কানাডা এমন একটি দেশ যে দেশ সবসময় নতুনদের স্বাগত জানায়। শুধু দেশ বলে কথা নয়; এ দেশের মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়ই যেন নতুনদের স্বাগত জানাতে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে।
এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে ওয়েলকাম টু কানাডার যাত্রা শুরু। তারপর তো ওয়েলকাম আর ওয়েলকাম। বাসা ভাড়া নিন-ওয়েলকাম। গাড়ি কিনুন-ওয়েলকাম। ইন্সুরেন্স নিন-ওয়েলকাম। বাড়ি কিনুন-ওয়েলকাম। আপনার পকেট থেকে যত বেশি উজাড় করে দিতে পারবেন ততই ওয়েলকাম বেশি করে পেতে থাকবেন। দিতে পারার মধ্যেই নাকি আনন্দ বেশি। আর সে আনন্দের গর্বিত ভাগিদার দেখছি কেবল নবাগত ইমিগ্রেন্টরাই!
আমরা বাঙালিরা হলাম লেট লতিফের জাতি। সবকিছু যখন শেষের দিকে তখন আমাদের যাত্রা শুরু হয়। ভারতীয়-পাকিস্তানীদের পেছনে পেছনে আছি আমরা। এতে অবশ্য আমাদের দোষ নেই। কেউ দোষ দিতে চাইলেও দিতে পারবে না। তাদের চাইতে তো আমরা এমনিতেই চব্বিশ বছর লেট। অর্থাৎ তারা স্বাধীনতা লাভ করেছে সেই ১৯৪৭ সালে; আর আমরা লাভ করেছি ১৯৭১ সালে। সেই যে গ্যাপ শুরু হয়েছিল এখনও সেই গ্যাপ কাভার করা যায়নি।
এদেশে পা রাখতে না রাখতে কেউ কেউ বললেন, বড্ড দেরীতে আসলেন; এখানকার মজা তো শেষ। নবাগত হিসেবে পুরাতনের মুখের উপর উত্তর দেয়াটা কেমন জানি বেয়াদবি বলে মনে হয়। নইলে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল-আগে এসে কি মজা কুড়িয়েছেন আর এখনই বা কি মজায় আছেন। আর আগে আসতে গেলে তো বায়ান্নো সালে জন্ম নিতে হতো অথবা তারও আগে জন্ম নিলে হয়তো ভাষা শহীদ হিসেবেও নাম লিখাবার একটা সুযোগ থাকতো। না, এত রূঢ় হওয়া ঠিক না। যার যার ভাবনা তার তার। ৫০ বছর আগে এসেও অনেকে কিছু করতে পারেননি; অথচ মাত্র ৫ বছর আগে এসে অনেকে বহুদুর এগিয়ে গেছেন। প্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায় মানুষকে তার গন্তব্যস্থলে নিয়ে যেতে সহায়তা করে- আমার কথা নয়; এটা গুণীজনদের কথা।
প্রথম প্রথম যে কোন নুতন দেশে, নতুন শহরে গেলে অন্যরকম অনুভূত হয়। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সেরকম আর থাকে না। প্রথম সিএন টাওয়ার দর্শনের শিহরণ কিংবা প্রথম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের শীতল ছোঁয়া এখন আর ঐদিনের মতো স্পর্শ করে না। সাবওয়েতে চড়ে ষ্টেশনের নাম মুখস্ত করার মধ্যে কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না তারপরও নাম মনে রাখার মধ্যে ছিল অন্যরকম এক আনন্দ।
দিন যায়, নতুন ইমিগ্রেন্ট পুরনো হয়ে যেতে থাকেন। আগের আনন্দ-অনুভূতিগুলো যেন বরফের স্তুপে চাপা পড়ে যায়। মানুষের ব্যস্ত জীবন। না, জীবনের জন্য ব্যস্ত মানুষ। মাত্র কয়েকটি বছরের মধ্যে মানুষ বদলে যায়। বলতে গেলে পরিবেশ তাকে বদলে দেয়। ঘর আর কর্মস্থল, কর্মস্থল আর ঘর। এই তো জীবন। নতুনদের সবাই বুদ্ধু ভাবে। শাশুড়ির কাছে যেমন নতুন বৌ। সব দেশে, সব কালে, সব জায়গায় মনে হয় একই রীতি। নতুন লোক গ্রাম থেকে শহরে গেলে যেমন, নতুন ছাত্র স্কুল থেকে কলেজে গিয়ে যেমন; নতুন অভিবাসীরাও এক দেশ থেকে অন্য দেশে এসে বুদ্ধু হয়। আমিও একদিন হয়েছিলাম। শুনুন তাহলে সে কাহিনী।
একদিন মেইলবক্সে দেখি আমার নামে বিরাট এক চিঠি। চিঠিতে লেখা আমি লটারীতে ৫ মিলিয়ন ডলার জিতে গেছি। চিঠিতে অনেক কথার মধ্যে লেখা আছে ৫০ লক্ষ লোকের মধ্যে আমার নাম লটারীতে উঠেছে। আমি একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি। ভালো করে দেখলাম আমার নাম ঠিকানা। সুন্দর ঝকঝকে প্রিন্ট করা কোন ভুল নেই। সারা জীবনে যে লোক এক লাখ টাকা জমাতে পারেনি, ভবিষ্যৎ বলতে যার কিছু নেই বললে চলে; তার দিকে ভাগ্যদেবতা এমন সুনজর দিলেন! ভেবে হই আকুল। আনন্দ-খুশীতে আত্মহারা। মনে মনে ভাবি জীবনে কষ্ট তো কম করিনি; এটা হলো কষ্টের ফল। একদিকে না একদিকে সৃষ্টিকর্তা যে ব্যবস্থা করে দেন এটা হলো তার প্রমাণ। ২৪ ঘন্টার মধ্যে একটি ফোন নম্বরে চিঠির প্রাপ্তি সংবাদ জানাতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তারা দ্বিতীয় নম্বরে যার নাম উঠেছে তাকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করবে। কি সর্বনাশের কথা! একটি ফোন কলও যে মানুষের ভাগ্যের সাথে কিভাবে জড়িয়ে আছে উপলব্ধি করলাম। না, দেরী করা যায় না। যা কিছু ভাবনা পরে হবে আগে টেলিফোন। ওপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, চিঠির সাথে যে ফর্মটি দেয়া আছে তা যেন পূরণ করে ৭২ ঘন্টার মধ্যে প্রেরণ করি। সময়ের কি কড়াকড়ি? হবেই না কেন? ৫ মিলিয়ন ডলারের ব্যাপার-স্যাপার বলে কথা! ফরম পূরণ করতে গিয়ে দেখি কোম্পানীর পলিসি অনুযায়ী তাদের একটি প্রোডাক্ট কিনতে হবে। প্রোডাক্ট না কিনলে লটারী বিজেতা তার যোগ্যতা হারাবেন। ভাবলাম, বিক্রি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কোম্পানী নানা রকম প্রচারণা চালায়। তারা হয়তো দেখাবে যে, এই লোক আমাদের জিনিষ কিনে সাথে একটি লটারী জিতে নিয়েছে। ভাবনার শেষ নেই। তালিকায় সর্ব নিম্ন মূল্যের যে জিনিষটি লেখা আছে সেটা একটি ভ্যাকুম মেশিন এবং এর মূল্য হচ্ছে তিনশত ডলার। কি ফাঁদে পা রাখতে যাচ্ছি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে পড়লো। পাশের বাড়ির পুরাতন অভিবাসীর কাছে গেলাম। তিনি অনেক ভেবে চিন্তে বললেন, পয়সা-কড়ি তো এমনিতেই অনেক খরচ হয়; মনে করেন তিনশত ডলার পানিতে ফেলে দিলেন। তারপরের ইতিহাস বড় করুণ ইতিহাস। তারপরের ইতিহাস ঠগ এবং প্রতারণার ইতিহাস। ঠগ এবং জালিয়াতি কত প্রকার ও কি কি ক্যানাডা তথা উত্তর আমেরিকায় না এলে বুঝি বুঝতে পারতাম না। বাংলাদেশের তাবৎ ঠগ এদের কাছে নস্যি। পানিতে কিভাবে টাকা ফেলতে হয় অবশেষে শিখলাম।
এরপর আরো বহু চিঠি এসেছে। জীবন যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের মাঝখানে দোলা খেলেও ঠগের রাজ্যে বহুবার বিজয়ী হয়েছি। নানান দেশে নৌ-বিহার থেকে শুরু করে একবার তো বিশ্বভ্রমণের জন্যও বিজয়ী হয়েছিলাম। তবে সর্বশেষ কিছুদিন আগে অন্টারিও লটারীতে ৫টি নম্বর মিলে যাওয়ায় এক হাজার ডলার পকেটে এসেছে।
