কবি সোহাগ সিদ্দিকী প্রাণখোলা চির সবুজ এক কবির নাম। আর স্বভাবে অভিমানী এ কবির প্রাণখোলা হাসি বন্ধুদের ভালোবাসায় উদ্বেলিত করে। কবি যেন এক চির সবুজের প্রতিকৃতি। মানুষকে যেমন তিনি সহজিয়ায় আকৃষ্ট করেন, ঠিক তেমনি মানুষের হৃদয়ের কন্দরে নিজেকে প্রবিষ্ট করাতে তার খুব বেশি দেরি হয় না। বন্ধুবৎসল, প্রিয়জন এই বন্ধুর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘অপূর্ণতায় পূর্ণ’ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে। আমি তার ছড়া-কবিতার সাথে প্রায় চার বছর আগে থেকেই পরিচিত। তার ছড়া-কবিতার পুরোটাই আমি পাঠ করে থাকি। হ্যাঁ। এ কথা সত্য, সবার লেখাই যে পুরোটা পাঠ করি, তা কিন্তু নয়। অনেকের লেখা পাঠ করতে যেয়ে হোচট খেয়ে ফিরে আসতে হয়। সোহাগের ক্ষেত্রে খুব একটা তা ঘটে না। তার ছড়া-কবিতা আমাকে কাছে টানে। পাঠে মুগ্ধ করে।
সোহাগের ছড়া-কবিতায় মানুষের যাপিত জীবনের নানা বোধের অনুষঙ্গ কখনো রঙিন হয়ে আবার কখনো বা ফিকে হয়ে ধরা দেয়। তার যাপিত জীবনের হারানো সুর অনুরণিত হয়েছে ‘অপূর্ণতায় পূর্ণতা’ কবিতাগ্রন্থে। বইমেলা চলাকালে বইটি আমি খরিদ করি। এখানে তার লেখা আর আমার ভালোলাগা কিছু কবিতা নিয়ে দু-একটি কথা বলার চেষ্টা করছি।
কবির ‘মা এক অচিন পাখি’ ও ‘আমার সকাল সাধ’ কবিতা দুটি পাঠ করলে আমরা তার জীবনের শিশুকালে মাকে হারানোর বেদনা, পরবর্তীতে বেড়ে ওঠার যে মর্মবেদনা যা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে, তা আমরা তার কবিতার পরতে পরতে উপলব্ধি করতে পারি। মা হারিয়ে শিশুকালেই কবি এক পরম সত্যের মুখোমুখি বাস্তব জীবনের ধুলোবালিতে বেড়ে উঠেছেন। ধারণ করেছেন জীবনের অমোঘ বাণী, কুড়িয়ে কুড়িয়ে সংগ্রহ করেছেন কবিতার পঙ্ক্তিমালা; তাইতো তিনি কবি হতে পেরেছেন। গেয়েছেন জীবনের জয়গান।
মা যে কেমন, কেমন ধরন
মাগো তুই বুঝতে দিলি না
হোঁচট খাওয়া দিনগুলোতে
তোর বাড়ানো হাতটি ছিলো না।
তারা হবার সাধটি নিয়ে
দূর আকাশে গেলে
নাড়ি ছেঁড়া একটি ধন
কার কাছেতে ফেলে?
[মা এক অচিন পাখি]
আমি এক সহজ পাঠ
শৈশব খেয়েছে পত্রহীন রুদ্রহীন ছায়া
স্মৃতির জানালা মেলে দেখিনি কখনোই
আদর পৃথিবী মুখ ভাসে মায়ামেঘ
পুকুরের চক্ষু জলে হাঁস ছানাদের
আমুদে সাঁতার দেখি অভাবী দৃষ্টিতে
বুক পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে নীল জলে
ভেসেছে আমার ভোর দুপুর গোধূলি
[আমার সকাল সাধ]
মাঝে মাঝে কবি নিজের কাছেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। নিজের ভেতরের বোঝাপড়া কবিকে তাড়িত করে, নানা চক্রের বাঁক বদলে কবিও চক্রের ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খান।
নিজেরে কী বুঝি আমি?
চিনি ঠিক ঠাক!
পথের দিশা কী জানি?
সঠিক সে বাঁক!
নাকি চক্রেই ঘুরে মরি
নিজেই নিজের!
[আপন খবর]
স্বপ্ন এসে বলেছিল,
যতনে চুঁয়াচন্দনে সাজাও আমাকে
সিঁড়ি বেয়ে ছুঁয়ে দেবে আমার আলোক
আমি যে বেভুল এক হতচ্ছাড়া
অগোছালো স্বপ্নের শরীরে,
ধুলো আর মরিচিকা ইচ্ছেমতো সাজে।
[নীলাভ জোসনার সুখ]
কবি নস্টালজিয়ায় ভোগে। কবিকে পেয়ে বসে তার শৈশব, যেখানে তার বেড়ে ওঠা, জীবনের যত স্মৃতির আঁচড় লালিত করে রেখেছে কবিকে। কবি সেই শিরীষতলায় সেই নদীর ডুবসাঁতার কোন কিছুই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারেন নি। স্মৃতি তাকে তাড়িত করে, স্মৃতি মদিরতায় অমলিন কৈশোর তাকে পোড়ায়।
এই প্রাণকালে আমি আর একবার
ফিরে যেতে চাই সেই শিরীষতলায়
আমার শৈশব ডুবা নদীটির তীরে
হয়তো সে তেমন আছে স্মৃতি মদিরায়
অমলিন কৈশোরের মতো একঠাঁয়!
