০৫/২/২০৫০
শনিবার, ধানমন্ডি
প্রিয় সুচয়না,
ইতিবৃত্ত আমি বলতেই পারি তোমাকে। ঘুম ভেঙ্গেছিলো তোমার ফোনের রিং টোনে। ফোন দিয়েই এক ভয়ানক সত্য জানালে। কেউ একজন মরবে না ভেবে ঘুম ঘোরে আমি আঁতকে উঠি। তুমি ভীষণ হতাশ। আমি সুধালাম, টেনশন নিও না কিছু একটা হবে। আসলে জানতাম না কী হবে, তবে তোমার টেনশন কমানো প্রয়োজন ছিলো। ফেসবুকের ছেলেপেলে কী সব কী যেন করলো, আমি ওসব বুঝিটুঝি না। বিকাল তিনটায় কারা যেন ডাক দিয়েছে শাহবাগে। শাহবাগ জায়গাটা মোক্ষম, কাদেরের ফাঁসি দিয়েই ছাড়বো। এমন একটা হম্বিতম্বি ভাব নিয়ে সোজা চলে গেলাম। আমাকে কেউ চিনে না, তুমি বললে বাবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলে আসবে। ভাবছিলাম কাউকে চিনিনা, তুমি না এলে হবে কীভাবে? তুমি আসলে না, ফোন দিয়ে বরং জানালে কাদের মোল্লার রায়ে তোমার বাবা খুব কষ্ট পেয়েছেন। এরকম একজন আলেমকে কিছুতেই কষ্ট দেয়া ঠিক না। মানুষ সব মিলিয়ে ত্রিশ জন। জাদুঘরের সামনে লাইন ধরতে বলা হলো। ধরে ফেললাম। সবার হাতে প্লেকার্ড। সব প্লে কার্ডে এক কথা। এসব কথা লিখলো কারা? এত দ্রুত এসব করল কারা? দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।
তারপর রাস্তা ব্লক করার কথা হলো। আমরা সবাই মিলে ব্লক করলাম। মানুষ কম তাই ছড়িয়ে ছড়িয়ে বসতে হল। আমাদের কান্ড দেখে ডিউডিরত কয়েকজন পুলিশ অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন।
তোমার কথা আমি বেমালুম ভুলে গেলাম, কালো হাত, সাদা হাত, কার হাত, কাদের হাত আমি জানিনা, সবগুলো হাত উপরে উঠছে, যে ছেলেটা গলা উঁচিয়ে কাশিও দেয়নি সেও চিৎকার করছে, যে মেয়েটা বাবার ভয়ে চুপসে থাকতো সেও বাবাকে উপেক্ষা করে এসে স্লোগান দিচ্ছে, ভীড় বাড়ছে, স্লোগানের শক্তি বাড়ছে “কসাই কাদেরের ফাঁসি চাই, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই”। তারপর কেবল চারপাশ থেকে কারা যেন আসছে? এরা কারা? মোমবাতি হাতে, স্লোগান মুখে, হিংস্র চেহারার, এরা কারা? আমি উত্তর পাচ্ছিলাম না, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কেন? বুকের মত এক ধরণের স্রোত যাচ্ছে, সে স্রোতের নাম কী? স্রোতের নাম বাংলাদেশ, ওরা বাংলাদেশ, ওরা মানচিত্র, ওরা অস্তিত্ব।
রাত সাড়ে বারোটায় বাসায় ফিরলাম, আমি জানিনা শাহবাগে কী হয়েছিলো। যতক্ষন ছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত স্লোগান দিয়ে গেছি। তেষ্টা পেলে পানির বদলে চা খেয়েছি, কয়েক কাপ চায়ের বিল কারা দিলো জানিনা। আমিও কাদের বিল দিলাম জানিনা। জানার চেষ্টা করে কী হবে? স্লোগান দিতে হবে, ফাঁসি জয় করে আনতে হবে, দু কাপ চায়ে যদি গলার স্বর একটু বাড়ে ক্ষতি কী? অবাক হলাম বাসায় ফিরে, পাখির দৃষ্টিতে শাহবাগ, এত সুন্দর কেন? টিভি সাংবাদিক প্রাণপনে রিপোর্ট বলার চেষ্টা করছে “ওদিকে স্লোগান ভাসছে কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, জ্বালারো জ্বালো”। ঘুম হল না, তুমি নাই, ফোন ধরোনি। বুঝতে পারলাম না কেন। কী হচ্ছে এখন শাহবাগে, এতগুলো মানুষ খাবে কী? অস্থিরতা বাড়ছে, কী যেন শাহবাগ চলছে আমি মিস করছি।
ককটেল ফুটেছে, তাই ল্যাব এইডের সামনেই নেমে যেতে হল বাস থেকে। শাহবাগের দ্বিতীয় দিন। টিভি মারফত জানলাম শাহবাগ এখন বাংলাদেশ, সব জায়গায় শাহবাগ। দুএকটা ছেলে ফেসবুক থেকে কী না কী করেছে। তাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি হবে তো? কতগুলো কন্ঠ এক সাথে হলে ফাঁসি হবে? না হলে কী হবে? কেন হবে না? পরক্ষনে আবার নিজেকে সুধাই। রিকশা ঠিক করলাম, কিন্তু পকেটে টাকা নাই।
-মামা শাহবাগ যামু,
-ওইদিকেতো যাওয়া যাবে না মামা,ওইখানেতো রেজাকারের ফাঁসি চলতাছে।
এক গাল হেসে দেয়া রিকশাওয়ালা মামার চেহারা দেখে খুশীহয়ে গেলাম। বললাম “থাক তাহলে হেঁটেই যাই”। হাঁটা শুরু করতে রিকশাওয়ালার ডাক “এই মামা হুনেন,আপনি কী রেজাকারের ফাঁসির পক্ষের লোক?
-হ্যাঁ
-চলেন তাইলে আপ্নেরে যদ্দুর পারা যায় দিয়া আসি।
রিকশায় উঠলাম, এর আগে একা একা রিকশায় উঠলেই তোমাকে মিস করতাম। বিশ্বাস করো, সেই মুহুর্তে তোমাকে মিস করবার সময়টুকু পাইনি। ঠিক কোন দিকে আমি বসবো, কোন দিকে বসলে স্লোগানটা জোরে বলা যাবে, কিংবা রাজাকারদের একটু বেশী গালি দেয়া যাবে। শাহবাগে ঢুকেই আমি অবাক। ভরা দুপুরে হাজার হাজার মানুষ করছেটা কী? মানুষদের অফিস নাই? সংসার নাই? চাকরী নাই? হুম আছে, সবকিছু আছে। সাথে ছোট্ট করে আছে দেশপ্রেম, দেশদ্রোহীদের প্রতি ঘৃনা। আমি জেনে গেলাম এসব আয়োজন ব্লগার নামক কাদের যেন!
ঠিক জাদুঘরের সামনে একলা, অবাক হয়ে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। গতকাল তুমি আমার উপর রাগ করোনি, খুব রাগ করেছিলে তোমার বাবার প্রতি। আজ তুমি আসবে, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। একটি শিশু আসলো মায়ের সাথে। বেচারা মা, বাচ্চাটিকে সামলাতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে।
-আম্মু আম্মু নিজামী কে?
-অনেক বড় রাজাকার বাবা
-রাজাকাররা খুব খারাপ হয়?
-হুম খুব খারাপ হয়, ওরা মানুষ মেরেছে,
-মানুষ মারা কী খুব খারাপ কাজ?
-হুম খুব খারাপ কাজ, তবে রাজাকার মারা খারাপ কাজ না, তাইতো আমরা রাজাকারের ফাঁসি চাইতে এসেছি।
-তাহলে আম্মু আমি একটা রাজাকার মারবো, কিনে দিবা? মাত্র একটা!
