হোসেন আলীর কপাল সব সময় খারাপ,বন্ধুরা যখন চিকন কোমরের সুন্দরী প্রেমিকা পটিয়ে এদিক ওদিক ডেটিং এ যায় তখন হোসেন আলীর প্রেমিকার সামনের দুটা দাঁত উঁচা থাকে। এ নিয়ে মন খারাপ হলেই হোসেন আলী বিড়ি ধরায়। বিড়ি গরীবের নেশা,যদিও সে বিড়ি খাবার মত গরীব না তবুও সিগারেটের দামের সাথে কুলাতে পারে না। বিড়ি খাবার অবশ্য আরও সুবিধা আছে। অন্যদিকে খরচ ভালোভাবে করা যায়। অবশ্যই দাঁত উঁচা প্রেমিকার সাথে থাকলে ষ্টার খায়।এটাও অসম্মানজনক ব্যাপার। ষ্টারে সম্মান নাই সম্মান বেনসনে।
তখন হোসেন আলীর পকেটে টাকা ছিলো।মেট্রিক পাশ করে একটা ভালো হোটেলে বয়ের চাকরী পেয়েছে সদ্য। বন্ধু বান্ধবের সাথে নতুন মেসে উঠেছে। বাজারে গিয়ে সবচে দামি ফ্যানটা কেনার পরও দেখা গেল হোসেন আলীর ফ্যানের বাতাস সবচে কম।রাগে দুখে ক্ষোভে ঢাকা ছাড়ার সময় ফ্যানটা নিয়েই আসেনি। ঢাকা ছাড়ার সময় নাক উঁচা প্রেমিকাকে ছেড়ে এসেছিলো, আজ তার চিঠি এসেছে। এজন্যই হোসেন আলী তার কপাল খারাপ ব্যাপারটা নিয়ে নতুন করে ভাবছে।
টানা তিন দিনের বৃষ্টি,এই বন্যা হয়,এই পানি কমে গিয়ে আবার বন্যা হয় হয় অবস্থা। নিদিনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে কোমর পানি।স্কুলের বারান্দাটা খুব উপকারী। এখানে বিড়ি টানলে আশপাশ থেকে খেয়াল করা যায় না।কোমর পানিয়ে পেরিয়ে হোসেন আলী এসেছে বিড়ি টানতে,চুপিচুপি চিঠি পড়া যাবে এটাও একটা কারণ।চিঠি খোলা হয়..কাগজের ভাজে গোলাপ ফুল। লাল গোলাপ,তবে কালো হয়ে গেছে। এটাও হোসেন আলীর কপাল খারাপের একটা নমুনা।
প্রিয় আলী,
সম্বোধন পড়ার সাথে সাথে একটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠলো পানি থেকে।প্রেমিকার নাম আয়েশা,আয়েশা বেগম হোসেন আলীকে কেবল আলী ডাকতো।
প্রিয় আলী,
কেমন আছ? বন্ধুর সাথে দেখা না হলে বন্ধুর লাগে না ভালো।বন্ধু আমার কই গেছে? তুমি কেন চলে গেছ? মনে নাই আমারে? ভুলে গেছ একদম? কি হইত চাকরীটা করলে? বিয়ে করবে বলছিলা,সেটা না হয় না করতা। ভালোতো বাসতাম। বিকালে সাহেবদের জন্য মোগলাই আনতে গিয়েতো একবার দেখা হতো।চোখ টিপ দিলে লজ্জা পেতে? আমি কি চাইছি বিয়ে করো। ভয় পাও কেন? সবাইর সামনে ঠোঁটে কিস করবা বলছিলা,লজ্জায় সেটাও পারলে না। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না বলতাম না? হইছে কিচ্ছু?
