মাটির নীচের অন্ধকার কোন গহবর কিংবা কড়িডোর ধরে হেটে যাচ্ছেন। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। চারিপাশের বাতাস ভারী হয়ে আছে। আপনার মনে অজানা এক আশংকায় ধীরে ধীরে ভয় দানা বেধে উঠছে। এমন সময় একদম হঠাৎ করেই খুব যত্ন করে মমি বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হাজার হাজার মৃতদেহ রাখা এক প্রোকোষ্ঠে এসে হাজির হলেন আপনি। কেমন হবে আপনার মনের অবস্হা? অনেকেতো ভয়েই অজ্ঞান হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
কথাগুলো শুনে কোন ভৌতিক গল্প কিংবা সিনেমার অংশ মনে হলেও আসলেই এরকম কিছু বর্ণাতীত ভয়ঙ্কর অথচ দর্শনীয় এবং সুন্দর স্হান পৃথিবীতে আছে। প্রতিবছর অসংখ্য ট্যুরিষ্ট এ সমস্ত যায়গার বেড়াতেও যান। এরকমই আটটি স্হান বা শবদেহের অস্টমাস্চর্য্যের সাথে আজকে আমরা পরিচিত হব।
১) প্যারিস ক্যাটাকোমস (Paris Catacombs) : আলো ঝলমল প্যারিস শহরের ভুগর্ভস্হ এই ক্যাটাকোমস গুলি পৃথিবীর সবচাইতে বড়, সবচাইতে জনপ্রিয় এবং সর্বাধিক পরিচিত শবাধার। মাটির উপরের বাসিন্দাদের তুলনায় মাটির নিচের বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় তিনগুন বেশী, যার সংখ্যা হলো ৬ মিলিয়ন। ১৮ শতাব্দীতে প্যারিস শহরের কবরস্হানগুলো যখন আর যায়গা সংকুলান করে উঠতে পারছিলো না তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই কঙ্কালগুলোকে ভূগর্ভস্হ টানেল গুলোতে স্হানান্তর করা হবে। প্রথমে শুধু হাড়গোড় গুলোকে লেবেল দিয়ে স্তুপাকারে ফেলে রাখা হয়। পরে কতৃপক্ষ বুঝতে পারেন এগুলোকে খুব সহজেই দর্শনীয় আকর্ষণ হিসাবে পরিণত করা সম্ভব। ফলশ্রুতিতে হাড়গোড় গুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে আকর্ষনীয় কিন্তু গা ছমছমকরা দেয়ালে পরিণত করা হয়।
২) সেডলেক অসুয়ারী, কুন্টা হোরা, চেক রিপাব্লিকঃ সেডলেক শবাধার নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর এবং দৃষ্টি নন্দন শবাধার। এটি হাড়ের গীর্জা নামেও পরিচিত। কুন্টা হোরা শহরের একপ্রান্তে অবস্হিত। চল্লিশ হাজারেরও বেশি মানুষের হাড়গোড় দিয়ে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের গীর্জাটির এই আকর্ষণীয় ডিসপ্লে তৈরী করা হয়েছে। ১২৭৮ সালে হেনরী নামের এক পাদ্রী যিশূ খ্রীষ্ঠের কবরস্হান পরিদর্শন শেষে সেখানকার কিছু মাটি সাথে করে নিয়ে আসেন এবং সেডলেক গীর্জার কবরস্হানে ছড়িয়ে দেন। তৎক্ষণাতভাবে বিশ্বাসীদের কাছে এটা হয়ে পরে এক পবিত্র কবরস্হানে এবং হিড়িক পরে যায় এই জনপ্রিয় কবরস্হানে কবর দেয়ার জন্য। ফলে কবরস্হানের স্হান সংকুলান না হওয়াতে ১৫১১ সালে পুরোনো মৃতদেহগুলোকে তুলে নতুন মৃতদেহের জন্য যায়গা করা শুরু হয়। ১৮৭০ সালে ফ্রান্টিসেক রিন্ট নামে এক কাঠের কারুকাজ মিস্ত্রীকে দায়িত্ব দেয়া হয় হাড় গুলোকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দেয়ার জন্য। পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর এবং আকর্ষনীয় হাড়ের প্রদর্শনী সৃষ্টি করে রিন্ট প্রমাণ করে যে সে আসলেই একজন সত্যিকারের শিল্পী। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতিটিতে মানুষের দেহের সবগুলা হাড়কে ন্যুনতম একবার হলেও ব্যবহার করা হয়েছে।
৩) সান্টা মারিয়া ডেলা কন্সিজিয়োন, রোম, ইটালীঃ পৃথিবীর সব মানুষ যে মৃত্যুকে ভয় পায়না তার একটি প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হলো ইটালির রোম শহরের সান্টা মারিয়া ডেলা কন্সিজিয়োন গীর্জা। চার হাজারেরও বেশী ক্যাপুচিন খ্রীষ্ঠান ভিক্ষুর মৃতদেহকে অত্যন্ত আকর্ষনীয় ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কিছু কিছু মৃতদেহে পাদ্রীদের পরিপূর্ণ পোষাকে পরিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে বেশিরভাগেরই হাড়গোড়কে আলাদা করে শৈল্পিক উপায়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
