কানের কাছে কাকটা বিরামহীন ডেকেই চলেছে। কা কা কা। বিরক্ত চোখে নুরু কাকটার দিকে তাকায়। তাড়াবার চেষ্টা করে না। জানে কাকটাকে তাড়িয়ে কোন লাভ নাই। কিছুক্ষণ বাদে সেটি আগের জায়গায় এসে বসবে এবং বিরামহীন ডাকতে থাকবে কা কা কা। নুরু ক্লান্ত চোখ ফিরিয়ে নেয়। রোদটা আজ বড্ড চড়া। রোদের তেজে গায়ের ভিতর কেমন গুলিয়ে উঠছে। ছায়া কোন জায়গায় বসতে পারলে হতো। তবুও নুরু ওঠে না। আগের জায়গায় ঠায় বসে থাকে। উঠে দাড়াবার শক্তিও অবশিষ্ট থাকলে তো। গত দুইদিন ধরে বলতে গেলে নুরু কিছুই খাই নি। খাবে কি? কাজ নাই, তাই খাওয়াও নাই। এই পৃথিবীতে নুরুর আপন বলতে কেউ নাই। নুরু রাস্তার ছেলে। রাস্তার মানুষ। সে জানে না তার বাবা-মা কে। তার জন্ম ইতিহাস। হয়তো দারিদ্র ঘরের কোন অভাবী মায়ের সন্তান, অন্নের জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে খোদার আদমকে খোদার হাতেই সোপর্দ করে দিয়েছে; অথবা কোন অসতর্ক মুহুর্তের ফসল। জন্ম থেকেই নুরু চিনেছে রাজপথ। নিজের পরিচিতি হয়েছে রাস্তার টোকাই। যেদিন পয়সা জোটেনি, সেদিন কেউ তার মুখে খাবারও তুলে দেয় নি। ডাস্টবিনের বাসি-পঁচা খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করেছে কুকুর আর কাকের সাথে। রাজপথ, রেলস্টেশন, খোলা আকাশের নিচে উদ্যানে কেটেছে রাত, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা। সমাজের চরম অবহেলিত এই পথশিশুদের নিয়ে কবিরা কবিতা লেখে, সাহিত্য রচনা হয়, সাংবাদিকরা কলাম লেখে, সুশীল সমাজ সেমিনার, দিবস পালন করে, এদের নিয়ে সরকারের উদ্বেগের শেষ নেই। কিন্তু টোকাই চিরকালই টোকাই।
মাঝে মাঝে নুরুর মাথায় এইসব দার্শনিক চিন্তার জন্ম হয়। নুরু দর্শন বোঝে না। তবুও আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ তো! মনে হয়, এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? কিন্তু মৃত্যুকে যে বড় ভয়। গ্রীষ্মের তেতে ওঠা রোদকে গায়ে মাখামাখি করে জ্বরো শরীরকে টেনে হিচড়ে নিয়ে রাস্তার পাশে ডাস্টবিনের গা ঘেসে বসে। সতর্ক চোখ রাখে রাস্তার লালবাতির দিকে। লালবাতিটি কখন জ্বলে উঠবে সেই অপেক্ষায়। আজকাল রাস্তার মানুষগুলো বড় কৃপণ হয়ে গেছে। প্রতিদিন কতটাকা অকারণে উড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ তাদের কাছে সামান্য পয়সা চাইতে গেলে তারা ধমকে ওঠে। এমনও হয়েছে কেউ কেউ গলা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। তবুও নুরুর রাস্তার লালবাতি জ্বলে ওঠার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কাজ করবার সামান্য শক্তিও শরীর থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেটের ভিতর চো চো করছে। সকাল থেকে তিনবার বমি হয়েছে। কিছুই না শুধু তিতকুটে পানি। সারা মুখ তেতো হয়ে আছে।
