আরাদিয়া এবং প্রাচীন ইতালির ডাকিনীবিদ্যা নিয়ে আমার আগের দুইটি লেখাতে Charles Leland এর Gospel of the Witches থেকেই সব কিছু সরাসরি বর্ণনা করেছি। তাই সেই পর্বগুলোতে শুধু একটি বিলুপ্ত ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কেই জানা হয়েছে। প্রথম পর্বের বিষয় ছিলো ধর্মের মূলকথা, যেখানে পৃথিবীর সৃষ্টি বা দেবদেবীদের ক্ষমতা নিয়ে তখনকার ডাইনীদের বিশ্বাস উঠে এসেছে। এর পরের পর্ব ছিলো ঐ গসপেলেরই দ্বিতীয় খণ্ডের উপর, যেখানে মধ্যযুগীয় ইতালির তন্ত্র মন্ত্র আর যাদুবিদ্যার বিভিন্ন পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই ধর্মের অনুসারীদের কথা বা ইতিহাসের মানদণ্ডে এই গ্রন্থের সত্যতা কতটুকু সেটা যাচাই করার সুযোগ আগে হয় নি। াই ইতিহাস আর ধর্মতত্ত্ব আরাদিয়া সম্পর্কে কি বলছে সেটা জানানোর জন্যেই এই পর্বের অবতারণা।
আসলে লেইল্যান্ড ডাইনীদের গসপেলটি লোকসাহিত্য হিসেবে প্রকাশ করলেও গবেষকদের মাঝে তখন থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত হয় এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। ইনকুইজিশনের ইতিহাস হাজার হাজার ডাইনীকে পুড়িয়ে মারার সাক্ষ্য দিলেও এই ডাকিনীবিদ্যা যে একটা সুসংঘটিত ধর্ম বা তাদের যে একটি ধর্মগ্রন্থ আছে, তা আগে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেন নি কেউ। তবে যখন এর সত্যতার ব্যাপারে যখন মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেলো, তখন আরাদিয়া নামের এই রহস্য রমণীর খোজ নিতে ইতিহাসবিদদের কাছে দ্বারস্থ হতেই হচ্ছে আমাদের।
আরাদিয়া নামটি অবিকৃত ভাবে ইতিহাসের পাতায় খুঁজে কোথাও পাওয়া যায় নি, এজন্য লেইল্যান্ড নিজেও সন্দেহ করেছেন নামটি উচ্চারণে হয়তো বিকৃতি ঘটেছে। অনেকের মতে ইউরোপের ইতিহাসের আলোচিত চরিত্র হেরোদিয়াস-ই আসলে এই কথিত ডাইনীদের গুরু আরাদিয়া, যিনি গসপেল অফ ম্যাথ্যুর বর্ণনা অনুযায়ী রাজা হেরদ এর শ্যালিকা এবং তার ভাই ফিলিপ এর স্ত্রী। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট এর উপর এই হেরেদিয়াসের ছিলো তুমুল ক্রোধ। এবং রাজা হেরদ কে তিনি-ই উৎসাহিত করেছিলেন জন কে যেন দেশান্তরী বা হত্যা করা হয়। ইতালিতে হেরেদিয়াস পরিচিত ছিলেন এরোদিয়াদে (Erodiade) নামে, যেটা উচ্চারনগতভাবে আরাদিয়ার খুব কাছাকাছি।
অনেকের মতে রানী হেরেদিয়াসই আসলে আরাদিয়া
হেরোদিয়াসের আরাদিয়া হয়ে উঠার প্রমাণ হিসেবে দাড় করানো হয় তখনকার ধর্ম যাজকদের কিছু চিঠিপত্র আর দলিলকে। ভেরেনার বিশপ এই ব্যাপারে এক জায়গায় লিখেছেন, “অনেকেই বিশ্বাস করে রানী হেরেদিয়াস আসলে একজন দেবী, পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ যার অধিকারে আছে।” এছাড়া তখনকার চার্চের দলিলে অনেক নারীদের উল্লেখ পাওয়া যায় যারা রাতের বেলায় বের হয়ে ডাকিনীবিদ্যা চর্চা করতেন। চার্চ সব ক্ষেত্রেই দলিলে তাদের ডায়ানা আর হেরেদিয়াসের অনুসারী হিসেবে চিনহিত করেছে, আর ডাইনী আখ্যা দিয়ে তাদের উপর নানা প্রকার নির্যাতন করে গেছে। ম্যারি ম্যাগদালিনকে বেশ্যা আখ্যা দেয়া, আর জোয়ান অফ আর্ককে পুড়িয়ে মারা চার্চ অপবাদ আরোপ করেছিলো এই নারী ধর্মগুরুর উপরেও। প্যারিসের রাস্তার যৌনকর্মীদের তখন ডাকা হতো ‘হেরেদিয়াসের মেয়ে’ বলে।
