সুনীল আন্দামান সাগরের তীরে থাইল্যান্ডের পশ্চিম সীমান্ত ঘেষে পৃথিবী খ্যাত পর্য্টন নগরী ফুকেট যা কিনা দিবা রাত্রি হাজারো পর্যটকের পদচারণায় মুখর।থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় এই দ্বীপটি আনুমানিক ৫৭০ কিমি বিস্তৃত সাগর বেষ্টিত যা কিনা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপূর। এর চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো অনেক ছোটো ছোটো দ্বীপমালা আর পাহাড় যার বেশিরভাগই ই জনবসতিহীন।
বৌদ্ধ অধ্যুষিত ফুকেটের ৩০ শতাংশ জনগন মুসলিম। জাতিতে তারা বেশীরভাগই সীমান্তের অপর পারের দেশ মালয়েশিয়ার মালয়ান জাতিভুক্ত। মালয় ভাষায় 'বুকিট' শব্দটা থেকেই ফুকেটের উৎপত্তি বলে জন শ্রুতি রয়েছে। 'বুকিট' অর্থ পাহাড়। আর ফুকেটেরতো ৭০ শতাংশই পাহাড় আবৃত।
মার্চের ১১ তারিখে পনেরো দিনের জন্য থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম বিভিন্ন কাজে । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছিল ভ্রমন। চিয়াংমাই না ফুকেট কোথায় যাবো এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দ্বিধা দ্বন্দে ভুগছিলাম। শেষ পর্যন্ত ফুকেটেরই জয় হলো।
ব্যাংকক থেকে প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমে আমরা স্বামী সন্তানসহ তিনজন যাবো। প্যাকেজটা ছিল ফুকেটে হোটেল ঠিক আর দুদিনের দুটো সারাদিন ব্যাপি ট্যুর। সবুজ পাহাড়ে আবৃত ফুকেট নাম জানা না জানা কত গাছ আর ফুলের সমারোহ। কত রকম বাহারী অর্কিড, আমার প্রিয় ফুল। সুনীল আন্দামান সাগর থেকে ধেয়ে আসা ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভুমিতে।কত গল্প শুনেছি, কত ছবি দেখেছি অপরূপ সেই সৌন্দর্য যা অবর্ননীয়।
পাথং থেকে ফুকেট যাবার পথে সমুদ্র সাথে নিয়ে
মনে আছে ২০০৪ এর ২৬ শে ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরে উৎপত্তি হওয়া ভয়ংকর ভুমিকম্পে সৃষ্ট স্মরনকালের উল্লেখযোগ্য সুনামীতে ফুকেটের বিশাল এলাকা ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়েছিল। সেই বিপর্যয়ে হারিয়ে গিয়েছিল কত শত অমুল্য জীবন।
তারপর ও সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে আবার মাথা তুলে দাড়িয়েছে ফুকেট।তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনও তার ধ্বংসের চিন্হ বিদ্যমান। ভবিষ্যতে আবার এমন দুর্যোগ দেখা দিলে তার জন্য বিভিন্ন সতর্কতামুলক ব্যবস্থা দেখতে পেলাম। আর আমাদের দেশে ...
