মানুষের গল্প বলতে বসলে একটা ঝামেলা আছে। ঝামেলাটা এই যে, মানুষ দিয়ে গল্প শুরু করা যায় না। কারণ, একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের কোথাও মানুষের ছায়াটুকুও খুঁজে পাওয়া যেত না। তারও আগে, এই পৃথিবী নামে কিছুর অস্তিত্বই ছিল না।
তাহলে? এই পৃথিবী এলো কোথা থেকে? আর আমরা, মানুষের দল, এলাম কীভাবে?
এইসব প্রশ্ন থেকেই শুরু করতে হয় গল্প। কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে। এইসব কথা এত পুরোনো, এত দূরের, যে শুনলে মাথায় ঠিক ঢোকে না। যেমন ধরো, বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর জন্ম হয়েছে অন্তত সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে। হয়তো তার চেয়েও বেশি!
ভাবো একবার! সাড়ে চারশো কোটি বছর! এর পেছনে সাতটা শূন্য। শূন্য নিয়ে খেলা করা কিন্তু সহজ নয়। একটা শূন্য যোগ করলেই সব ওলটপালট হয়ে যায়। একের পেছনে একটা শূন্য বসাও, হয়ে যাবে দশ। দশ বছর আগের কথা ভাবো—রাফি, তুমি তখন হয়তো সবে স্কুলে যাওয়া শিখেছিলে। তানিয়া, তুমি হয়তো তখনো তোমার মায়ের কোলে পড়তে বসে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতে। দশ বছরে কত কিছু বদলে যায়!
আরেকটা শূন্য যোগ করো। হয়ে যাবে একশো। একশো বছর আগে কী ছিল? তখন তোমার দাদাও জন্মায়নি। হয়তো তোমার দাদার বাবা চট্টগ্রামের কোনো গ্রামে ধানের খেতে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। তখন ঢাকায় এত বড় বড় বিল্ডিং, রিকশার হর্ন, বা মোটরগাড়ির শব্দ ছিল না। সিলেটের চা-বাগানও তখনো এত বিখ্যাত হয়নি। একটা শূন্য যোগ করলেই যেন সব আলাদা হয়ে যায়।
আরেকটা শূন্য বাড়াও। এক হাজার বছর। এক হাজার বছর আগে বাংলাদেশের চেহারা কেমন ছিল? তখন এখানে মোগল আসেনি, পাঠানদেরও দেখা নেই। ঢাকা তো দূরের কথা, খুলনার বন্দর বা রাজশাহীর আমের খ্যাতিও ছিল না। আরেকটা শূন্য যোগ করো—দশ হাজার বছর। তখন শুধু জঙ্গল আর নদী। সুন্দরবনে বাঘ ঘুরে বেড়াতো, কিন্তু সভ্যতার চিহ্ন কোথাও নেই। এখানে-ওখানে কিছু মানুষ শিকার করে আর ফল খুঁজে বেঁচে থাকতো।
এবার আরেকটা শূন্য বাড়াও। এক লক্ষ বছর। তখন কী ছিল, কে জানে? বরিশালের নদীতীরে হয়তো কেউ দাঁড়িয়ে মাছ ধরছিল, কিন্তু তাদের গল্প আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। শূন্যের খেলা এমনই—একটা শূন্য বাড়লেই সময়ের হিসেব পেছনে হাঁটতে থাকে। যখন সাড়ে চারশো কোটির কথা আসে, সাতটা শূন্য নিয়ে মাথা ঘুরে যায়। এত বড় সংখ্যা মুখে বলা সহজ, কিন্তু ভাবা? অসম্ভব!
রাফি একদিন তানিয়াকে বলল, “দেখো, এই পৃথিবীটা একটা বুড়ি। সাড়ে চারশো কোটি বছরের বুড়ি।” তানিয়া হেসে বলল, “বুড়ি? তাহলে এই সবুজ ধানখেত, নদীর পাড়ে ফুটন্ত শাপলা ফুল, আর কুমিল্লার রসমালাইয়ের গন্ধ কোথা থেকে আসে?”
রাফি চুপ করে গেল। সত্যিই তো! বাংলাদেশের চারদিকে যেন নতুনের ছড়াছড়ি। ময়মনসিংহের নদীতে নতুন মাছ ধরা পড়ছে, রংপুরের ধানের খেতে নতুন ফসল ফলছে। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন নতুন রিকশা আর সিএনজি যোগ হচ্ছে। তবু এই পৃথিবীর বয়স তো কম নয়।
তানিয়া একদিন রাফিকে নিয়ে বসল পড়তে। বলল, “চলো, হিসেব করি। একের পেছনে সাতটা শূন্য মানে কত?” রাফি কলম-কাগজ নিয়ে বসল। “সাড়ে চারশো কোটি মানে ৪৫০০০০০০০০। এত শূন্য দেখে মাথা ঘুরে যায়।” তানিয়া বলল, “এত পুরোনো পৃথিবীতে আমরা এখনো নতুন নতুন জিনিস পাচ্ছি। ভাবো, পঞ্চাশ বছর আগেও কেউ কি ভাবতে পারতো যে ঢাকায় এত উঁচু উঁচু বিল্ডিং হবে? যে রাস্তায় একসময় গরুর গাড়ি চলতো, সেখানে আজ মেট্রোরেল?”
রাফি হেসে বলল, “তুমি ঠিক বলেছো। বুড়ি হলেও এই পৃথিবীটা নতুনের জাদুকর।” তানিয়া উঠে গিয়ে এক প্লেট ভাপা পিঠা আর চা নিয়ে এলো। “খাও, এই পিঠাও তো আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে বানানো। পুরোনো রেসিপি, কিন্তু স্বাদটা আজকের।”
দুজনে বসে খেতে খেতে ভাবলো—শূন্যের খেলায় পৃথিবী এত পুরোনো হয়ে গেছে, তবু বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে নতুনের গল্প জন্ম নিচ্ছে। সিলেটের পাহাড়ে নতুন চা-পাতা, কক্সবাজারের সমুদ্রে নতুন ঢেউ, আর গ্রামের মাটিতে নতুন ফসল। বুড়ি পৃথিবীতে এই নতুনত্বই যেন জীবনের সত্যিকারের মানে।
তানিয়া বলল, “রাফি, আমরাও তো এই গল্পের অংশ। আমাদের হাতে কী নতুন গল্প লিখবে এই বাংলাদেশ?” রাফি হাসল, “সেটা সময় বলবে। তবে শূন্যের খেলা যতই চলুক, আমাদের গল্পটা থাকবে চিরনতুন।”
আকাশে সূর্য ডুবে গেল। দূরে কোথাও ভেসে এলো ভাতের গন্ধ আর নদীর হাওয়া। শূন্যের হিসেব থাকল পড়ে, কিন্তু জীবনের নতুনত্ব থামল না।
১. ২৯ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ৯:৪৬ ০
সঠিক কথা বলেছেন।