সম্প্রতি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বহুল আলোচিত "ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন" বন্ধ করা নিয়ে অনেককেই উদ্বিগ্ন দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টি আমাদের মতো সাধারণ আমেরিকান নাগরিকদের জন্য কিছুটা হলেও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে আমরা যারা অভিভাবক পর্যায়ে আছি তারা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক বা উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যতের বিষয়গুলো মাথায় রেখেই কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছি। দেশ বা জাতি হিসেবে সেটা আমেরিকানদের জন্য ভালো হলো না মন্দ হলো সেটা নিয়ে কিছুটা আলোচনার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ হওয়াতে কিছু বিষয় আমার কাছে দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। তার কিছু বিষয় আপনাদের সাথে শেয়ার করার জন্যই এই লিখা। প্রথমেই কিছু বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা দেয়ার প্রয়োজন বলে মনে করছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাবলিক শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে যে তালিকা প্রকাশ করা হয় তার কোনটাতেই আমেরিকা প্রথম দশটি দেশের মধ্যে নেই। এখানে "গুণগত মান" বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর পেছনে যে দুটো পরিমাপক রয়েছে তা হলো:-
ক) এডুকেশন ইনডেক্সঃ এটি মূলত আর্ন্তজাতিক সংস্থা ইউ.এন.ডি.পি. কর্তৃক প্রবর্তিত "হিউম্যান ডেভেলপম্যান্ট ইন্ডেক্স" এর একটি পরিমাপক যেখানে প্রতিটি দেশ তাদের শিক্ষা কতটুকু ভালো করতে পারছে তার একটি তালিকা তৈরী করা হয়। এখানে দুটো বিষয়ের দিকে নজর দেয়া হয়। এক, একজন প্রাপ্তবয়স্ক (২৫ বছর বা তার বেশী) ব্যক্তি তিনি কত বছর পড়াশোনায় ব্যয় করেছেন। দ্বিতীয়ত, একজন শিশুকে তার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কত বছর স্কুলে যেতে হতে পারে। পুরো বিষয় মাপা হয় ০ এবং ১ দিয়ে। সবচেয়ে ভালো শিক্ষা ব্যবস্থার এক দেশ এর পয়েন্ট হবে ১। এর নিচে যেসব দেশ থাকবে তাদের পয়েন্ট হবে ০.৯৯, ০.৯৮ .. এভাবে ০ হবে সবচেয়ে খারাপ শিক্ষা ব্যবস্থার দেশ। এ দিক থেকে তালিকার শীর্ষে থাকা দেশ সিঙ্গাপুর (০.৯৫), তারপর সুইজারল্যান্ড (০.৯২)। এভাবে বাকি দেশগুলোরও তালিকা রয়েছে (পড়ুন)।
খ) কোয়ালিটি ইনডেক্সঃ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগীতামূল অবস্থান নিয়ে রিপোর্ট তৈরী করে (পড়ুন)। মূলত ১২ মূল মানদণ্ড আমলে নিয়ে এই তালিকা তৈরী করা হয় যা একটি হলো "উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ"। এখানে বেশ কিছু বিষয় আমলে নেয়া হয়, যেমন শিক্ষদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাদের কর্মদক্ষতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত মান, কারিকুলামে কি কি বিষয় অর্ন্তভূক্ত করা হচ্ছে এবং ছাত্রদের প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন ও কর্মদক্ষতা উন্নয়ন। এসব কিছু মিলিয়েই মূলত এই ইনডেক্স তৈরী করা হয়। বিস্তারিত জানতে তাদের এ সংক্রান্ত বেশ কিছু আর্টিকেল পড়তে পারেন এখান থেকে।
ব্যয়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা
আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, ভুল না জেনে থাকলে বিভিন্ন তালিকা থেকে এটিই প্রতিয়মান হয়েছে (সূত্র)। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার দিকে তাকালে এ অবস্থার ভয়াবহতার একটি পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। আমি বেশ ক'বছর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো বেশ পরিষ্কার ধারনা পেয়েছি। ইউরোপের অনেক উন্নত দেশেই উচ্চ শিক্ষা অবৈতনিক হলেও আমেরিকায় তেমনটি নয়। মোটাদাগে আমেরিকায় চার বছরের ব্যাচেলর প্রোগাম সম্পন্ন করতে ২০-৫০ হাজার মার্কিন ডলার প্রয়োজন হয়। আর স্বাভাবিকভাবে দু'বছরের মাস্টার্সে প্রোগামে ২০-৩০ হাজার ডলার প্রয়োজন পড়ে শুধু টিউশন ফি হিসেবে। তবে এম.বি.এ কিংবা স্পেশালাইজ প্রোগাম ও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ৩০-১০০ হাজার ডলার বা তার বেশীও পড়তে পারে। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে উচ্চ শিক্ষা এখন আর কোন নাগরিক অধিকার নয় বরং পণ্য। রাজ্য ভিত্তিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ব্যয়ের চিত্র পাবেন এখানে।
ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন
১৯৮০ সালে কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এই ডিপার্টমেন্টের বাজেট তথা খরচের খাতা ক্রমাগত বেড়েছে (সূত্র)। সমস্যাটা আসলে সেখানে নয় কারণ এই ব্যয় আমেরিকার সামগ্রিক বাৎসরিক বাজেটের বেশ ছোট একটা অংশ। সমস্যা হলো হাই স্কুল পাশ করা শিক্ষার্থী কেন লিখতে ও পড়তে পারে না (দেখুন) কিংবা হাইস্কুলে সব বিষয়য়ে "এ" পাওয়া ছাত্র কেন কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না (দেখুন)। বিষয়গুলো যে অস্বাভাবিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না কিংবা সবাই যে এমন সেটাও নয়। আমার সাথে কলেজে পড়ুয়া ছাত্র সাধারণ অংক (এ্যালজেবরা) সমাধান করতে না পারা কিংবা ৪ কে ৮ দিয়ে গুণ করলে ফলাফল কত হবে তা বলতে না পারা মতও ছাত্র আমি দেখেছি। লিখতে গেলে সাধারণ ইংরেজী বানানে অজস্র ভুল করা ছাত্রও আমি দেখেছি যদিও সেটা তার মাতৃভাষা। তাহলে প্রশ্ন আসে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যাচ্ছে কোথায়। এত টাকা খরচ করার পরেও কেন তার ফলাফল পজিটিভ হচ্ছে না।
এটা কেবল সমস্যার শুরু। প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের টাকায় অনেক গরীব ছাত্রদের বিনামূল্যে পড়ার ব্যবস্থা করে দেয় যার অংকটাও অতটা ছোট নয়। শুধু ২০২৪ সালে ডি.ও.ই ২৬৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে যার মধ্যে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছিলো গ্র্যান্ট মানি মানে এ টাকা শুধু পড়াশোনার জন্য এককালীন খরচ হিসেবে ব্যয় করা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোকে অনুদান দেয়া হয়েছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। আর উচ্চ শিক্ষার জন্য অনুদান ও লোন বাবদ ব্যয় হয়েছে ১২৪ বিলিয়ন ডলার (সূত্র)। ২০০৬ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ডি.ও.ই্ প্রদত্ত অনাদায়ি লোনের পরিমান দাঁড়িয়েছে ১.৭৭ ট্রিলিয়ন ডলার যা প্রতি বছরই বাড়ছে (সূত্র)। অবশ্য বাড়তে থাকা এই দায়ের পরিমাণ সমহারে বাড়ছে না। যেম কোভিডের সময় তা অনেক কমে এসেছিলো কিন্তু ২০২৪ এসে তা ৯% এর বেশী বেড়েছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক কারনে পূর্ববর্তী প্রশাসন ক্ষমতা থাকার সময় বাইডেন ১৮৮ বিলিয়ন ডলারের লোন মওকুফ করেছেন। সেই সাথে যোগ হয়েছে আরো কিছু বিষয় যেমন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্য-পুস্তকে অযাচিতভাবে সরকারি টাকা খরচ করে এল.জি.বি.টি সম্পর্কিত বিষয়গুলো ঢোকানো হয়েছে যা নিয়ে অনেক রক্ষণশীল অভিভাবক মহলে ক্ষোভ তৈরী হয়েছে। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে "ডাইভারসিটি, ইকুইটি ও ইনক্লসন" (পড়ুন) এর মতো বিষয় যোগ করার কারনে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে (যারা সরকারি অনুদান গ্রহণ করে) আলাদা ডিপার্টমেন্ট চালু করা হয়েছে যা শিক্ষা সংক্রান্ত সরকারি ব্যয় কিছুটা হলেও বাড়িয়েছে। অবশ্য রক্ষনশীল রিপাবলিকানরা এর পক্ষে নয়। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি বেশ মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাধান কিভাবে সম্ভব?