নুরু উঠে দাড়াবার চেষ্টা করে। গা কাঁপছে। তবুও তাকে উঠে দাড়াতে হবে। রাস্তার লালবাতিটা জ্বলছে। চলন্ত গাড়িগুলো এখন নিশ্চল। এই তো সময়। যেকোন একটি গাড়ির জানালার পাশে দাড়িয়ে করুন আকুতি জানালে যদি কারো মন গলে, ভাগ্য ভালো হলে পাওয়া যেতে পারে একটাকা বা দুই টাকার নোট। নুরুর মন বলছে এইবার তার ভাগ্য খুলবে। নুরু প্রাণপণে দু'পায়ের উপর ভর দিয়ে রাখে। মাথা ঘুরছে। এখন এ ব্যাপারে আমল দেবার সময় নেই। থেমে থাকা গাড়িগুলো দিকে সে পা বাড়ায়। শুধু সে নয়, তার মতো অনেকেই থেমে থাকা গাড়িগুলোর দিকে ছুটে যায়। কেউ ফুলের মালা হাতে, কেউবা খালি হাতে গাড়িগুলোকে ঘিরে ধরে। কারও ফুলের মালা কেনার জন্য আকুতি, কারও সাহায্যের জন্য মিনতি। নুরুর চোখ যায় সাদা রঙের একটা কার গাড়ির জানালায়। পুতুলের মতো সুন্দর ছোট্ট মেয়েটি পরম বিস্ময়ে বাইরের পৃথিবীকে দেখছে। নুরু চেয়ে দেখে মেয়েটি গাড়ির জানালার ফাঁক গলিয়ে একটা পয়সা ছুড়ে মেরেছে। নুরুর কী ভাগ্য। কেউ দেখেনি। শুধু নুরু দেখেছে। এ পয়সাটা একমাত্র তারই প্রাপ্য। এখনই গাড়িগুলো চলতে শুরু করবে। লালবাতি নিভে সবুজ, তারপর হলুদ বাতি জ্বলবে। রাস্তাটি আবারও চলে যাবে গাড়িওয়ালাদের দখলে। তার আগেই নুরুকে পয়সাটি কুড়িয়ে আনতে হবে। নুরু মনে মনে বলে,' হে আল্লাহ আমায় আরেকটু বল দাও'। মাঝ রাস্তায় দাড়িয়ে নুরু কিছু একটা পরিবর্তন বুঝতে পারে। ঠিক কি ধরনের পরিবর্তন নুরু ধরতে পারে না। মাথাটা একটু বেশিই ঘুরছে। ওর কাছে মনে হয়, সমস্ত পৃথিবীটায় দুলছে।রাস্তার গাড়িগুলো সচল হতে শুরু করেছে। তা কি করে সম্ভব? হলুদ বাতি কি জ্বলে উঠেছে? এত তাড়াতাড়ি? পয়সাটা যেখানে পড়ে আছে সেখানটিতে কোন গাড়ি নেই। রোদের আলোয় পয়সাটি ঝকমক করছে। এতটুকুও সময় নষ্ট করা চলবে না। নুরু এক পা বাড়াতেই কোন কিছুর সাথে ধাক্কা খায়। সারা দেহে চাপা যন্ত্রণা অনুভব করে। হঠাৎ এমন তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে কেন? নুরু একবার ট্রাফিক পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েছিল। সেদিনের তীব্র যন্ত্রণা থেকেও আজকের যন্ত্রণা আরো তীব্র। নুরু আর দাড়িয়ে থাকতে পারে না। নুরুর পৃথিবীতে আঁধার নেমে আসে। চারিদিকে এতো আলো অথচ নুরুর চোখে অমানিশার অন্ধকার। কেমন শীত শীত অনুভব হয়। একটু আগে গরমের উত্তাপে প্রাণ অতিষ্ঠ হচ্ছিল আর এখন ভীষণ ঠান্ডা এবং সেই সাথে অসহ্য যন্ত্রণা। নুরু শুণ্যে পয়সাটি হাতড়ায় কিন্তু পায় না। হঠাৎ করে ওর চোখে ঘুম নেমে আসে। বহুকালের জমানো শান্তির ঘুম। সে ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে।
