প্রবাহ-১
খেলনা’র দোকানে গেলে লোভ হতো খুব। কত্ত রঙ-বেরঙের লাইট’অলা খেলনা গাড়ি, মটর সাইকেল, উড়োজাহাজ। একবার স্ট্রীট হক নামের একটা খেলনা মটর সাইকেল খুব পছন্দ হলো এক্সিবিশনের মাঠে। আব্বার সাথে গিয়েছি। ঘুরে ঘুরে সার্কাস দেখলাম, জাদু দেখলাম, হোণ্ডা খেলা দেখলাম, অথচ মন পড়ে রইলো ওই খেলনাতে। পছন্দের কথা বার বার আব্বাকে বলার চেষ্টা করেছি, তিনি শোনেন নি। কিংবা হতো শুনেছেন, কিন্তু নিজের সামর্থ্যের কথা ভেবে না শোনার ভাণ করেছেন। বাসায় ফিরলাম মনখারাপ করে। চোখে পানি নিয়ে অভিমান করে একসময় ঘুমিয়েও পড়লাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আব্বা জর্দ্দার দুটো স্টিলের কৌটোর মুখ আর পেঁপে গাছে ডাল দিয়ে একটা মটর সাইকেল বানানোর চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘বাজান, তোমারে প্রত্যেকদিন এইরকম হুণ্ডা বানাইয়া দিমু’। কি কারণে জানিনা, সেদিন স্কুলে সারাদিন আমার মন খারাপ ছিলো। বার বার আব্বার সেই মলিন হাসিটা চোখে ভাসছিলো। ছেলেকে খেলনা কিনে না দিতে পারার অপরাধে তিনি সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিজে হাতে খেলনা বানাতে বসেছেন। কি জানি! হয়তো সারারাত না ঘুমিয়ে নিজের অসামর্থ্যের অপরাধবোধে ছটফট করেছেন!
প্রবাহ-২
এস.এস.সি টেস্ট পরীক্ষায় ডাব্বা মারলাম। যেন তেন ডাব্বা না, এক্কেবারে ডাব্বার তলানীতে। নাম্বার সর্ব সাকুল্যে ৬৬২। ৮ম পজিশন থেকে এক্কেবারে ৩৪ নাম্বার পজিশনে। রেজাল্ট পাবার পর বাসায় যাবার আহ্লাদ দেখালাম না। আমাদের দু’বন্ধুর সময় কাটানোর জন্য বিলের ভেতর একটা ছোট্ট দ্বীপ ছিলো পতিত, ওখানে গিয়ে বসে বসে দ্বীপের ভেতর ছোট্ট ডোবায় নিজেদের ছায়া দেখছিলাম। চুপচাপ। বন্ধুর রেজাল্ট আমার থেকে কিছুটা ভালো। ৬৮০। যাই হোক, সন্ধ্যায় যথারীতি বাসায় ফিরলাম। নিশ্চিত ভাবে বাসায় এতোক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে। স্কুল থেকে না জানালেও সহপাঠীদের বাবা-মা যে নিজ দায়িত্বে জানিয়ে গেছেন আমার রেজাল্ট, তাতে সন্দেহ নেই। যাইহোক, দরজা খুললেন আম্মা। পুরনো দরজা খোলার শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে পরে যে বিকট শব্দটা হলো, পাঁচ মিনিট পরে বুঝলাম ওটা আমার গালে আম্মার চড়ের শব্দ ছিলো। পেছনে আব্বা। আম্মার মুখ থেকে অনবরত ঝাড়ি বেরুচ্ছে, আব্বা নিশ্চুপ। ইতোমধ্যে আমি কোনরকমে রণাঙ্গন পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকেছি। হঠাৎ আম্মার মনে হলো অনেক বকা দিয়েছি, এবার এ্যাকশনে যাওয়া যায়। টেবিল থেকে বইখাতা সব এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে তিনি চললেন কেরোসিনের টিন আনতে। মিশন, আমার বই খাতা পোড়ানো হবে। আমার নাকি আর লেখা পড়ার দরকার নেই। আম্মা তীরবেগে নিষ্ক্রান্ত হতেই মঞ্চে আব্বার প্রবেশ। আমাকে সদ্য খালি হওয়া টেবিলের উপর বসার আদেশ দিলেন। আমি বসলাম। তিনি বসলেন মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়া আমার টেস্ট পেপার বইয়ের উপর। আমি টেবিলের উপর মাথা নিচু করে বসে আছি, বাইরের দরজায় আম্মার ধাক্কাধাক্কি। পুরো নরক গুলজার অবস্থা। আব্বা আমাকে বললেন,
-‘বাজান, কাজটা কি ঠিক হইছে?’
আমি এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লাম। ‘না’।
-এর তো একটা সমাধান দরকার, তাইনা?
আমার মাথা উপর নিচ।
-‘তাইলে চলো, মিষ্টি খাইয়া আসি’। শার্ট পড়ো।
আমি আর আব্বা, আম্মার তীব্র চিৎকার পেছনে ফেলে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। পেছনে আমার এলোমেলো বই পড়ে রইলো নতুন জীবন শুরু করার অপেক্ষায়।
প্রবাহ-৩
ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে মাত্রই ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে বেরিয়ে এসেছি আমি আর আব্বা। আমার মন খারাপ, ইচ্ছে ছিলো নটরডেম কলেজে ভর্তি হবো, কিন্তু থাকার সমস্যা বলে আব্বা-আম্মা রাজি হননি। বের হয়ে আমরা বেবিট্যাক্সি নিয়ে এলাম মহাখালি। তখনো মন খারাপ। কারণ হোস্টেল আমার ভালো লাগেনা। আব্বা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাজান, খুব খারাপ লাগতেছে?’