ভালো কথা শোন,আমি আগামি ১৫ তারিখ তোমাদের গ্রামে আসবো। একা একা। ঠিকানা কালেকশন করছি তোমার হোটেলের ম্যানেজার থেকে
ইতি
তোমার প্রিয়া
আয়েশা বলেছিলো তাকে প্রিয়া ডাকতে। হোসেন আলী তাই প্রিয়া ডাকতো। প্রিয়া ডাকলে নাকি তার মনে হতো নায়ক রিয়াজ তাকে ডাকছে। শাবনুরের মত সে বুকে চলে আসবে। চিঠির বানান অনেকভুল। তবে ভুল ধরার সাধ্য হোসেন আলীর নাই। আপাতত টেনশন হবার কথা। আজকে ১২ তারিখ ,১৫ তারিখ আয়েশা আসবে। কিন্তু যতটা টেনশন হবার কথা ছিলো ততটা হচ্ছে না। ব্যাপারটা রহস্যজনক। বিড়িতে আরেকটা টান মেরে লাফ দিয়ে উঠা ব্যাঙটাকে আচ্ছামত একটা কিক লাগিয়ে বন্যার পানিতে আবার পাঠিয়ে দিলো।আয়েশা মেয়ে ভালো,গায়ের রঙ উজ্জল শ্যামলা,ঠোঁট পাতলা। শুক্রবারে চোখে কাজল দেয়,শনিবার চুলে ডাব শ্যাম্পু মাখে,রবিবার চুলে ফিতা দেয়। লাল ফিতা তার বিশেষ পছন্দ। হোসেন আলী তাকে দুইবার লাল ফিতা কিনে দিয়েছিলো। সোমবার আয়েশা কিছুই করতে পারে না,সেদিন খুব বেশী ব্যস্ত থাকে।মঙ্গলবার লিপিষ্টিক দেয়,লাল লিপিষ্টিক! বুধবার শাড়ী পরতে চায়। তবে কাজের মেয়েদের শাড়ী পরাতে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই পরা হয় না। তবে রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি শাড়ী পরে আয়না দেখে।বৃহস্পতিবার বিশেষ দিন, কারন বৃহস্পতিবার হোসেন আলীর সাথে তার দেখা হয়! সেদিন সে মেকাপ নেয় না।হোসেন আলীর মন খারাপ। এতদিন পরে ভেবে বের করলো আয়েশা তাকে ভালোবাসে না। বাসলে দেখা করতে আসার সময় সাজগোজ করে না কেন?
বৃষ্টির দিন দোকানে বসে তাস খেলছে রতন,জব্বার,রবিউল আর মফিজ। হোসেন মিয়া বিড়িটা জ্বালিয়েই বলল “বুঝলি মাইয়া মানুষ বিরাট গ্যাঞ্জাইম্মা,তারে তুই চাইলে সে আইবো না,কিন্তু সে যখন আইবো তোর বারোটা বাজায়া দিবো”
“কি হইছেরে হোসেন” বলল মফিজ
“হইছে ঘোড়ার ডিম,আয়েশার কথা কইছি না? হে আমার বাড়ীতে আইতাছে”
বন্ধু সে যেই শ্রেণীর হোক না,বন্ধুর প্রেমজনিত বিপদে হো হো করে হাসবে।সুতারাং এখানেও অট্টহাসি।হলুদ দাঁত বের করে জব্বার বলল “কিরে হালা সত্য কইরা ক তো ফষ্টিনষ্টি করছস নাকি?
“ধুর হালা” রাগত স্বরে হোসেন আলী
“তাইলে কি সুখ দিছস যে ঢাকা থেকে গ্রামে চইলা আইতেছে? রতনের প্রশ্ন এবং স্বাভাবিকভাবে হো হো হাসি।একটু আগের দেয়া লাল চা ওয়াক থু বলে ফেলে দেয় হোসেন আলী।আয়েশা লাল চা খুব ভালো বানাতো।একবার তার বাড়ীর মনিবরা সপরিবারে কোথায় যেন দাওয়াত খেতে গিয়েছিলো সেবার প্রথমবার আয়েশার হাতে চা খেয়েছিলো হোসেন আলী। এরপর সাহেবরা কোথাও গেলেই সে চা খায়। অঘটনাটা চা খেতে গিয়েই হয়েছে।হোসেন আলী উদাস হয়ে যায়। ফষ্টিনষ্টি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবে,কতটুকু করলে আসলে ফষ্টিনষ্টি? আনমনে মুখ ফুটে জিজ্ঞাসাও করে ফেলে। আবার হো হো হাসি। মফিজের প্রশ্ন “কতটুকু কইরা আইছস? আবার মন খারাপ হয়ে যায়। এসব বলার জিনিস না,বন্ধু বান্ধব শ্রেণীটা লজ্জাহীন শ্রেণী।প্রথমে জিজ্ঞেস করে হাসি ঠাট্টা করবে। না বললে খোঁচা দিবে,বললে ছড়িয়ে দিবে চারিদিকে।আড্ডা ছেড়ে উঠে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়,দুপুর শেষের দিকে বৃষ্টির দিনে বুঝা যাচ্ছে না। ভাত খেতে হবে।
মমতাজ বেগমের মুখ সারাক্ষন চলে। মা হলেও হোসেন আলী প্রচন্ড বিরক্ত হয়। ভাত বাড়তে বাড়তে বলেই যাচ্ছেন “ইচ্ছা আছিলো পোলারে বিয়া করামু,পোলা ইনকাম কইরা খাওয়াইবো,বিয়া করবো,নাতীরে লইয়া কোমরে মুন্সী বাড়ীতে যাইয়া গফ দিমু। পোলা না হইলে লাউ না হইছে কদু”
-আম্মা থামবানি?