অতি সম্প্রতি ই-মেইল-এ একটি অভিনব চিঠি পেয়েছি। এ চিঠি সম্পর্কে লিখতে গিয়েই পুরুনো প্রসঙ্গ মনে পড়লো। এবারে ভাগ্যদেবী কোন পুঁজি ছাড়াই সরল বিশ্বাসে আমার প্রতি অতীব সু-প্রসন্ন হয়েছেন। চিঠিটি এসেছে সুদূর এঙ্গোলা থেকে। পাঠিয়েছেন এঙ্গোলার ইউনিটা জাতির রাজা জনাস সাভিম্বির কন্যা রাজকুমারী তিহজা সাভিম্বি। তিনি লিখেছেন-
প্রিয় বন্ধু,
আপনার ঠিকানাটি আমি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে আপনাকে বিশেষ কারণে লিখছি। দয়া করে আমার পুরো চিঠিটা মনযোগ দিয়ে পড়ে আপনার সিদ্ধান্ত জানাবেন।
আমার পিতা ইউনিটা জাতির রাজা জনাস সাভিম্বিকে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার গত ২৩শে ফেব্রুয়ারী নির্মমভাবে হত্যা করে। আমার বয়স ২১। আমি ও আমার মা ছাড়া পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। বর্তমানে আমরা গৃহবন্দি হয়ে আছি। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আমার পিতা আমার মাকে একটি সার্টিফিকেট দিয়ে যান। সেই সার্টিফিকেটটি হচ্ছে একটি ইউরোপিয়ান সিক্যুরিটি কোম্পানীর। যেখানে আমার পিতা ৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলার গচ্ছিত রেখেছেন। যেহেতু আমরা গৃহবন্দী সেহেতু এই অর্থ সিক্যুরিটি কোম্পানী থেকে উঠানো সম্ভব হচ্ছেনা বিধায় আপনার শরণাপন্ন হলাম। কেন জানি মনে হলো আপনি খুব বিশ্বস্ত এবং দয়ালু। আমার মা বললেন আপনাকে একটি চিঠি লিখতে। আপনি যদি আপনার নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট-এর নম্বর আমাদের পাঠান তাহলে সার্টিফিকেটটি আপনার কাছে পাঠিয়ে দিব। আপনাকে বিশেষ কিছু করতে হবে না। শুধু ইউরোপের ঐ সিক্যুরিটি কোম্পানীকে গিয়ে সার্টিফিকেট খানা দেখালে তারা আপনাকে একটি ডিপ্লোমেটিক ষ্টিলের ট্রাঙ্ক এনে দিবে। ঐ কোম্পানী জানে না এটার মধ্যে কি আছে। আমি এবং আমার মা ছাড়া আপনি হলেন এখন তৃতীয় ব্যক্তি যিনি এ বিষয়ে অবগত হলেন।
আমার মা বলেছেন গচ্ছিথ অর্থের ২৫% আপনাকে দিয়ে দিতে। এটা আপনাকে উপহার হিসেবে দেয়া হলো। যেহেতু আপনাকে বিশ্বস্ত বলে মেনে নিয়েছি সেহেতু আপনার প্রতি আমাদের অনুরোধ আপনি বাকি অর্থ বড় কোন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করুন। সম্পূর্ণ মুনাফা আপনার। যদি আমরা কোনদিন মুক্তি পাই সেদিন আপনি আমাদের অর্থগুলো ফেরত দেবেন।
আমার পত্রখানা আপনার অনুভূতিতে কতটুকু ছুঁতে পেরেছে জানি না তবে আমাদের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে আপনি এ চিঠিটাকে গুরুত্ব দেবেন বলে বিশ্বাস। আপনি মোটেই ভয় পাবেন না। এগুলো আমাদের অর্থ। আমার মা আপনাকে লিখিতভাবে মনোনীত করে দিচ্ছেন। গোপন কথাটি গোপন রাখবার অনুরোধ রইলো। আপনার পত্রের অপেক্ষায় -
রাজকুমারী তিহজা সাভিম্বি