আরাদিয়ার মা হিসেবে চন্দ্রের দেবী ডায়ানার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে রোমান দেবী সেলেনি আর হেকাত এর সাথে বেশ মিল পাওয়া যায়। এদের তিনজনই রাতের অন্ধকারে আবির্ভূত হতেন এবং ডায়ানার মতোই অনুসারীদের মাঝে ডাকিনীবিদ্যার প্রসার ঘটাতেন। এছাড়া প্রাচীন ইতালির লোকসাহিত্যের পাতায়ও কখনো ডায়ানা, কখনো ম্যাডোনা বা কখনো তানা নামে চন্দ্রদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এই ধর্মকে ঐ এলাকার মানুষের মাঝে বিশ্বাসযোগ্য করতে অবদান রেখেছে।
দেবী আরাদিয়ার মূর্তি
দ্বাদশ শতাব্দীর পর থেকেই এরকম একটি বিশ্বাস মানুষের মাঝে বদ্ধমূল শুরু করে যে গভীর রাতে কিছু অশরীরী আত্মা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। এমনকি চাইলে তারা বাড়ীর দরজায় থাকা চাবির গর্ত দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। সেই বাড়ীতে যদি পর্যাপ্ত খাবার মজুদ না থাকে, বা তা যদি অগোছালো হয় তাহলে তারা ঐ বাড়ির গেরস্তকে অভিশাপ দেয়। অপরপক্ষে যদি পর্যাপ্ত খাবার আর গোছানো বাড়ী হয় তাহলে তাদের আশীর্বাদ এক বছরের জন্য সৌভাগ্য নিয়ে আসে সেই গেরস্তের জন্য।
আবার আরেক রকম বিশ্বাস ছিলো তান্ত্রিকদের নিয়ে, এরাও নাকি রাতের বেলা মানুষের ঘরে ঢুকতো আর কাউকে পেলে তার রক্ত পান করতো এবং আত্মাকে বের করে নিয়ে যেতো। এদের কুনজর থেকে বাঁচতে তখন বিভিন্ন প্রকার সাবধানতা অবলম্বন করা হতো। এই দুই দলের বাইরে ডাইনীদের আর একটি দল ছিলো যারা জানারা নামে পরিচিত ছিলো, এরা ডাকিনীবিদ্যায় আরাদিয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করতো। জানারাদের সম্পর্কে যা জানা যায়, তারা লোকালয়ের বাইরে পাহাড়ের গুহা বা গহীন জঙ্গলের ভেতর তাঁবু খাটিয়ে বাস করতো। তবে নির্জনে বাস করলেও এরা একেবারে লোকালয় বর্জিত ছিলো না, মাঝে মাঝেই শহরে প্রবেশ করতো। অনেকে আবার দীক্ষা শেষ করে লোকালয়ে এসে বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতো।
ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ মনে করেন আসলে প্যাগান পূর্ব ভেষজ ঔষধ বিদ্যা, প্রাচীন লোককাহিনী আর ডাইনীদের পুরনো দেবদেবীদের গল্পগুলোর উপর ভর করেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো এই ধর্মমতটি। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলো সাধারণ মানুষের চার্চের অনাচারের প্রতি চরম অনাস্থা। তবে হেরেদিয়াসের সাথে আরাদিয়ার যতই মিল থাকুক সময়ের পরিক্রমায় তাদেরকে একসাথে মেলানো বেশ কষ্টসাধ্য। অনেক গবেষকই তাই সেই পথ না মাড়িয়ে আরাদিয়াকে পৃথক নারী হিসেবে চিত্রিত করেছেন।
