২৯ মার্চ, ২০০৭ প্রত্যুষে একখানা কালো ব্যাগ এবং নগদ ২৯৮০ টাকা লইয়া স্ব-বাটী ত্যাগ করিয়া ভাগ্যান্বেষী ভদ্রলোকের ন্যায় শকটে চড়িয়া বসিলাম রাজধানী পৌঁছাইবার অভিপ্রায়ে। চাকুরি করিব, মাইনে পাইব-অতঃপর পিতা-মাতার মুখে হাসি ফুটাইব। পূর্বনির্ধারিত নির্ঘন্ট অনুযায়ী রাজধানীতে পৌঁছাইয়া পরোপকারী বন্ধু রাজিব গং এর অবিবাহিতদের নিবাসে উঠিলাম। আমার জীবিকা নির্বাহের যুদ্ধের এই অংশখানি আরও শত শত মানুষের জীবনের ন্যায় আটপৌঢ়ে এবং আর কাহারো সহিত মিলিয়া গেলে তা মোটেও অনভিপ্রেত কাকতাল নহে। বাস্তব।
যাহা হউক, প্রারম্ভ সহজ হইলেও, দিনে দিনে তাহা নির্মম হইয়া উঠিতে বিলম্ব করেনাই। প্রত্যহ প্রত্যুষে উঠিয়া 'চাকুরির খবর' নামক পত্রিকা কিনিতাম ও ভাগ্য ফিরাইবার উপায় খুঁজিতাম। দুপুর হইলে পরিচিত বন্ধু-ভ্রাতা'র কর্মস্থলের সম্মুখে যাইয়া তাহাদিগকে ডাকিতাম, চাকুরি'র জন্য জীবন বৃত্তান্ত হস্তে দিয়া সুযোগের অনুরোধ করিতাম এবং সেই সাথে দিবসের আহার করিবার সুযোগ বাগাইয়া লইতাম। অপরাহ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কড়ইতলায় বসিয়া বন্ধুদ্বিগের সহিত ক্রীড়াকৌতুকে মত্ত হইতাম। বৈকালিক ফলাহারও সম্পন্ন হইতো। পকেটের টাকা পকেটেই থাকিয়া যাইতো এবং রাত্রিতে বিদায় লইবার পর পদব্রজে ঘরে ফিরিতাম। অনভিপ্রেত ব্যয় হইতে আপনাকে সম্বরণ করিতাম-শাসন করিতাম।
ইত্যবসরে দ্বি-সপ্তাহকাল চলিয়া গিয়াছে। ২৯৮০ টাকা ধীরে ধীরে তলানীতে আসিয়া পৌঁছাইয়াছে। কী করিব, কী খাইবো-ভাবিয়া মস্তকের কুন্তল ছিঁড়িবার উপক্রম! বিচলিতের ন্যায় সমস্তদিন আপিসপাড়ায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম এবং কর্মখালির বিজ্ঞাপণ খুঁজিতাম। আপিসপাড়ার এইসকল সম্ভ্রান্ত দালানসমূহের একটাতেও আমার জন্য একখানা কেদারা আর জীবিকার নিমিত্ত কোন কর্মের সংস্থান নাই ভাবিয়া কদাচিৎ অন্যের অজ্ঞাতে অশ্রু মুছিতাম। এ বড় কঠিন সময়!
এই সময় অবতারের মত বন্ধু 'রানা পৈতা' আসিয়া কহিল, তাহার নিকট একখানা চাকুরির সন্ধান রহিয়াছে। সপ্তাহে ছয়দিবস আপিস করিতে হইবে। পাঁচহাজার টাকা মাইনে। পদবীঃ বিপণন কর্মকর্তা। ভাবিলাম, আকালের বাজারে তাহাই বা কম কিসে? খাইয়া পড়িয়া বাঁচিবার মতো কিঞ্চিৎ অর্থের সংস্থান তো হইবে! চাই কি পিতামাতাদ্বিগকেও ইহা হইতে কিঞ্চিৎ অর্থ বাঁচাইয়া পাঠানো যাইবে। হৃষ্টচিত্তে রাজী হইয়া গেলাম। যথানিয়মে একদিন সাক্ষাৎকার প্রদান করিলাম এবং ৭ এপ্রিল, ২০০৭ পূর্বাহ্নে কর্মস্থলে যোগদান করিলাম।
ভাগ্যবিধাতা তাহার চাকাখানি আমার অনুকূলে সামান্য ঘুরাইলেও তাহা বোধ করি প্রতুল ছিল না। আমি যেই স্থানে আশ্রয় লইয়াছিলাম, সেই স্থান হইতে আমার কর্মস্থলে যাইতে প্রত্যহ ৪০ টাকা খরচ হইত'। হিসাব কষিয়া দেখিলাম, যাতায়াত বাবদ আমার মাসিক খরচ দাঁড়াইতেছে ২০৮০ টাকা। হেন খরচে, আমি খাইবো কি আর পিতামাতাকে খাওয়াইবো কি? এ যেন এক নতুন উৎপাতের ন্যায় আমার সম্মুখে হাজির হইল!
অগত্যা বন্ধুর রোষকষায়িত নয়ন, ভালোবাসার অধিকার, আশ্রয় সমস্তকিছু উপেক্ষা করিয়া, বাহান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি'র একটিতে সস্তায় ঘর লইয়া আশ্রয় লইলাম-যেইখান হইতে পদব্রজে কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়া যায়। হরিপদ কেরাণির ন্যায় ছয়তলা বাড়ির-একতলা ঘর; যেইখানে বৃষ্টি হইলেই কাঁথা কম্বল শিকেয় তুলিয়া পানি সরিয়া যাইবার অপেক্ষা করিতে হয়।
বৃষ্টির তুমুল প্রবাহের সহিত আপোষ করিয়া এইখানে প্রায় দণ্ডায়মান অবস্থায় প্রথম রজনী অতিবাহিত করিলাম।
(চলিবে...)