কিছুক্ষণের জন্য পৃথিবী থমকে দাড়িয়েছিল। বিরামহীন ডেকে চলা কাকের কা কা শব্দ ধ্বনিও থেমে যায়। ব্যস্ত নগরীর মানুষগুলো যাদের একমুহুর্ত সময় নেই চারপাশের জগতের দিকে ফিরে তাকানোর। সেই মানুষগুলোও আকস্মিক এক ঘটনায় মূর্তি বনে যায়। তাদের বিশ্বাসঘাতক চোখ দু'টি প্রত্যক্ষ করে এক নির্মম দৃশ্য। কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে 'আ-হ-হ'। ব্যস্ত পথচারীরা আকস্মিক চিৎকার শুনে তাদের পথ অভিযান স্থগিত করে। চিৎকারের উৎস খুজেঁ পেতে খুব বেশি দেরি হয় না। সব পথচারীকে সাক্ষী করে একটা মাইক্রোবাস সাত-আট বছরের এক ছেলেকে চাকায় পিষ্ট করে চোখের নিমিষেই হাওয়া হয়ে যায়। পথচারীরা তাদের গুরুতর কাজ ফেলে ছুটে আসে। জীবনে এমন দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়। তারা রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত ছেলেটাকে ঘিরে দাড়ায়। ট্রাফিক পুলিশটিও দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসে। তার কর্তব্য সম্পাদনে ব্যস্ত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টা। পরিস্থিতি এখনও তার নিয়ন্ত্রণে। উপস্থিত কেউই উচ্চবাচ্চ করছে না এটা একটা ভাল লক্ষণ। একজন হৈ করলেই শিয়ালের মতো আর সকলেই হৈ করে উঠবে। আপাত নিরীহ এই মানুষগুলো হয়ে উঠবে হিংস্র। চলবে বেহিসাবী গাড়ির কাঁচ ভাঙচুর। রাস্তায় নেমে আসবে ত্রাসের রাজ্য। ছেলেটি এখনো মারা যায়নি। ক্ষীণভাবে হাত নাড়ছে। অদৃশ্য কিছু ধরতে চায়। তখনই পুলিশের দৃষ্টিগোচর হয় রাস্তায় পড়ে থাকা একটা এক টাকার পয়সা। সামান্য একটাকার জন্য ছেলেটি মারা যেতে চলেছে? হায়রে একটাকার জীবন। হাসপাতালে নিলে ছেলেটিকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করা যেত। কিন্তু উপস্থিত কেউই নিজের ঘাড়ে ঝামেলা নিতে চায় না। সকলেই আজরাইলের অপেক্ষায় থাকা। একটা মৃত্যু দেখার জন্য মানুষের কী অধির আগ্রহ! বেশি সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজরাইল সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে নুরু নামের ছেলেটির জীবনের সকল দুঃখ-কষ্টের থেকে মুক্তি দেন। রাস্তায় পড়ে থাকে নুরুর নিথর দেহ। পৃথিবীর কালো মাটির তপ্ত বুকে নুরুর রক্তের স্রোত সব পাপ-বঞ্চনা মুছে দিতে চায়। জীবন্ত নুরু রাস্তায় পড়ে থাকা একটাকার পয়সা ছুঁতে না পারলেও তার রক্তের স্রোত ঠিকই পয়সাটিকে ছুঁয়ে ফেলে। রক্ত সমুদ্রে হাবু-ডুবু খায় পয়সাটি।
ডাস্টবিনের উপর বসে থাকা কাকটি কখন যে রাস্তার বিদ্যুতের তারের উপর এসে বসেছে কেউ খেয়াল করেনি। সকলের অলক্ষ্যে কাকটি দেখল একজন মানুষের নিরবে ঝরে যাবার দৃশ্য। স্রষ্ঠার শ্রেষ্ট সৃষ্টির কীর্তি দেখে কাকটি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। হা-হা-কার করে ওঠে। কা কা শব্দে ভেঙে ফেলতে চায় জনতার নিস্তব্ধতা, সব বৈষম্য। ভাগ্যিস মানুষ কাকের ভাষা বোঝে না। বুঝলে লজ্জায় তাদের মাথা হেট হয়ে যেত। নাকি সেই বোধ ক্ষমতাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে বহুদিন আগে!