২০১০ সাল প্রৌঢ়া রাবেয়া বেগম পাঁচ ছেলে মেয়ের মা,এখন আর তেমন চোখে একটা ভালো দেখেনা, সব কিছু যেন ঝাপসা ঝাপসা। ছেলেরাও কয়েকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে, অপারেশন করিয়েছে, তারপরও খুব একটা উন্নতি হয়নি। পানের বাটা নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে পান বানাচ্ছে বিছানার এক কোনে বসে, একটা আন্দাজও হয়ে গেছে চুন, সুপারী, জর্দার পরিমানের।
হঠাৎ কানে ভেসে আসলো টিভির শব্দ। চোখে ঝাপসা দেখলেও কানটা মোটামুটি ঠিক আছে। সে টিভি দেখেনা, তবে কানে সারাক্ষনই ভেসে আসে হিন্দী ছবির গান না হলে হিন্দী সিনেমার ডায়লগ।
কিন্ত আজ কি ব্যাপার বাংলা কথা, তার উপর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলছে মনে হচ্ছে ! অবাক কান্ড তো। কানটা একটু খাড়া করলো রাবেয়া বেগম ,রফিক বোধ হয় টিভি দেখছে। শুনতে পেলো কারা যেন আলোচনা করছে যুদ্ধের সময় যারা অপরাধ করেছিল তাদের বিচারের ব্যাপারে।
প্রায় সত্তরের কাছাকাছি বয়স চোখে না দেখা নিয়ে আর আফসোস নেই, যথেস্ট দেখেছে এই জীবনে। শুধু একটা ইচ্ছা ছিল যুদ্ধপরাধীদের বিচার দেখা, তা মনে হয় আর সম্ভব না।
একাত্তর সাল তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিনী রাবেয়া বেগম। স্বামী সাদেক হোসেন সরকারী অফিসের ছোটো খাটো চাকুরে। মোটামুটি স্বচ্ছল ভাবেই দিন চলে যেত। তখন তো মানুষের এত চাহিদাও ছিলনা আর এত মার্কেট দোকান ও ছিলনা। আর এখন বড় ছেলে রফিকের বৌকেই তো দেখা যায় প্রায় দিনই দুনিয়ার এটা ওটা হাবিজাবি কিনে আনছে। কিছু বলেনা রাবেয়া বেগম, দরকার কি ! এই অপচয় নিয়ে একদিন একটু আভাস দেয়ায় মুখ কালো করে ফেলেছিল। তখনও তার চোখ ভালো ছিল, তাইতো সে দেখেছিল তার অভিব্যক্তি।
টিভির আলোচনা কানে আসার সাথে সাথে রাবেয়া বেগমের মাথায় সেই একাত্তরের দিন গুলোর কথা মনে পড়তে থাকে। কি দিনগুলোই না কাটিয়েছিল সে সময় ! সেই ভয়াল একাত্তরের কথা ভাবলে সারা শরীরে এখনও কাটা দিয়ে উঠে।
সবাইকে নিয়ে সহি সালামতেই নয়টা মাস অনেক কস্টে পার করেছে। কাউকে হারাতে হয়নি, তার জন্য জায়নামাজ বিছিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে সে আজও শোকোর করে।
ঢাকা শহর তখন ছিল অনেক নিরিবিলি, এত দালান কোঠা ও ছিলনা।বেশীরভাগই কাঠের ফ্রেম করা লাল রঙের চাল দেয়া টিনের ঘর। সে সময় বড় রাস্তার একদম পাশেই ঐ রকম টিনের একটি বাংলো টাইপের বাসায় তারা থাকতো। বুক সমান দেয়াল ঘেরা বাসাটায় ছোটো একটা কাঠের গেট দিনরাতই খোলা থাকতো। সামনে বেশ বড় উঠোন। তাতে নানা রকম পাতাবাহার আর ফুলের গাছ। স্বামী আর বড় মেয়েটা দুজনেরই বাগান করার খুব শখ ছিল। আর ছিল সবার আদরের কুকুর টাইগার।