৪) ব্রনো অসুয়ারী, সেইন্ট জেকব স্কয়ার, চেক রিপাব্লিকঃ সেইন্ট জেকব স্কয়ারের মাটির নিচের ব্রনো শবাধার পৃথিবীর দ্বীতিয় বৃহত্তম শবাধার। প্রায় ১৬০০ বছরের পুরোনো এই শহরে খনন কার্য চালানোর সময় ২০০১ সালে এই শবাধারটি আবিষ্কৃত হয়। ৫০ হাজারেরও বেশী মৃতদেহ ভূগর্ভস্হ এই চ্যানেলে পাওয়া যায়। প্রথমে স্তুপাকারে সাজিয়ে রাখা হলেও পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় শবাধারটিকে পুনঃস্হাপন করে দর্শনীয় স্হানে পরিণত করা হবে। সেই উদ্দেশ্যে হাড়গোড় গুলিকে শহরের কতৃপক্ষ নতুন করে সাজিয়ে রাখার পরিকল্পনা নেন। এ বছরই (২০১১) সেটা সবার জন্য খুলে দেবার পরিকল্পনা আছে কতৃপক্ষের।
৫) ক্যাপেলা ডোস ওসোস, ইভোরা, পর্তুগালঃ পর্তুগালের ইভোরা শহরের সেইন্ট ফ্রান্সিসকান গীর্জার ঠিক পাশেই অবস্হিত হলো ক্যাপেলা ডোস ওসোস বা হাড়ের চ্যাপেল। ১৬ শতাব্দীতে কিছু ফ্রান্সিসকান মঙ্ক আশে পাশের ৪২টি কবরস্হানের উপচে পড়া লাশ দিয়ে তৈরী করেন হয় এই চ্যাপেলটি। চ্যাপেলের ভিতরের
দেয়াল এবং পিলারগুলি ৫০০০ হাজারেরও বেশি মানুষের হাড় এবং মাথার খুলি দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
Click This Link style='border: 1px solid #ccc;align:center;clear:both;' />
৬) করোটি চ্যাপেল, Czermna, পোল্যান্ডঃ পোল্যান্ডের খুলির চ্যাপেলের ইতিহাস এর প্রদর্শনীর মতই মজার। ১৭৭৬ এবং ১৮০৪ সালের মধ্যে সিঝেরনা এলাকায় এক চেক পাদ্রী এবং স্হানীয় পোলিশ গোর খোদক দীর্ঘ সময় ধরে আশে পাশের গণ কবর থেকে মৃতদেহ তুলে নিয়ে আসেন। তারপর আকর্ষণীয় মনে হওয়া মাথার খুলি গুলোকে তারা আলাদা ভাবে সরিয়ে রাখেন। যেমন মাথায় গুলির আঘাত আছে, বা বিশেষ কোন রোগে মারা গেছে, অথবা রাজনীতিবিদ ইত্যাদি। তারা দুজনে মিলে প্রায় ২৪ হাজার মৃতদেহ তুলে নিয়ে আসে। এদের বেশিরভাগই মাটির ১৬ ফুট নিচে এক গহবরে রাকা আছে। আর প্রায় ৩ হাজারের মত কঙ্কাল এই চ্যাপেলটিকে শোভামন্ডিত করেছে।
৭) করোটি টাওয়ার, নিস, সার্বিয়াঃ সার্বিয়ার করোটি টাওয়ার হলো একমাত্র হাড়ের সংগ্রহ যা নির্মাণ করা হয়েছিলো মানুষকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। ১৮০৯ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের আশায় যুদ্ধরত সার্বিয়ান বিদ্রোহী সৈন্যরা হেরে যায়। এই পরাজয় তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছিলো। তুর্কী সেনাবাহিনির কমান্ডার এই সৈন্যদের মাথা কেটে নিয়ে সেগুলো এই টাওয়ারে ঝুলিয়ে রাখে। উদ্দেশ্য ছিলো সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সবার মনে ভয় প্রবেশ করানো। এক সময় ৯৫২ টি খুলি এই প্রদর্শনির অন্তর্ভূক্ত ছিলো। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৫৮টি টিকে আছে। পরবর্তিতে টাওয়ারটিকে রক্ষা করার জন্য একটি চ্যাপেল তৈরী করা হয়। আর এখন এই টাওয়ারটি সেইসব সাহসী স্বাধীনতা কামী সার্বদের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসাবে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে।
৮) পালের্মো ক্যাটাকোম, ইটালী: ৮০০০ শবদেহের মামি দিয়ে সাজানো পালের্মো ক্যাটকোমসের কড়িডোরগুলো সাজানো হয়েছে। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম একটি গা ছমছম করা স্হান এটি। নিচের ভিডিওটি দেখলেই অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে বলাই বাহুল্য। তাই হার্ট দূর্বল হলে না দেখাই ভালো। পালের্মো ক্যাটাকোমসের সবচাইতে আকর্ষনীয় দ্রস্টব্য হলো দুই বছরের রোজালিয়া লোম্বারডোর মামিটি। ১৯২০ সালে দুই বছরের রোজালিয়াকে তার পরিবারের সদস্যরা নিয়ে আসে মামি করার জন্য। আজও তার দেহটি প্রায় অবিকৃত অবস্হায় রয়েছে যা কিনা একটি রহস্য।
ভিডিও লিঙ্কঃ পালের্মো ক্যাটাকোমস