ইতিহাসবিদদের কচড়া শেষে এবার আমরা চোখ রাখবো ধর্মতত্ত্বের উপর, ধর্মতাত্ত্বিকরা কি বলেন আরাদিয়া সম্পর্কে? তাদের মত অনুসারে, মধ্যযুগের বিভিন্ন সময় একাধিক নারী নিজেকে আরাদিয়া হিসেবে দাবী করেছেন। তবে ডায়ানার কন্যা হোন আর না-ই হোন, ডাকিনীবিদ্যার গুরু হিসেবে এরকম একজন নারী মধ্যযুগে ইতালিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এটা সত্য। অনুসারীদের দাবী অনুযায়ী ১৩ই অগাস্ট ১৩১৩ সালে ইতালির ভোল্টেরা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই নারী। শৈশবেই ভোল্টেরা ছেড়ে আলবান পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী নেমি শহরে বসতি গড়ে তার পরিবার। এর পর জীবনের কোনও একটা পর্যায়ে তিনি আধ্যাত্মিকতার সন্ধান পান এবং অনুসারীদের নির্জনে ডাকিনীবিদ্যার দীক্ষা দিতে শুরু করেন।
আরাদিয়া এবং ডাকিনীবিদ্যার জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করলে, এবং মানুষজনের ভেতর চার্চ ও খ্রিষ্ট বিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়লে চার্চ একটা পর্যায়ে আরাদিয়াকে আটক করে। বন্দী অবস্থায় বিচারের মাধ্যমে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, কিন্তু প্রহরা সত্ত্বেও এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগের রাতে তিনি জেলখানা ছেড়ে পালিয়ে অনুসারীদের কাছে ফিরে আসেন। এর কিছুদিন পর চার্চ-পন্থীদের হাতে তিনি আবার আটক হন, এবং আবারও মৃত্যুদণ্ডের আগেই পালিয়ে আসতে সমর্থ হন। বিচার চলাকালীন সময়ে চার্চের উদ্দেশ্যে করা তার একটি উক্তি এরকম,
“I rebuke you, and I cast you out from the people because you teach punishment and shame to those who would free themselves from the slavery and the Church. These symbols and apparel of authority which you bear serve only to hide the nakedness in which we are all equal. You say that you serve your God, but you serve only your own fears and restrictions.”
আরাদিয়া তার সমস্ত অনুসারীদের তিনটি ভাগে বিভক্ত করে এই বিদ্যার চর্চা করতেন। এদের মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের কথা ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত করেছেন জানারা বা জারা, যাদের সাধনা আর জ্ঞানের বিষয় ছিলো চন্দ্র। চন্দ্রের অবস্থান আর প্রভাব সম্পর্কিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তারা সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করতেন। সিদ্ধি লাভ বলতে বোঝানো হয়েছে আরাদিয়ার প্রতিশ্রুত বারোটি ক্ষমতা অর্জন। বাকী দুইটি সম্প্রদায় হলো তানারা আর ফানারা, যাদের সাধনার বিষয় ছিলো যথাক্রমে তারকা আর পৃথিবী। পরবর্তীকালে তানারা থেকে বের হয়ে এসে একদল চতুর্থ সম্প্রদায় গঠন করে যারা আরাদিয়ান নামে পরিচিত, এরা এই ত্রি-বিভাজন নীতির বিরোধী এবং সমস্ত অনুসারীর ঐক্যে বিশ্বাসী।
আরাদিয়ার ধর্মীয় প্রতীক