কথাগুলো আমি ভেবে নিলাম। এত শব্দের মধ্যে মা ছেলের কথা আমার কানে আসবার কথা না। স্লোগান বাড়ছে, গতি বাড়ছে, বাংলার মানুষের কন্ঠস্বর বাড়ছে। একাত্তরের স্টেইনগানের মত যেন স্লোগান ঝরে পড়ছে “ক তে কাদের মোল্লা তুই রাজাকার , তুই রাজাকার” । হুমায়ূন আহমেদ বড় অবেলায় মরে গেলেন, আর ক’টা দিনে বেঁচে থাকলে তিনি হয়ত আরও কিছু সুখ নিয়ে মরতে পারতেন। তুমি আসলে, মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা, মুখে নেকাব। পরহেজগার ফ্যামেলির মেয়ে হলে যা হয়। তোমার দু চোখে তাকিয়ে দেখলাম ওখানে আমি নেই, একটি সবুজ মাঠের মাঝখানে লাল একটি ভরাট বৃত্ত আছে। আমি আজ না হয় না থাকি, আজ থাকুক না একটি পতাকা তোমার চোখে। আমাদের সেদিন প্রেম করা হল না। এক হাতে স্লোগান দেবার দিন শেষ, ভীড়ের মধ্যে হাতে হাত রেখে স্লোগান দিচ্ছি “ন তে নিজামী তুই রাজাকার তুই রাজাকার”। সন্ধ্যা হতেই তুমি চলে গেলে, আমরা কাদের যেন দলে ভীড়ে গেলাম। টুকটাক কাজ করতে হচ্ছে। তুমি আমাকে সাথে নিলে না, বললে “আমাকে এগিয়ে দেবার দরকার নেই, তুমি চলে গেলে একটি কন্ঠ থাকবে না। তুমি থাকো, স্লোগান দাও”। যাবার আগে দুটি চিঠি ধরিয়ে দিলে। আজকেরটা এবং গতকালকেরটা।
বন্ধু হিসাবে আমি মোটেও ভালো না, তাই আমার বন্ধু কম। অথবা মানুষের বন্ধু আমি নই। কিন্তু আমার বেশ কিছু বন্ধু জুটে গেলো। শাহবাগে একসাথে স্লোগান দেবার বন্ধু, জানি মানুষ বন্ধু হিসাব করে স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট, ভার্সেটির হিসাবে, আমার বন্ধু জুটেছে শাহবাগের, বন্ধু জুটেছে স্লোগানের, বন্ধু জুটেছে মশালের। হয়ত আমি স্লোগান ধরতে ধরতে ক্লান্ত, আমার ক্লান্ত স্লোগান কেড়ে নিয়ে কোন এক বন্ধু চালিয়ে যাচ্ছে দেদারছে। বিশ্রাম শেষে আবার আমি হাল ধরছি। বন্ধুত্বের কারণে শাহবাগ যাওয়া নেশা হয়ে গেছে। প্রতিদিন ফিরি, প্রতিদিন যাই। এর মধ্যে তুমি আরো দুদিন এসেছিলে। সাথে নিয়ে এসেছিলে চিঠি, হাসতে হাসতে সে চিঠির নাম দিয়েছিলাম শাহবাগের চিঠি। কী অদ্ভুত ব্যাপার, এক কাদের মোল্লাই পারলো প্রেমের চিঠিকে দেশপ্রেমের চিঠি বানিয়ে ফেলতে। আমি এখনো শাহবাগ হিসাব করি প্রথম চারদিন। এই চারদিনের চারটি চিঠি আমার কাছে আছে।
কোন একদিন থেকে যাই রাতে। চাঁদা তুলে গণ খিচুড়ী, অথচ কেউ কেউ নাকি ফেসবুকে বলাবলি করছে “এখানে বিরানী দেয়, বিরানীর লোভে আমরা শাহবাগ যাই”। এসব ভেবে খিদার পেটে হাপুস হুপুস করে খেয়ে নিলাম, সারাদিন কিছুই খাইনি, একটি বিরানীর দানাও না। তোমাকে ফোন দেয়া দরকার। ভালোই শীত পড়েছে। রাতের শীত সহ্য করে নিচ্ছি, তোমাকে মিস করছি সেটাও নিলাম।
-আমি ভালো নেই
-কেন?
-আমার কান্না পাচ্ছে
-কাঁদো
-তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হচ্ছে!
-চলে এসো আমার কাছে।
-রাখতে পারবে?
-আমার অনেক বিশ্বাস জানো সুচয়না, অনেক বিশ্বাস,দেশটাকে রেখেছি, যতটুকু নাই ততটুকু অর্জন করবো। এতগুলো মানুষের দেশে আমিও একজন, আর কেবল আমার তুমিকে রাখতে পারবো না?