একই কবিতায় শেষের তিন পঙ্ক্তিতে আবার তিনি বলেছেন--- কবি সেখানেই অন্তিমে ফিরে যাবার অভিলাশ ব্যক্ত করেন ‘শিরীষ ঠিকানা খুঁজি’ কবিতায়। আসলে আমাদের প্রত্যেককেই আদতে শেষ ঠিকানায় ফিরে যেতে হয়, এটাই সত্য ধ্রুবতারার মতো। কবি কী করে তাকে অস্বীকার করবেন। তাই তিনি অবলীলায় বলেছেন জীবনের শেষ ঠিকানা তারই প্রিয় গ্রামের শিরীষ গাছতলায়।
শিরীষ, অপেক্ষা করো আবার আসব
তোমারই কাছে, যেমন মানুষ ফেরে
জীবনের শেষে জন্মের আগের ঠিকানায়।
[শিরীষ ঠিকানা খুঁজি]
সোহাগ সিদ্দিকীর কবিতায় প্রেমানুভূতি গভীর মমতার প্রলেপ দিয়ে আচ্ছাদিত থাকে। তিনি তার কবিতায় প্রেম, দুঃখ আর বেদনার দিনলিপি গেঁথে যান। কবিতায় তিনি তার ভালোবাসার গহীন দ্বীপে প্রেয়সীকে জিইয়ে রেখেছেন। আর তার জিজ্ঞাসা কবিকে নীল সাগরে ফেলে রেখে প্রেয়সী কী সুখে আছে? কবি দূরে থাকলেও প্রেয়সীর মুখচ্ছবি ভুলে যেতে পারেন না। তাইতো যোজন যোজন দূরে চলে গেলেও দিবানিশি মনের মাঝে তারই ছবি ভেসে ওঠে কবিকে ভুলে যেতে দেয় না।
ভালবাসার গহীন দ্বীপে
রেখেছিলাম তোকে
ফেলে আমায় নীল সাগরে
আছিস কি তুই সুখে?
[এক পৃথিবীর কষ্ট]
সেই আমার রঙেন মানুষ
থাকে যোজন দূরে
যার ছবিখান দিবানিশি
মনের মাঝে ঘুরে।
[গানকথা-১]
নদী তোমার জলশরীরের
আঁচল পেতে দাও
অবাক সুখে ভাসবো আমি
ভাসবে আমার নাও।
[গানকথা-৪]
কবিরা শব্দচাষী, শব্দশ্রমিক। একজন শ্রমিক যেমন হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভাঙে, তেমনি একজন শব্দচাষী শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে জীবন ধন্য করেন। কবির ক্ষুধা যে অন্য ধরনের; তার ক্ষুধা, তার পিপাসা মিটানের জন্য তাকে শব্দের ওপর নির্ভর করতে হয়। শব্দের ভাংচুর করতে হয়। তার পরেই কেবল কবির তৃপ্তি মেটে। আদতে একজন শ্রমিক আর একজন শব্দ শ্রমিকের কাজে কারুকার্য কিন্তু একই রকমের। ফসলে ভিন্নতা রয়েছে। শ্রমিক দেহের ক্ষুধা নিবারণ করছেন আর কবি মনের ক্ষুধা, প্রাণের পিপাসা নিবারণ করছেন।
তুমি যখন পাথর ভাঙো, আমি ভাঙি শব্দ
তোমার আমার পরিচয়, শ্রমের দামে লব্ধ।
তুমি যখন ভূমি চষে, জোগাও ক্ষুধার অন্ন
আমি তেমন স্বপ্ন চাষে, জীবন করি ধন্য।
[শ্রমজীবী মানুষ]
সোহাগ সিদ্দিকীর কবিতায় প্রেম এক ভিন্ন মাত্রায় দেখা দেয়। তার বর্ণনায় নিজস্ব একটা ঢঙ পরিলক্ষিত হয়; যা দেখে অন্য কবিদের প্রেমের কবিতার সাথে কিছুটা তফাত তো আমরা দেখতেই পাই। যেমন ‘সাতকাহন’ ও ‘আদুরী’ পাঠান্তে আমরা তারই এর সারল্য ব্যাঞ্জনা পরিস্ফূটিত হতে দেখি।
শুক্র গেল, কথা দিয়ে এলে না
গেল রবি, আজ সোম!
অপেক্ষার আগুনে গলছি
আমি এক বিরহী মোম!
[সাতকাহন]
তোর শরীরে
আনবো ফাগুন
লাগিয়ে দিয়ে
সুখের আগুন
ঢালবো আবার
শান্তি শীতল জল!
আমারে তুই নিবি কি না
হাতটা আমার ধরবি কি না
বল, আদুরী বল?
[আদুরী]
এছাড়াও তার এ কবিতাগ্রন্থে লীনুয়াকাহন, ভবতন্ত্র, গানকথা, ফুলকথা, নদীকথা শিরোনামে বেশকিছু অণুকবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। মোট আশি পৃষ্ঠার কবিতাগ্রন্থে চুয়াত্তরটি কবিতা স্থান পেয়েছে। সুখপাঠ্য অনেকগুলো কবিতা আমার ভালো লেগেছে, কোনো কোনো কবিতায় যে দুর্বল বাক্য বিন্যাস বা ছন্দ পতন হয়নি সে কথা বলা যাবে না। তারপরেও বলবো ভালো লিখেছেন, প্রথম কবিতাগ্রন্থে কিছুটা হলেও জানান দিতে পেরেছেন। এটাই বা কম কিসে। কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পরিবার পাবলিকেশন্স, কবিতাগ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৪০ টাকা, দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন চারু পিন্টু। কবি বন্ধু সোহাগ সিদ্দিকীর এ কবিতাগ্রন্থটির ব্যাপক প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করছি।