-ক্যান থামুম? ক্যান থামুম? মুন্সীর নাতি দেখছস,আইজকা বন্যায় ভিজতে ভিজতে আইছিলো। কি যে সোন্দর! তুই ইনকাম করলে তোরও একটা পোলা থাকতো। খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়। আবার তার মন খারাপ।উঠে যেতেই বাবার মুখোমুখী। মায়ের মত কথা না বললেও রহম আলীর চোখ দিয়ে সব কথা বলে দেন। এবারো তার চোখের দৃষ্টি মায়ের কথার অনুবাদ। মোদ্দা কথা হোসেন আলী অথর্ব।আবার তাসের আড্ডার দিকে রওনা হয় সে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি,রাস্তায় আবার পানি জমতে শুরু করেছে। দেখা হয়ে গেল নুরুর সাথে “হোসেন ভাই বৃষ্টি কেমুন?
-ছাতার বৃষ্টি!
-হ ভাই ছাতার বৃষ্টি,রইদে মাইনষে ছাতা ব্যবহার কইরা ছাতার অসম্মান করে।
-মাছ পাইছো?
-হ আগামি এক সপ্তা নো চিন্তা,বন্যা ভালো জিনিস,খালি পানি একটু বেশী।নইলে খুব ভালো।
নুরুর সাথে গল্প করে বিশেষ মজা পায় হোসেন আলী। জ্ঞানী মানুষ টাইপ কথা বার্তা।গ্রামের দুষ্টু ছেলেপেলেরা বেজ্ঞানী ডাকে। অবশ্য ডাকার যথেষ্ঠ কারণ আছে।সেটা ৯৮ এর বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনের কথা। ব্রাজিল আর ফ্র্যান্সের খেলা। পুরো গ্রামে টানটান উত্তেজনা। বাজারের মত জায়গায় বেশ কিছু দোকান আছে।প্রতিটি দোকানে উড়ছে ব্রাজিলের পতাকা।যেসব দোকানে আর্জেন্টিনার পতাকা ছিলো বাদ পড়ার পর নামানো হয়েছে। আর্জেন্টিনার সবাই ফ্রান্সের সাপোর্টার কিন্তু ফ্রান্সের পতাকাতো বাজারে নাই।কেউ চিনেও না ফ্রান্সের পতাকা দেখতে কেমন। এর মধ্যে নুরু পত্রিকা দেখে সেলাই করে ফ্রান্সের পতাকা বানিয়ে ফেলল।এই নিয়ে গ্রামে তুলকালাম কান্ড। আর্জেন্টিনার সাপোর্টারদের মধ্যমণি হয়ে গেল নুরু। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো সন্ধ্যায়। গ্রামের একমাত্র টিভিতে ছবি আসছে না। এদিকে তুমুল বৃষ্টি,আশেপাশের একমাত্র টিভি মেকানিকের দোকান ছয় কিলোমিটার দূরে। রাস্তা পানিতে ডুবানো।পুরো গ্রামে হাহাকার অবস্থা। আবার এগিয়ে এলো নুরু। সন্ধ্যা থেকে বিরাট কারিগরি শুরু করলো।রাত দশটার সময় হঠাৎ টেলিভিশনটা ঠিক হয়ে গেল।খেলাশুরু হবার আগেই মিছিল। তবে হোসেন আলী রহস্যটা জানে। নুরু তাকে বলেছিলো একদিন “আসলে বুঝছেন হোসেন ভাই,সেদিনতো টেলিভিশন ঠিক করুম বইলা নিয়ে আসলাম।কিন্তু আমিতো কিচ্ছু জানিনা। বিরাট মান ইজ্জতের ব্যাপার। এটা গুতাই ওটা গুতাই।মাগার ঠিক হয় না। শেষে রাগ কইরা টেলিভিশনের উপরে দিলাম এক বাড়ি। ওমা ছবি দেখা যায়”। হোসেন আলী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো নুরুকে সব খুলে বলবে। টেনশন বলে দিলে টেনশন থাকে না,পানি হয়ে যায়।
টিনের ছালে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। নুরু আরেকটা স্টিক বানিয়ে হোসেন আলীর দিকে বাড়িয়ে দিলো। বিজ্ঞানী হলেও এই বাজে অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনি। গ্রামে আড়ালে অবড়ালে তাকে গাঁজাখোর ডাকলেও সে বিশেষ পাত্তা দেয় না। বিজ্ঞানীরা একটু এরকম হয়।