সে রাতে তুমি কথাই বলতে পারলে না, কেবল কেঁদে গেলে। আমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। শাহবাগের এক স্লোগান সঙ্গী আবদুল কাদের। তিনি রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয় নামক একটি হাই স্কুলের দারোয়ান। কাদের মোল্লার সাথে নামের মিলের কারণে বেচারা বিশাল লজ্জায় আছেন। আপাতত তিনি কাদের মোল্লার ফাঁসিকে অস্তিত্বের প্রশ্ন হিসাবে নিয়েছেন, অথবা একই নামের প্রায়শ্চিত্য হিসাবে নিয়েছেন। তিনি জানান “এই বাংলার বুকে হয় কসাই কাদের থাকবে, নইলে আবদুল কাদের থাকবে”। কথার মাঝখানে তার বাগড়া
-ভাই চলেন এক কাপ চাই মাইরা আসি, শীত করতাছে
তার সাথে কথা বলার অবস্থা আমার ছিলো না। তুমি কাঁদছো, দেশও কাঁদছে, একটু পর আবদুল কাদেরও কেঁদে দিবেন। আমি কাদেরের সাথে কী যেন বলতে চাইলাম। তুমি ফোন কেটে দিলে। আর কথা হল না! স্লোগান দেবার নেশায় চা খেতে গেলাম। তোমার ফোন অফ।
শাহবাগ যাই-আসি, তোমার কোন খোঁজ নেই। ফোন, টেক্সট কিচ্ছু নেই। ফেসবুকে একটি আইডি ছিলো বটে, সেটা আইডি না বলে বলা উচিত ফেসবুকে একটা নাম লিখা আছে। তুমি নেই কোথাও, অস্থিরতার পরিমাণ বাড়ছে। সারাদিন তোমাকে একদম ভুলে থাকি, রাতটা খুব কষ্ট হয়। একা একা, বারবার তোমার নম্বরে ফোন দেয়া এবং বন্ধ পাওয়ায় কাটছিলো। হুট করে রিংটোন বেজে উঠলেই মনে হতো এই বুঝি তুমি ফোন দিয়েছো।
পুরো দেশ একসাথে রাজাকারের ফাঁসি চাইছে। আমি কোন প্রেমিক যে কেবল প্রেমিকার চুমু চাইবো, প্রেমিকার কন্ঠস্বর চাইবো, প্রেমিকার কন্ঠস্বরে জ্বালা নাই, আগুন নাই, আমার সব জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। কাদের মোল্লা, পাকিস্তান, যুদ্ধাপরাধী সব জ্বালিয়ে দিবো সময় পেলে। মানুষের আগুন খুব বড় আগুন। আন্দোলন চলতে লাগলো, লাগাতার আন্দোলন, মানুষ কেবল ভাসছে স্রোতে, এই স্রোত একটি মৃত্যূ, পুরো দেশ একটি মানুষের মৃত্যূ কামনা করছে। আমার প্রেমিকার ভালোবাসা কামনা করার ক্ষমতা নাই!
একদিন হুট করে চারুকলার সামনে দেখা হয়ে গেলো তোমার এক বন্ধুর সাথে। আমাকে দেখে খুব করুণ করুণ চেহারা করে ফেললো। তাকে পেয়ে যেন চাঁদ পেলাম “কী অবস্থা ভাই”
-জয় বাংলা ভাই, মোল্লার ফাঁসি হবে, না হয়ে যাবে কই।
তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবার সাহস পেলাম না। একজন মানুষ যখন রাজাকারের ফাঁসির জন্য পাগল হয়ে আছেন, তাকে কীভাবে বলি ভাই আমার প্রেমিকা সুচয়না সে কী করছে? তার সাথে আমার কথা হয় না বহুদিন। একটু কথা বলিয়ে দিবেন, স্লোগানের সময় একা হাতে আমি তাকে মিস করি। বলতে ইচ্ছা করছে দ্বৈত কন্ঠে স্লোগানের সুরে গান গাইতে আমার ভালো লাগে, আমার মনে হয় আমরা ভালোবাসা দিয়ে রাজাকার মেরে ফেলতে এসেছি, পুরো দেশটা সংসার, ছোট্ট সংসার, এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশ সত্তর বর্গকিলোমিটারের এই সংসারের কেন তারা থাকবে? তোমার বন্ধু আমাকে চা খেতে নিয়ে গেল, নিজের পকেট থেকে সিগারেট বের করে আমাকে ধরিয়ে দিলো। তারপর খুব শান্ত গলায় জানালো গতকাল এক ভদ্রলোকের সাথে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, বিয়ে মানে তেমন কিছু না এমনিই বাসায় খুব কাছের কয়েকজনের উপস্থিতিতে ওটাকে বোধহয় আকদ বলে। পাত্র অত্যন্ত ধার্মিক, উচ্চ বংশীয় এবং নিজের ব্যবসা আছে ঢাকায়। শুনে কী ভাবলাম জানিনা, এক টানে পুরো কাপ চা খেয়ে নিলাম। ধন্যবাদ দেবার প্রয়োজন ছিলো তোমার বন্ধুকে, দিতে পারলাম না। শাহবাগের মোড়ে চলে আসলাম, দুনিয়া স্তব্দ করা স্লোগান চলছিলো, আমিও হারিয়ে গেলাম স্লোগানে, হারিয়ে গেলাম কাদের মোল্লার মৃত্যূর গানে, হারিয়ে গেলাম একটি দীর্ঘশ্বাসে! যেন তোমাকে হারিয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসিতে আমি বেঁচে উঠবো। এত দ্রুত এত কিছু ভাবিনি!
ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে গেলো, মার্চ, এপ্রিল কিংবা মে মাস চলে যায়। তোমার হারিয়ে যাওয়া আর কাদের মোল্লার ফাঁসির পুণ:রায়ের দীর্ঘশ্বাস কেবল বাড়তে থাকে। ভেবে রেখেছি একদিন তুমি কীভাবে যেন আমার কাছে ফিরে চলে আসবে, জানিনা কীভাবে আসবে, ভেবে রেখেছি কোন এক সন্ধ্যায় কাদের মোল্লার ফাঁসির সংবাদে আমি পাগল হয়ে কোথাও চলে যাবো। সাথে তোমার চারটি প্রেমের চিঠি নিবো, চিঠিতে কিছু ইতিহাস লেখা আছে।
সব শ্রম, ঘামের হিসাব, কন্ঠস্বরের পাওনা, প্রেমিকা হারানো, সেমিষ্টার ড্রপ দেয়া, রিকশাওয়ালা মামার ছাড়, শিশুর নতুন জ্ঞান, হাজার মানুষের সময়ের হিসাব দিয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হল। তোমার বিরহে কাতর আমি এতটুকুও খুশী হইনি। আমি জানি আমি জীবনে কিছুই পাইনি, পাওনা গুলো পাবার আগেই কেমন করে যেন ফাঁকি দেয়। আমি কনফিউজড, আমি জানি গন্তব্য শেষ হবে না। কাদের মোল্লা কাদের সাহেব হয়ে যাবেন। তোমাকে হারানোর পাশাপাশি আমি সকল রকম আত্নবিশ্বাস হারিয়ে বসে আছি। হোক আগে কাদেরের ফাঁসি, তারপর দেখা যাবে।
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর বারো তারিখ, ২০১৩ সাল। শীতের সন্ধ্যা। আগের রাতে কাদেরের ফাঁসি হবার কথা। বৈদেশিক চাপে হয়নি। ঢাকার রাস্তায় নিরাপত্তাহীনতা, মানুষ যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ঢুকছে। তুমিও হয়ত তোমার স্বামীকে নিয়ে চিন্তা করছো। বেচারা অফিস শেষে এত দেরী করছে কেন? পথে কোন বিপদ হয়নিতো? আজ রাত দশটায় ফাঁসি হবে। হুম সত্যিই ফাঁসি হবে। ঐ যে বাংলা ছায়াছবিতে যেভাবে দেখতাম, জল্লাদ এসে কী যেন টেনে দেয় আর পায়ের নিচে ভর দেবার জায়গাটুকু সরে যায়। ঠিক সেভাবেই ফাঁসি হবে। একাত্তরের সব রক্ত, সব আত্না একসাথে কথা বলে উঠছে। হুঙ্কার দিয়ে উঠছে ধর্ষণ হওয়া মা বোনেরা। আমি রিকশায়, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে “ফাঁসির মঞ্চ উদ্বোধন করা হয়ে গেছে, এখন কেবল চলতে থাক। জয় বাংলা”
আজ উঠি, ছেলে ডাকছে। ওর সাথে আজ শাহবাগ যাবার কথা। শরীরটা আগের মত নেই, একটু খানিতেই হাঁপিয়ে উঠি। তবুও যাই, বুড়ো বুড়ো পরিচিত মানুষগুলোকে দেখলে ভাল্লাগে, যে ছেলে-মেয়েগুলো কালো চুল দাড়ি নিয়ে ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ শাহবাগে এসেছিলো তাদের আজ শরীর জুড়ে বয়স, মাথার চুল পেঁকে সচ্ছ্ব সাদা, কারো বা মাথায় একটি চুলও নেই। একটি রাজাকারও নেই দেশে। ভাবতেই ভাল্লাগে দেশে একজনও নেই যে স্বাধীনতা বিরোধী, যে বলে পাকিস্তানের সাথে থাকলে আমরা অনেক ভালো থাকতাম। আমার গর্ব হয়, আমার বুড়ো শরীর খুশীতে নাচন উঠে, দেশের সবাই আমরা মানুষ! ইশ! তুমি নেই!
ইতি
অমিয় অয়ন