দেশের সকল ধরনের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান সহ নানাবিধ দায়িত্ব বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির ( বি আর টি এ) উপর ন্যস্ত। বাংলাদেশের প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সংস্কৃতি এখানেও প্রকট ।
গত বছর অর্থাৎ গত ২০১০ সালের অগাস্ট মাসে আমি ওমান থেকে দেশে আসি। ওমান সরকার এর কিছুদিন আগে ঘোষণা করে যেসব এক্সপাট্রিয়েট ( বহিরাগত ) দের নিজ দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকবে তাদের শুধু মাত্র রোড টেস্ট এ পাশ করলেই ওমানি লাইসেন্স দেওয়া হবে। ড্রাম ও স্লোপ টেস্ট লাগবে না। আপনারা জানেন মধ্যপ্রাচ্য একটা ড্রাইভিং লাইসেন্সের অনেক মূল্য।এ দেশে যেমন ড্রাইভিং সিটে কোন দিন না বসেও লাইসেন্স পাওয়া যায় সেখানে সে সুযোগ নেই। সেখানে আমলা তান্ত্রিক জটিলতা না থাকলেও ড্রাইভার কে উপযুক্ত ড্রাইভারের বাস্তব প্রমান দিয়েই লাইসেন্স পেতে হয়। এজন্য সেখানে একটা কালচার হলো কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলে মহা খুশি হয়ে মিস্টি বিতরন করে(বাঙগালীর)। আর এই লাইসেন্স দিয়ে মধ্য প্রাচ্যের প্রায় সব কটি দেশে চলাফেরা করা যায়। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্য ড্রাইভিং টেস্ট ব্যয়বহুল তাই আমি ভাবলাম ড্রাম ও স্লোপ টেস্ট যদি না দেওয়া লাগে তবে অনেক কম খরচে লাইসেন্স পাওয়া যাবে। তাই আমি দেশে এসে ঢাকার এক ড্রাইভিং স্কুলে যোগাযোগ করলাম। সেখানে কিছুদিন ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে গেলাম সেই সদরঘাটের বিআরটিএ অফিসে পরীক্ষা দিতে। প্রথমে লিখিত পরিক্ষা দিলাম ও পাশ ও করলাম। তার ২ ঘন্টা পর শুরু হলো মৌখিক পরীক্ষা। দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে অবশেষে আমার পালা এলো। কিন্তু বিধিবাম।
যখন আমি ঢুকলাম তার কিছুক্ষণ আগে ম্যাজিস্ট্রেট প্রবেশ করল। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন আমি কি করি? আমি বললাম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। সে ড্রাইভিং সম্পর্কিত প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুরু করলেন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশ্ন। কংক্রিট কয় প্রকার? সিমেন্ট বালির রেশিও কত? ইত্যাদি। আমি ভাবলাম ডিজিটাল যুগে কি ড্রাইভার দের বিল্ডিং বানানো সম্পকির্ত জ্ঞান আবশ্যক? হতে পারে। দেশে কি না হচ্ছে? যাই হোক মহামান্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পাশের অফিসারকে বললেন হবে না। তার মানে বুঝতেই পারছেন.. ফেইল।
সেদিন ব্যর্থমন নিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি। আবার প্রায় ১৫ দিন পর ডেট পড়ল। এবার সরাসরি মৌখিক পরীক্ষা। আবার দেখি সেই মহামান্য ভদ্রলোক। আমি এবার একটু টেকনিক করে( টেকনিক্যাল মানুষ তো!) যখন দেখলাম ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন তখন আমি লাইনে দাড়ালাম।অফিসার কিছু ড্রাইভিং সম্পকির্ত প্রশ্ন করে বইয়ের উপর লিখে দিলেন ”পাশ”।
এবা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার পালা। যেভাবেই হোক সেদিন সব পরীক্ষায় পাশ করে বাড়ি চলে আসলাম। এবার অপেক্ষার পালা।আমি চলে গেলাম ওমান।
তিন মাস পর খোঁজ নিলাম। এখনো হয় নি। চার মাস পর খোঁজ নিলাম। লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রয়েছে।
আট মাস পর দেশে আসলাম। এসে খোঁজ নিলাম। শুনলাম আরেক তাজ্জব ঘটনা। আগের নিয়মে আর লাইসেন্স দিচ্ছে না। নতুন টাকা জমাদিয়ে ডিজিটাল ছবি আর ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে আসতে হবে। তার পর আবার আগের মতো অপেক্ষা করতে হবে। কি আর করা? ডিজিটাল সরকার বলে কথা!। তার পর আবার ডিজিটাল লাইসেন্স!
