সালটা ১৯৯৩। জানুয়ারি মাস।
ক্লাস সিক্সে উঠেছি মাত্র। আমার যাবতীয় দুষ্টামি এবং ক্লাস ফাইভের বৃত্তি-র প্রতি পূর্ণ সম্মান দেখিয়ে আমার জন্য একজন গৃহ শিক্ষক রাখা হলো। সে সময়ে ৫০০ টাকা মাইনে দিয়ে শিক্ষক দম্পতি’র ঘরে গৃহ শিক্ষক রাখাটা অনেকটা ঘোড়া রোগের মতই ছিলো। যাই হোক, সরকারী বৃত্তিপ্রাপ্ত ছেলের জন্য রোগী হতেও বাবা-মা’র আপত্তি নেই।
স্যার প্রথম পড়াতে এলেন বৃহস্পতিবার।
ঘরে ঢুকেই ঘোষণা দিলেন, আমি বিষ্যুতবারে বিজ্ঞান পড়াই।
আমি বিজ্ঞান বই হাতে নিয়ে স্যারের মুখোমুখি বসলাম। স্যার উনার রংচটা মলিন কোটের পকেট থেকে বের করলেন একটা কাঁচের গ্লাস, একটা ছোট মোম, একটা ম্যাচ, আর একটা ফিল্টার পেপার। স্যার বললেন, যাও, এক বাটি পানি নিয়ে আসো। উনার কাণ্ডকারখানা দেখে আমি বেশ মজা পাচ্ছি। ভাবছি, গৃহশিক্ষকের বদলে আব্বা-আম্মা একজন জাদুকর নিয়ে এসেছেন। আমার হাসি আকর্ণবিস্তৃত। এইতো চাই! গৃহশিক্ষক নামক প্রজাতিটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো। আমি এক দৌড়ে এক গামলা পানি নিয়ে এলাম।
টেবিলের উপর গামলাটা রাখতেই, স্যার বললেন, ‘আগুন যে মানুষের মতো শ্বাস নিতে পারে জানো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘না’।
স্যার বললেন, ‘অক্সিজেন ছাড়া আগুন বাঁচতে পারেনা। বাতাস না থাকলে আগুন টিকেনা। সেইটাই এখন পরীক্ষা কইরা দেখামু তোমারে। যদিও কথাগুলা বইতে লেখা আছে, তবে বিজ্ঞান পড়ার জিনিস না, বোঝার জিনিস। প্র্যাকটিক্যাল দেখার জিনিস।‘
স্যার মোমবাতিটা একটা স্ট্যান্ডের উপর সেট করে স্ট্যান্ড সমেত গামলার পানিতে রাখলেন। মোমবাতিতে আগুন ধরালেন। তারপর কাঁচের গ্লাসটা সেই মোমবাতির উপর উপুর করে রাখলেন। গ্লাসের খোলামুখ পানির নিচে।
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। একসময় দেখতে পেলাম, গ্লাসের ভেতরে মোমের আগুনটা টিমটিমে হতে হতে নিভে গেলো, এবং গ্লাসের ভেতরটা সাদা ধোঁয়ায় ভরে গেলো।
স্যার বললেন, ‘দেখ, গ্লাসের ভেতরে যতক্ষণ বাতাস ছিলো, ততক্ষণ আগুন জ্বললো। যেই বাতাসটা আগুনে পুইড়া শেষ হইয়া গেলো, সাথে সাথেই আগুন নিভা গেলো। আর ভিতরে যে সাদা ধুমা’টা দেখতাছো, ঐটা হইলো কার্বন ডাই অক্সাইড-যা আমরা নিশ্বাসের সাথে ছাড়ি।‘
‘এর থেকে আমরা শিখলাম কি? শিখলাম, অক্সিজেন ছাড়া আগুন জ্বলেনা। কার্বন ডাই অক্সাইড থাকলে আগুন জ্বলেনা। জীবনে ভুলবা?’