দ্বিতীয়বার আটক অবস্থা থেকে পালিয়ে আসার পর আরাদিয়া তার সমস্ত অনুসারীদেরকে জড়ো করে বারোটি বিষয়ে তাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বদ্ধ করেন। এগুলোকে আরাদিয়ার কোভেনেন্ট বলা হয় সেগুলো হলো,
>ত্রিযুয়েন্ডা সহ সকল ধর্মীয় আচারে অংশগ্রহণ করবে, এগুলোই সকল ক্ষমতা প্রাপ্তির মূলসূত্র।
>যখন তোমার প্রতি কেউ সদাচরণ করে তখন সদাচরণের মাধ্যমেই তার প্রত্যুত্তর দিও। আর তোমার সদাচরণের ফলে কেউ কৃতজ্ঞতার বশে তোমাকে ধন্যবাদ দিলে তাকে অন্যদের প্রতি এরকম আচরণ করে এই ঋণ শোধ করতে বলে দিও।
>গুপ্তবিদ্যা ধ্বংশাত্বক বা মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনও কাজে ব্যবহার করবে না।
>নেহাত প্রাণ বাঁচানোর জন্য না হলে কোনও প্রাণীর প্রাণ সংহার করবে না।
সম্মান বা প্রশংসা জানাতে কখনো কার্পণ্য করো না।
>একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া তোমার আর কোনও প্রভু থাকবে না। তুমি যদি দাস হয়ে থাকো তাহলে মনিবের কর্তৃত্ব অস্বীকার কর, আর মনিব হয়ে থাকলে দাসদের মুক্ত করে দাও।
>এই প্রাচীন ধর্মের যারা অনুসারী আছো, তারা দীক্ষালাভে একে অপরকে সহায়তা করো।
>আরাদিয়া ছাড়া অন্য কোনও প্রকার ধর্মমতের উপর বিশ্বাস রাখবে না, আর এই নিয়ে তর্কেও লিপ্ত হয়ো না। শান্তভাবে নিজের বিশ্বাসের কথা জানিয়ে দেবে, আর শান্তি বজায় রাখবে।
>জেনেশুনে কারো কোনও ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত হয়ো না।
আশেপাশের মানুষদের সাথে হৃদ্যতা আর সহমর্মিতার সম্পর্ক বজায় রাখবে।
>নিজের লব্ধ জ্ঞানের উপর আস্থা রাখবে, যা নিজের জন্য ভালো মনে করবে তা করবে যাকে ক্ষতিকর মনে হবে সেটা পরিত্যাগ করবে। প্রকৃতির সাথে সুষম সহাবস্থান-ই এই ধর্মের মূল আদর্শ।
>তোমার স্রষ্টার প্রতি নিষ্ঠাবান আর সৎ থেকো, যে তোমাকে এবং তোমার ভাই বোনদের সৃষ্টি করেছেন।
অনুসারীদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করার পর আরাদিয়া অজ্ঞাত গন্তব্যে রওনা হন। বলা হয়ে থাকে তিনি পূর্ব দিকের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে চলে যাওয়ার পরও চার্চ বিরোধী এই নারীর প্রভাবে ভালোভাবেই ভুগেছে তখনকার চার্চ। প্রায় দুইশত বছর ধরে প্রচলিত ধর্মমতের সাথে লড়াই করার পর এই ধর্মমতের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয় ইনকুইজিশনের মাধ্যমে। কথিত আছে এই ভয়াবহ ধর্মীয় আদালত সেসময় প্রায় চল্লিশ হাজার ডাইনীকে পুড়িয়ে হত্যার আদেশ প্রদান করেছিলো আর প্রায় সমসংখ্যক নারীকে ক্ষমা প্রার্থনা করার শর্তে ‘পবিত্র’ করেছিলো। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যযুগে ইউরোপের বুকে আর কখনোই মাথা তুলে দাড়াতে পারেনি চন্দ্রদেবীর পূজারীরা।
আরাদিয়া বিষয়ে আগের দুইটি লেখা:
আরাদিয়া: ডাইনীদের গসপেল
আরাদিয়া: মধ্যযুগের ডাইনীরা এবং তাদের ধর্মবিশ্বাস
(মূল লেখাগুলো উইন্ডচাইম ব্লগে প্রথমে প্রকাশিত হয়েছে)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৩