বড় মেয়ের বয়স তখন ষোলো ছুই ছুই আর ছোটো মেয়েটার দশ, ছেলেটা তখন ছয় বছরের। বাকী দুজন হয় স্বাধীনতার পরে।
সারাক্ষন ছেলেমেয়েদের আগলে রাখতো রাবেয়া বেগম। বাড়ীর সামনে রাস্তার ঐ পারেই খোলা মাঠ তার ঐ পাশেই পাক আর্মির ক্যাম্প ,মাঝে মাঝেই মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে আক্রমন করতো, দু পক্ষই গোলাগুলি বিনিময় হতো প্রচুর কিছুক্ষন পরেই আবার সব ঠান্ডা হয়ে যেত।
তখন অক্টোবার মাস, পরিস্কার মনে আছে রাবেয়া বেগমের কারন সে মাসেই ঢাকার অভিজাত এলাকার বাসিন্দা তার ভাসুরের বড় ছেলে পাশের বাড়ীর ধনাঢ্য পরিবারের এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল গভীর ভালোবাসা। কিন্ত সে সময় তো আর এখন কার মত ছিলনা যে বিয়ে করে এনে ঘরে তুলে বলবে "এ আমার মা, এ কে সালাম করো" ।
তাদের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে সারা ঢাকা শহরে এক ভয়ংকর শোরোগোলের সৃস্টি হয়েছিল।যার ঢেউ এসে লেগেছিল ছেলের প্রত্যেকটি আত্মীয়স্বজনের বাড়ীতে। কারন মেয়ের বাবা সেই ধনী ব্যাবসায়ীর বাড়ীতে ছিল পাক আর্মীর সব বড় বড় অফিসারের নিত্য আনাগোনা। মেয়ের ভাইরা মুহুর্তে মুহুর্তে এসে ধমক দিয়ে বলতো তাদের মেয়ে বের করে না দিলে তারা পাক আর্মি দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। এদিকে কেউই যানেনা তারা দুজন কোথায়!
ছেলের বাড়ীর লোকেরাও পাগলের মত দুই অপরাধীকে খুজে বেড়াচ্ছে তাদের হুমকির ভয়ে। সাদেক সাহেবের বাসাতে তার ভাইয়ের ছেলেরাও যখন তখন আসতো, এখানে কোনো খোজ পাওয়া গেলো কিনা জানার জন্য। তখনতো টেলিফোন এতো সহজলভ্য ছিলনা।
সেদিন রাত প্রায় দশটা হঠাৎ বাসার সামনে গাড়ী থামার শব্দ। রাবেয়া বেগমের স্বামী সাদেক সাহেব বলে উঠলো 'রাবেয়া মনে হয় আমার ভাইয়ের বাসা থেকে কেউ এসেছে' ! বলে একটানে দরজা খুলে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।দু পাশে তার দুই মেয়ে।
কি ব্যাপার ওরা বাইরে কি করছে এতক্ষন ধরে! ভাবতে ভাবতে রাবেয়া বেগম বারান্দায় এসে তার চক্ষু স্হির । এক পলকে তাকিয়ে দেখলো বাসার সামনে এক মিলিটারী কনভয় তাতে তিন চারটা সেনাবাহীনির ট্রাক বোঝাই পাক আর্মি দু পাশে সারি সারি বসে আছে হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে। আর সাদেক সাহেব দু হাতে দুই মেয়েকে ধরে ঘটনা আকস্মিকতায় পাথরের মত নিশ্চুপ দাড়িয়ে সেই খোলা বারান্দায়। রাবেয়া বেগম ঠান্ডা মাথায় তার স্বামী আর মেয়েকে এক ঠেলায় ঘরে ঢুকিয়ে বল্লো, 'ওখানে দাড়িয়ে কি করছো তোমরা!
