আগুনের হল্কা পড়লো। তিনি গর্জে উঠে বললেন, "কে রে পোড়ারমুখো দূর হ তুই'।"
জল্লাদকে ডেকে বললেন,"দাসীর আর ঐ নির্বংশে'র গর্দান নাও; ওদের রক্ত দিয়া আমি স্নান করবো"
জল্লাদ গিয়ে খপ করে দাসী আর মানুষকে ধরলো। তখন মানুষটা পুঁটলী খুলে বললো-
"সুতা সুতা নট্খটি!
রাজার রাজ্যে ঘট্ঘটি
সুতন সুতন নেবোর পো,
জল্লাদকে বেঁধে থো।"
অম্নি এক গোছা সূতা গিয়ে জল্লাদকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রাখলো।
মানুষটা আবার বললো,-"সুতা তুমি কার?-
সুতা বললো,-"পুঁটলী যার তার।"
মানুষ আবার বললো,
"যদি সুতা আমার খাও।
কাঁকণমালার নাকে যাও।"
সুতোর দুই গুটি গিয়ে কাঁকণমালার নাকে উপর ঢিবি গেরে বসলো। কাঁকণমালা ব্যাস্ত, সমস্তে ঘরে উঠে বলতে লাগলো,-"দুঁয়ার দাঁও, দুঁয়ার দাঁও, এঁটা পাঁগন, দাসী পাঁগন নিয়ে এঁসেছে।"
পাগল তখন মন্ত্র পড়ছে-
"সুতা সুতা সরুলি, কোন্ দেশে ঘর?
সুঁচ রাজার সুঁচে গিয়ে আপনি পর।"
দেখতে-না-দেখতে হিল্ হিল্ করে লাখ লাখ সুতা রাজার গায়ের লাখ লাখ সুঁচে পরে গেল।
তখন সুঁচেরা বললো,-
"সুতার পরাণ সীলি সীলি, কোন ফুড়ন দি।"
মানুষ বলিল,-
"নাগন্ দাসী কাঁকণমালার চোখ-মুখটি।"
রাজার গায়ের লাখ সুঁচ উঠে গিয়ে, কাঁকণমালার চোখ-মুখ সেলাই করে রইল। কাঁকণমালার যে ছট্ফটিয়ে জান যায় যায় অবস্থা!
রাজা তখন চোখ মেলে দেখেন, মানুষটি আর কেউই নয়, তার সেই পুরানো রাখাল বন্ধু!
রাজা তখন রাখালের সাথে কোলাকুলি করলেন। রাজার চোখের জলে রাখাল ভাসলেন, রাখালের চোখের জলে রাজা ভাসলেন।
রাজা বললেন,-"বন্ধু আমার দোষ দিও না, শত জন্ম তপস্যা করেও তোমার মত বন্ধু পাব না। আজ হতে তুমি আমার মন্ত্রী। তোমাকে ছেড়ে আমি কত কষ্ট পেলাম; আর কখনো তোমায় ছাড়বো না।"
রাখাল বললো, "আচ্ছা! তা তোমার সেই বাঁশিটি যে হারিয়ে ফেলেছি; একটি বাঁশি দিতে হবে!'
রাজা রাখাল-বন্ধুকে সোনার বাঁশি তৈরী করে দিলেন।
ওদিকে সুঁচের জ্বালায় দিন-রাত ছট্ফট্ করে কাঁকনমালা মরে গেল!
কাঞ্চনমালা দুঃখ ঘুচল।
তখন রাখাল সারাদিন মন্ত্রীর কাজ করেন, আর রাত্রে চাঁদের আলোতে আকাশ ভরে গেলে, রাজাকে নিয়ে গিয়ে নদীর সেই গাছের তলায় বসে বাঁশি বাজান। রাজা গলাগলি করে মন্ত্রী-বন্ধুর বাঁশি শোনেন।
রাজা, রাখাল আর কাঞ্চনমালার সুখে দিন কাটতে লাগল।
"আমার গল্পটি ফুরলো
নটে গাছটি মুরলো"