আমি মাথা নাড়লাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ‘না, ভুলবো না’।
ইনি আমাদের দ্বিগেন স্যার। বাবু দ্বিগিন্দ্র মোহন সাহা (বিএসসি এম এড)। প্রাক্তন সহকারী শিক্ষক, প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক-ঘাটাইল গণ উচ্চ বিদ্যালয়।
সেই দিন থেকে পুরো মাধ্যমিক স্কুল জীবন স্যারের কাছে পড়েছি। তিনি ইসলাম ধর্ম সহ সব সাবজেক্ট পড়াতেন। আরবী উদ্ধৃতি দিতেন। উচ্চতর গণিতের কঠিন কঠিন অংক করে ফেলতেন মুখে মুখে। ত্রিকোণমিতি করাতেন উনার বাসার সুপারি গাছের ছায়া দেখে দেখে। বিজ্ঞান বইয়ের ‘এসো নিজে করি’ অংশটুকু তিনে নিজে করে দেখাতেন। আর পড়াতেন সাধারণ জ্ঞান। স্যার বলতেন, ‘পৃথিবীরে না জানলে বাঁইচা থাইকা লাভ নাই। যা কিছু জানার আছে, জাইনা নেও, বাঁচার আনন্দ উপভোগ করতে পারবা’। উনার তদারকীতেই শিশু একাডেমী’র সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় মফস্বলের স্কুল থেকে অংশগ্রহণ করেও জাতীয় পর্যায়ে রানার আপ হই। মনে আছে, স্যার সেদিন আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন।
এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার পরে স্যার আমাদের ক্লাসের সবাইকে বললেন, ‘বাবা’রা, এই সময়টা খুব ইম্পরট্যান্ট। ক্লাস-টাস সব সাসপেন্ড। ডাব্বা মারার সুবর্ণ সুযোগ। কিন্তু আমি তা হইতে দিমুনা। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত আমি তোমাদের পড়ামু। তবে কেউ যদি ক্লাস মিস দেও, তবে তার পরীক্ষা দেওন লাগবোনা।
গভীর রাতে স্যার বাসায় এসে দরজায় নক করতেন। দরজায় দাঁড়িয়েই হুঙ্কার দিতেন, ‘এই ফাঁকিবাজ, পড়ার সাউন্ড পাইনা ক্যান? পিটাইয়া ছাল তুইলা ফালামু।‘
স্যারের কল্যাণে এসএসসি পরীক্ষায় আমাদের স্কুল থেকে আমরা ২৬ জন স্টার মার্ক পাই। পরের ব্যাচেও ২২ জন স্টার মার্ক।
আমার আষাঢ়ে গল্প শেষ। এবার বাস্তবে আসি।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি হবার পরে স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে স্যার কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘মামুন (আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়, এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বর ৯০৫) কই আছে’? আমি বললাম, ‘স্যার, ও বুয়েট থেকে পাশ করে স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।‘
জুঁই, জুয়েল, মোহাম্মদ আলী, তৌহিদ, অনু- ওরা?
‘স্যার, জুঁই টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকাতেই আছে। জুয়েল ডাক্তারী পাশ করে সরকারী ডাক্তার হিসেবে জয়েন করেছে। এখন ময়মনসিংহে আছে। আর মোহাম্মদ আলী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সে একটা সফটওয়্যার ফার্ম দিয়েছে ঢাকায়। ভালো আছে। তৌহিদ নিজে ব্যবসা করছে, অনু বাংলালিঙ্কে আছে; রাজশাহীতে।
স্যার আবার কেঁদে ফেললেন। বললেন, তোমরা সবাই আমার হাতে কতকিছু হইলা, কিন্তু আমার ছেলেটারে আমি মানুষ করতে পারলাম না। তোমরা ওরে একটা চাকুরি দেও। আমি আর পারতেছিনা। জীবন তো শেষের পথে!
আমার চোখে পানি এসে গেলো। স্যারের ছেলে দীপঙ্কর সাহা, আমাদের প্রিয় দীপুদাদা’র কথা শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। বলা যায় মোটামুটি পালিয়েই এলাম স্যারের সামনে থেকে।
যে স্যার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে আমাদের বিজ্ঞানের বাস্তব নিরীক্ষা করাতেন, সেই স্যার আজকে বাস্তবতার পরীক্ষায় পরাজিত প্রায়।
স্যার, আমি পরজন্মে আপনার সন্তান হয়ে যদি জন্মাই, আপনাকে নিরাশ করবোনা কথা দিচ্ছি।
আপনার জন্য আমি পরজন্মে বিশ্বাস করতে রাজি আছি।
আপনি ভালো থাকুন।