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিমত, বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না দিয়ে রাজ্য সরকারের হাতে ছেঁড়ে দেয়া হোক। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় রাজ্য সরকার তার কোন এলাকার কোন বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন তা বেশী দক্ষতার সাথে নির্ধারণ করতে পারবে এবং অযাচিত খরচ রোধ করতে পারবে। রাজ্য সরকারের হাতে ছেড়ে দিলে তারা স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের খরচ কমাতে চাইবে তা না হলে রাজ্যের জনগণের উপর নতুন করের চাপ বেড়ে যেতে পারে যা রাজ্য সরকারকে একটা প্রতিযোগীতামূলক অবস্থানে নিয়ে আসবে। কেন্দ্রীয় সরকার ডি.ও.ই এর মাধ্যমে না গিয়ে যে ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যকে স্বাভাবিক থোক বরাদ্দ দেয়া হয়, তাদের মাধ্যমে দেয়া বরাদ্দ থেকেই রাজ নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নির্ধারণ করবে।
এখানে মনে রাখা জরুরী যে, আমেরিকায় প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব সরকার রয়েছে, পার্লামেন্ট রয়েছে। রাজ্য নিজেও তাদের বাজেট তৈরী করে ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বাজেট থেকে টাকা বরাদ্দ দেয়। তেমনি স্ব স্ব রাজ্যের শিক্ষা খাতের বরাদ্দও রাজ্যই নির্ধারণ করবে। আরেকটি বিষয় হলো, সব রাজ্যে জনসংখ্যা ও আয়করের পরিমাণ একরকম নয়। যেমন টেনেসি রাজ্যে কোন ব্যক্তিগত আয়কর দিতে হয় না। আবার নিউ ইয়র্কের আয়করের রেট মন্টানা রাজ্যের সমান নয়। আবার রাজ্যের মাথাপিছু আয়ও সমান নয়। কোথাও শিক্ষা ব্যয় বেশী আর কোথাও কম। সবদিক থেকে বিবেচনা করলে বিষয়গুলো অনেকটাই বোধগম্য মনে হতে পারে। তবে সাধারণ জনগণ মূলত মোটাদাগে তাদের অভিমত ব্যক্ত করছেন, বিষয়টিকে আমি আপাতত পজিটিভলি দেখছি।
এছাড়া বিষয়টি নিয়ে আরো বেশ কিছু আইনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে ট্রাম্প প্রশাসনকে। এক্সিকিউটিভ সিদ্ধান্তে এই ডিপার্টমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে না, একটা কংগ্রেস থেকে পাশ হয়ে আসতে হবে।
নোট: ব্যক্তিগতভাবে আমেরিকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মান আমার কাছে এতটাই খারাপ মনে হয়েছে যে আমি নিজেও আমার বাচ্চাদের আমেরিকায় প্রাথমিক স্তরে পড়াশোনার পক্ষপাতি নয়। যদিও এখানে পড়াশোনার মান ছাড়াও আরো কিছু বিষয় জড়িত। তদুপরি সবার মতামত একরকম হবে না আর এটাই স্বাভাবিক।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ৮:৪১