ব্যাংকক এয়ারের ফ্লাইট ব্যাংককের সুবর্নভুমি এয়ারপোর্ট থেকে এক ঘন্টা দশ মিনিটে পৌছে দিল আমাদের গন্তব্য ফুকেটে।শেষ বিকেলের আলোয় বেশ নীচু দিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেনের জানালা দিয়ে দেখছিলাম সমুদ্রের বুকে সবুজ ছোটো ছোটো দ্বীপ।
সুবর্নভুমি এয়ারপোর্টে বোর্ডিং এর অপেক্ষায়
দু দুটো ব্রীজ পার হয়ে স্হলপথে ব্যাংকক থেকে বাসেও কম খরচে যাওয়া যায় ফুকেটে। তবে অনেক সময় লাগে, কারন ৮৬৩ কিমি দুরত্ব ।আর এতক্ষন বাস জার্নি করলে আমি বাঁচবোনা, তাই প্লেনই ভরসা।
শহর থেকে অনেক দুরে ফুকেট এয়ারপোর্ট।এয়ারপোর্টের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ভাড়া করা বিলাশবহুল মাইক্রোবাস সমুদ্র তীরের এক ব্লক পেছনে আমাদের নির্ধারিত হোটেলে পৌছে দিল মাথাপিছু ২৫০ বাথ নিয়ে।
আমরা যে হোটেলে থাকবো সমতল আর পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে সেই বিখ্যাত সমু্দ্রতীরের শহর পাথং পৌছাতে আমাদের রাত হয়ে গেল।
পাহাড়ী পথে যেতে যেতে
পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আমাদের ফি, ফি দ্বীপে নেয়ার জন্য বাস আসবে। তাড়াতাড়ি পাশে একটা ওপেন রেষ্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে আমাদের পছন্দ মত সামুদ্রিক মাছ ভাজা আর ফ্রাইড রাইস খেলাম।কাচা মাছগুলো তারা বরফ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে খরিদ্দারের পছন্দের জন্য।
ওখানে মোটর সাইকেলের ব্যাপক ব্যাবহার দেখলাম।আমরা যেই রেস্টুরেন্টে খেলাম তার মালিক অল্প বয়স্ক সুন্দরী এক মহিলা চুল উড়িয়ে রাত এগারোটায় একাকী মটর সাইকেল চালিয়ে কোথায় যেন গেলো।আমাদের দেশে যা কল্পনা করাও যায়না।
এাছাড়া ও আরো মজা লাগলো দেখে যে সেখানে অনেকেই মোটর সাইকেলের এক পাশে আমাদের দেশের ভ্যানগাড়ীর মত লাগিয়ে তাতে কাচা খাবার,চুলা, গরম তেল সহ কড়াই চাপিয়ে দ্রতগতিতে ঘুড়ে বিক্রী করছে। একটা ছবি দেই, দেখেনঃ
বীচের পাশে স্টিকে গাথা বিভিন্ন খাবার
পরদিন সকাল থেকে শুরু হলো চারদিন ব্যাপী ফুকেট ভ্রমন।প্রথম দিন ছিল বিখ্যাত দ্বীপ ফি, ফি, ভ্রমন। তারপর দিন যাবো জেমস বন্ড আইল্যান্ড।
১৯৭৪ সালে ফুকেটের 'কো তাপু' আইল্যান্ডে জেমস বন্ডের ' ম্যান উইথ এ গোল্ডেন গান' ছবিটির শ্যুটিং হয়েছিল।এই ম্যুভিটিতে নায়ক ছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা রজার মুর। এরপর থেকেই এই দ্বীপটির নামই হয়ে যায় জেমস বন্ড দ্বীপ।অনেক কিছু বলার আছে ফুকেট নিয়ে তবে লেখার ধৈর্য্য নেই।
আসুন এবার তার কিছু এলোমেলো ছবি দেখি।
সুনামীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাথং বীচ আবার স্বরূপে ফেরার চেষ্টায়।
সমুদ্রের বুকে উকি দিচ্ছে পাহাড়
এখানেই শ্যুটিং হয়েছিল বিখ্যাত জেমস বন্ড মুভি 'ম্যান উইথ এ গোল্ডেন গান' এর।
আমাদের জাহাজের পাশ দিয়ে ছুটে চলা স্থানীয় ইন্জিনচালিত নৌকা
নীল সমুদ্র আর সবুজ পাহাড় ফি ফি যাবার পথে
সাগর বক্ষে জোড়া পাহাড়।
জাহাজের পেছনে পানি ভেঙ্গে এগিয়ে যাবার পথরেখা ।
দুপাশে সমুদ্র ফুড়ে উঠে আসা ছোটো ছোটো পাহাড়।
ফি ফি দ্বীপের সমুদ্র তীরে জেলে নৌকার সারি।
একটি জলযান ঘিরে আছে ক্যানো চালকরা
সমুদ্রের মাঝে ছোটো ছোটো পাহাড়ের ভেতরে ক্যানোতে চেপে ঘুরছি আমরা।
আমার স্বামী ক্যানো চালিয়ে ফিরে আসছে জাহাজে
পাহাড়ের ক্ষয়ে যাওয়া গুহায় প্রবেশ
পাহাড়ের নীচে গুহায় টর্চ লাইটের আলোয় এগিয়ে যাওয়া
গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছি আমরা
কয়েকজন সহযাত্রী সহ আমি জেমসবন্ড আইল্যান্ডে
কো তাপু ওরফে জেমস বন্ড আইল্যান্ডে আমরা
ছবিগুলো আমাদের ক্যামেরায় তোলা, ক্যামেরাম্যান আমার ছেলে, তাই দোষত্রুটি মার্জনীয়