গত অক্টোবর মাসে গেলাম ঢাকার বিআরটিএ অফিসে ডিজিটাল ছবি তুলতে। প্রথমে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে টাকা জমা দিলাম। এর পর আরেক দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে কাগজ পত্র জমা দিতে গেলাম। সেই কাউন্টার থেকে আমাকে ফেরত পাঠাল ফটোকপি না থাকার অজুহাতে। ফিরে এসে আবার ফটোকপি করে জমা দিলাম।সেই কাগজ প্রসেসিং হতে সময় লাগবে। কয় ঘন্টা লাগে আল্লাহ মালুম। আমি তো মহা টেনসনে। আজ ছবি তোলা হয় কিনা এই নিয়ে।
দুপুরের পরে আসলাম। একজন ভদ্র লোক মাইকে নাম ঘোষণা করছেন। যাদের যাদের নাম আজ ঘোষণা করা হবে তারা তারা আজ ছবি তুলতে পারবে। বাকিরা কাল। আল্লা আল্লা করছিলাম। অবশেষে আমার নাম ডাকল। আমি মহা খুশিতে গেলাম ছবি তোলার রুমের দিকে। সেখানেও দীর্ঘ লাইন। অবশেষে ছবি তোলা হলো। সেখান থেকে কিছু কাগজ পত্র দিল। সেটা নিয়ে আবার আরেক দীর্ঘ লাইনে দাড়াতে হলো। বেলা প্রায় শেষ। তার পরও ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে তারা আমার কাগজ জমা নিয়ে ডেট দিল। ডেট দেখে তো অবাক! দুই মাস পর লাইসেন্স দিবে। একটা কার্ড বানাতে দুইমাস সময় লাগে। এই একই রকম ডিজিটাল প্লাস্টিক কার্ড ওমান সরকার একদিনের মধ্যেই দেয়।
দুই মাস পর খুলনা থেকে গেলাম ঢাকা বিআরটিএ তে লাইসেন্স আনতে। অফিস খোলার আগেই যেয়ে হাজির। যেয়ে তো আমার মাথা খারাপের মতো খবর। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করছে ভাই মোবাইলে মেসেজ পেয়েছেন? আমি বললাম এরকম তো শুনিনি। বা তারাও তো আমাকে কিছু ইনফরম করে নি। একজন বলল ভাই ডিজিটাল নিয়ম। যাদের মোবাইলে ম্যাসেজ যায় নি তারা লাইসেন্স পাবে না। এটা আবার কি নিয়ম। অনেকের তো সেট হারিয়ে যায়। অনেকে সিম চেঞ্জ করে। আমি নিজেও স্বরন করতে পারছিলাম না কোন নাম্বার আমি ফরমে দিয়েছিলাম। অবশেষ বাধ্য হয়ে সেদিন ফিরে আসতে হলো। সেদিন আবার একটা ডেট তারা দিয়ে দিল। যে ডেট দিল তাতে দেখা গেল লাইসেন্স আর ওমানে এবার নিয়ে যেতে পারব না। আরো দুই মাস পরের ডেট। বলল এই ডেটের মধ্য আপনার নাম্বারে ম্যাসেজ যাবে। তার পর আসবেন। এই কথাটা তারা কি আগে বলতে পারতো না????
অবশেষ গত ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে কাংখিত ম্যাসেজটি আসল বিআরটিএ থেকে। এই সীমাহীন হয়রানি, সময়, অর্থ ত্যাগ স্বাীকার করে অবশেষে ডিজিটাল লাইসেন্স টি হাতে পেলাম। দুঃখের বিষয় এটা পেয়েও আমি যে উদ্দেশ্যে লাইসেন্সটি চেয়েছিলাম তা আপাতত হচ্ছে না। কারণ ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ এক বছর না হলে সেটা ওমানে কার্যকরি হয় না। তার মানে যেই লাউ সেই কদু।আমাকে ওমানে যেয়ে সেই ড্রাম ও স্লোপ টেস্ট পাশ করেই লাইসেন্স পেতে হবে। হায়রে ডিজিটাল লাইসেন্স হায়রে ডিজিটাল বাংলাদেশ‼‼