-বুঝছেন ভাই নেশা একদম উঠে গেছে
হোসেন আলীর চোখ ঘোলা ঘোলা,বৃষ্টির শব্দ ছাড়া কিছুই কানে আসছে না।নুরু বলেই যাচ্ছে “নেশা ভাই প্রার্থনার মত যতক্ষন আপনার সাথে থাকবে,আপনাকে নিয়েই থাকবে”। কথায় যুক্তি আছে,তবে যুক্তি শুনে লাভ নেই। আয়েশার উঁচা দাঁত চোখের সামনে ভাসছে “নুরু চলো বৃষ্টিতে ভিজে হাঁইটা আসি”
-মনের মতন কতা কইছেন ভাই!চলেন
-নাহ থাক তোমার যাবার দরকার নাই। আমি একলাই ভিজুম।
-আইচ্ছা মালটা শেষ করেন!
হোসেন আলী স্টিকের দিকে তাকলো,হ্যাচকা টান দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা উঠানে।ঝুমঝুম বৃষ্টি,উঠান সামান্য পিচ্চিল। পিচ্চিল হয়ে লাভ নেই,ভিজতে গেলে ভিজে যেতে হয়,প্রয়োজনে মরে যেতে হয়।হাঁটা শুরু করলো।
কতক্ষন ভিজেছে মনে করতে পারছে না। ভোরের আলো ফুটেছে। গায়ে জ্বর,মাঠের পাশের স্কুলের বারান্দায় নিজেকে আবিস্কার করে অবাক হলো না হোসেন আলী।বাড়ীর দিকে রওনা দিলো।
আজ ১৫ তারিখ। আবার হোসেন আলীর মন খারাপ। সাথে কপালও খারাপ। আয়েশা আসবার কথা। কিন্তু তার গা গ্রীষ্মের কাঠ ফাটা গরম। মেয়েটা যদি চলে আসে কি হবে? মা নিশ্চিত ঘর থেকে বের করে দিবে। জ্বর দেখবে না,বাবা কথাই বলবেন না। ভালো টেনশনের বিষয়।ঢাকা ছাড়ার চার মাস হতে চললো। নাহ! আর বসে থাকা যায় না।ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ মেয়েটাকে ওখানেই থামাতে হবে।দাঁত উঁচা মেয়ে মা পছন্দ করবে না।এটা নিয়ে আয়েশার সাথে একবার ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিলো।হোসেন আলী বলেছিলো “অনেক টাকা হইলে অপারেশন কইরা তোমার দাঁতগুলা সমান কইরা দিমু” আয়েশা চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলো “দাঁতের লগে সংসার করবা,না দাঁত থিকা বাচ্চা বিয়াবা? লজ্জায় এক সপ্তাহ দেখা করে হোসেন মিয়া। বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবার সময় মা চিৎকার করছিলো “এই জ্বর নিয়া যাস কই? হোসেন আলী উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে যায়। পিছনে মমতাজ বেগম বকেই যাচ্ছেন ““ইচ্ছা আছিলো পোলারে বিয়া করামু,পোলা ইনকাম কইরা খাওয়াইবো,বিয়া করবো,নাতীরে লইয়া কোমরে মুন্সী বাড়ীতে যাইয়া গফ দিমু…”
তিনমাস হয়ে গেছে,হিসাব মতে এখনই সময়। আয়েশাকে এভাবে ছাড়া উচিত হবে না। আর যাই হোক মায়ের ইচ্ছার মূল্যতো দিতে হবে।হোসেন আলী বাসে বসেই সিদ্ধান্ত নেয় আয়েশাকে নিয়ে সোজা বাড়ীতে চলে আসবে,মায়ের সামনে দাড়িয়ে বলবে “মা তোমার না নাতির সখ? লও এই দাঁত উঁচা মাইয়াটার পেটে আমার বাইচ্চা আছে।৪ মাস হইয়া গেছে।মুন্সী বাড়ীতে কখন যাইবা সিদ্ধান্ত লও”