আমি বললাম ‘হ্যাঁ’।
-নটরডেম কলেজে ভর্তির লাস্ট ডেট কবে?
-কালকে।
-ঠিক আছে, নামো গাড়ি থেকে। এখনও রেসিডেন্সিয়ালের ভর্তি ক্যানসেল করা যাবে।
প্রবাহ-৪
আমি আর আব্বা, এই দুজন খুঁজে খুঁজে একটা সাবলেট রুম পেলাম থাকার জন্য। কলেজের উলটো পাশেই বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনীতে। ১২ ফুট বাই সাড়ে ৮ ফুট স্টোর রুম। রুমের টাকা এ্যাডভান্স করে, আমরা দুজন বের হলাম চৌকি, তোষক, বালিশ আর টেবিল কিনতে। রুমে চেয়ার রাখার জায়গা নেই, তাই আপাতত চেয়ার বাদ। ঢাকা কলেজের সামনে থেকে সব কিছু কিনে, ওই ভ্যানে চড়েই আমি আর আব্বা আরামবাগ এলাম। রুম পর্যন্ত সব কিছু আনাতে আব্বা হেল্প করলেন। সব কিছু স্তুপ করে রুমের ভেতর রাখা, চৌকিটা তখনো বারান্দায়। সব কিছু একবার করে দেখে নিলেন তিনি-কিছু বাকী আছে কিনা। না, কিছু বাকী নেই আর। তিনি সেই স্তুপীকৃত মালপত্রের উপরে আমাকে বসিয়ে বললেন, ‘এখন থিকা তোমার নিজের জীবন নিজেরেই সামলাইতে হবে। এই যে বাড়ির বাইরে আসলা, আর বাড়িতে ঢোকার সুযোগ নাই। গেস্টের মত আসা যাওয়া করতে হবে। এখন নিজের ঘর নিজে গোছাও। আমি গোছাইয়া দিলে, যাবার সময় তোমার মন খারাপ হবে। তারচেয়ে এখন চলে যাই। তুমি কাজে ব্যস্ত থাকলে মনখারাপের কথা মনে থাকবো না। ব্যস্ততার চাইতে বড় ঔষধ আর নাই।
আব্বা বাড়ির পথে চলে গেলেন।
প্রবাহ-৫
ভাগ্য ভালো থাকাতে অনার্স শেষ করার পর দ্বিতীয় চাকরীর ক্ষেত্র হলো আমার নিজের জেলায়ই। প্রতিদিন যাওয়া আসা মিলিয়ে ৯৮ কিঃমিঃ ভ্রমণ করে অফিস করি, আর বাসায় ফিরে রাত ৩-টা ৪-টা পড়ালেখা করি। এমবিএ এবং চাকুরীর পরীক্ষার। আমি যতক্ষণ পড়ার টেবিলে থাকি, আব্বা বারান্দায় পায়চারি করেন, আর তসবী জপেন। একটু পর পর এসে দেখে যান আমার কিছু লাগবে কিনা। আম্মা ফ্লাস্ক ভর্তি চা বানিয়ে দিয়ে টেবিলে রেখে যাবার সময় মনে করিয়ে দেন সিগারেট খাবার অপকারিতা। আব্বা পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটেন, ‘আর যদি খাওই, বেনসন খাইয়ো, ঐটা কম কড়া’। আম্মা বিষ দৃষ্টি দিয়ে চলে যান। প্রায় চার বছর চললো এভাবেই। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না, আর আব্বা-আম্মার পায়চারীও শেষ হয় না। জীবনের টানাপোড়েন নিজের গতিতে চলতে লাগলো, যুদ্ধগুলোও কঠিন হতে লাগলো। অফিস, মাস্টার্স, চাকুরীর পরীক্ষা...যেন ভুলভুলাইয়ার গোলক ধাঁধাঁ।
প্রবাহ-৬
অবশেষে একদিন। বহুল আকাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ। সন্ধ্যায় খবর পাবার পর থেকে আম্মা আত্মহারা। এমন কি রাত তিনটায় ফোন করে বলেন, ‘খুশিতে আমরা ঘুমাতে পারছিনা’।
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘আব্বা, কি করে’?
-সেও বসে আছে আমার পাশে। তসবী নিয়ে। কথা বার্তা তেমন বলতেছে না, তবে খুব খুশি। বারবার তোমার রুমে গিয়ে বসে থাকতেছে’।
পরেরদিন নাকি তিনি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মফস্বল শহরে গেছেন। উনার সব শার্ট, প্যান্ট ইস্ত্রি করিয়েছেন। জুতা কালি করিয়েছেন। দাঁড়িতে দেবার জন্য মেহেদি কিনেছেন।
ফেরার পর এতো আয়োজন দেখে, আম্মা আব্বাকে জিগ্যেস করলেন, ‘কোথাও যাবা নাকি?’
-নাহ! কই আর যাবো? এখন থেকে একটু ফিটফাট হয়ে থাকা দরকার।
আমার বাবা, যিনি না বলাতেও অনেক কিছু বলে ফেলেন।