ঘরে ঢুকে লাইট টা অফ করে দিল সে। আরো গাড়ী আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বুটের শব্দে বোঝা যাচ্ছে মিলিটারীরা নেমে আসছে ট্রাক থেকে। টাইগার অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছে। এক মিলিটারী এসে কাঠের দরজাটা ঠেলছে আর কুকুরটাকে চুপ করতে বলছে। কুকুর কি শোনে। ভয়ে আতংকে সবার হাত পা জমে যাবার অবস্হা।
এসময় কাজের ছেলে মিজান যে ২৫ শে মার্চের পর দুদিন পর্যন্ত মিরপুরের এক বাসার আলমারীতে লুকিয়ে থেকে স্বচক্ষে বিহারীদের হত্যাযজ্ঞ দেখেছিল। দেখেছিল তার মনিব ও তার পুরো পরিবারকে নৃশংস ভাবে হত্যা করতে।এই পরিস্হিতিতে আতংকগ্রস্ত মিজান জানালো 'খালাম্মা আমার খুব ভয় লাগতাছে, আমি আর এখানে থাকবোনা, আমি পিছের দেয়াল টপকে পালিয়ে আপনের বড় ভাইয়ের বাসায় যাই'।
কি ভেবে আতংকগ্রস্ত বড় মেয়ে লায়লা বল্লো 'মা আমিও মিজানের সাথে বড় মামার বাসায় চলে যাই'।
এত ধীর স্হির রাবেয়া বেগমের মাথায় তখন কিছুই কাজ করছিল না। সে শুধু ছোটো মেয়েকে বল্লো 'লায়লা একা যাবে! তুমিও যাও সাথে'।
পরে শুনেছিল মেয়েদের কাছ থেকে যে ওরা দেয়াল টপকে ও পাশের রাস্তায় উঠার সাথে সাথে আর্মিরা পিছনের রাস্তায় চলে আসতে শুরু করে।
বড় মামার বাসায় আর যাওয়া হয়ে উঠেনা। আর কোনো পথ না পেয়ে রাস্তার পাশেই গোয়ালাদের একটা বস্তি ছিল তার মধ্যে ঢুকতে গিয়ে লায়লার পা গিয়ে পড়লো গোবরের গাঁদায়। কোনো মতে একটা ঘরে ঢুকতেই শোনে সে পথেও নিশঃব্দ পদচারনা সেই হিংস্র হায়নাদের।
সেই বাড়ীর এক মহিলার দেয়া শাড়ী পড়ে চুপচাপ নিথর হয়ে বসে আছে গোটা বস্তির মানুষের সাথে ওরা তিনজন। রাস্তার সাথে লাগানো, ঘর কোনো বেড়া নেই, কিছু নেই।বেড়ার ভাঙা ফুটো দিয়ে লায়লা দেখেছে এক জোড়া স্বামী স্ত্রী কথা বলতে বলতে যাচ্ছে নিরুদ্বিগ্ন ভাবে কিন্ত দু পা এগোতেই ধরা পড়ে গেল ঐ নরপশুদের হাতে। শোনা গেল মেয়েটার আর্তচিৎকার।
মেয়েদের চিন্তায় রাবেয়া বেগমের তখন পাগলের মতন অবস্হা,সাদেক সাহেবেও বার বার 'বলছে তুমি কেন ওদের যেতে দিলে' ! একটু পর পর নারী পুরুষের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠছে আর রাবেয়া বেগম পাগলের মতন জায়নামাজে মাথা কুটছে। মরার সকাল আর হয়না। শুধু মনে হচ্ছে মিজানকে মেরে ফেলেছে আর তার মেয়ে দুটো ঐ নরপশুদের হাতে।
আস্তে আস্তে ফজরের সময় হয়ে আসলো মিলিটারীর সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। উকি দিয়ে দেখলো না কোনো আর্মির কনভয়গুলো নেই সব চলে গেছে।হটাৎ শোনে পেছনের দরজায় কে যেন আওয়াজ করছে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে ছোটো মেয়ে সেলিনা! মেয়েকে চোখের পানিতে ভেজা বুকে জড়িয়ে রাবেয়া বেগম চিৎকার করে উঠে " লায়লা কোথায়" ?
সেলিনা মায়ের বুকে মুখ গুজে চোখের পানি মুছতে মুছতে বল্লো 'মা আপু ভালো আছে, তুমি ওর কিছু কাপড় দাও বাসায় পরে আসার জন্য'।
পান বানাতে বানাতে এত বছর পরেও হিম হয়ে উঠে রাবেয়া বেগমের সারা শরীর, যখন পরদিন জানতে পারে তার নিজের দু মেয়ে বেঁচে গেলেও অনেক নিরীহ নারী পুরুষই সেদিন সেই নর পশুদের হাতে ধরা পরেছিল, যাদের আর কখোনোই খোজ পাওয়া যায়নি । জানা যায় তাদের পথপ্রদর্শক ছিল এলাকারই কুখ্যাত রাজাকার আলবদর বাহীনির সদস্য। তাদের বিচার কি সত্যি হবে বাংলার এই মাটিতে !