একটু আগেই রাতে জাগা নিয়ে ছিমছাম একটি ব্লগ পড়লাম। বেশ ভালো লাগলো। ‘রাত জাগা’ ব্যাপারটা আসলেই খুব ভালো লাগার। সারাদিনের কর্মক্লান্ততার পর, রাত যেন নিজের হয়ে আসে। শুধুমাত্র নিজের।
স্কুলে যখন পড়তাম, খুলনা শহরের কোন এক গলির শেষ প্রান্তে ছিলো আমাদের বাসা। সমস্ত গলি ঘুমে তলিয়ে গেলেও রাত জেগে পড়তাম। সকালে পড়তে পারতাম না যে! জানালা খুলে দিলে আসতো হু-হু বাতাস। যেন হাড়ের উপর সরাসরি কোমল ছোঁয়া লাগিয়ে দেবার অনুভূতি। এক বাসা ডিঙ্গিয়ে পাশের বাসায় গরু পুষতো। দো’তলার জানালা দিয়ে আমার দৃষ্টি তখন পাশের একতলা বাড়ির ছাদ টপকে শুধু গরুটিকেই দেখতো। গরুটাই তখন রাত জাগার একমাত্র সাথী। নানা’কে তাই গোটাগোটা অক্ষরে চিঠি দিয়েছিলাম, “সারা পাড়ায় আমি আর গরুটা ছাড়া আর কেউ জেগে নেই।” শুনে সবাই খুব হেসেছিলো! তাতে কী? ‘আর্লি-টু-বেড’ মেনে চলা পুরো চেনাজানা-স্বজনে নানা-ই যে রাতজাগা-ভালোলাগা একমাত্র মানুষ তখন। অন্য কাউকে কী ভাবে লিখি একথা?
এখন আমার ঘরটা অনেক বড়। পাশের ঘরটা আরও বেশি বড়। সেটি ফাঁকা থাকে। কখনও কখনও অনেক রাত ধরে আমার একা একা হেঁটে বেড়াবার অনেক প্রিয় জায়গা হয়ে পড়ে এ দু’ঘর। আটপৌরে জীবন, তার বোধগম্যতা বা বোধহীনতা, কিংবা অনিশ্চিত ভবিষ্যত- এসব নিয়ে বিছানায় গিয়ে চিন্তা করতে গেলেই ঘুমিয়ে পড়ি। হেঁটে হেঁটে ভাবলে, সেই ভয়টা থাকেনা। ভাবনাগুলো ডানা মেলে ইচ্ছেমত। কখনও বারান্দায় যাই। দিনের বেলা যে টবগুলোর দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর সময় পাইনা, সেগুলোর উপর জন্মানো গাছগুলোকেই ছুঁয়ে দেখি। ভালো লাগে। কখনও অনেক রাতে বন্ধুদের ফোন করি। প্রায় সবাই এখন নিদ্রাদেবীর কোলে মাথা রাখে-দেহ রাখে বিছানায়। তবুও, কেউ কেউ জেগে থাকে। যেমন, ব্লগার অদ্ভুতুড়ে ! মাসের মধ্যে অনেকগুলো রাত অফিসে কাটায় সে-নাইট শিফট থাকলে, কখনও তাকে ফোন করা হয়। গল্প হয়। পাশের বাড়ি কোন বাচ্চাও কেঁদে ওঠে কখনও। মা তার তাকে শান্ত করার জন্য ফিসফিস করে ওঠেন। ক্রমশ সেটিও মিলিয়ে যায়। কুকুরের ডাক শোনা যায়। বাসাটা মেইন রোডে না হলেও কেন জানি সারারাতই মানুষ চলে সামনে। গাড়ি চলে। রাতপ্রহরীর বাঁশি বাজে। তারা আমার জানালার নিচেই বিড়ি ফুঁকে। অন্ধকারে ভালো দেখিনা তাদের। ঈদের বখশিসের মৌসুমেই শুধু দিনের চেহারায় দেখি তাদের। গত শীতে এক পাগলী এসে জানালার নিচে ইচ্ছে মত কী সব জানি বলতো। শুনতাম। বাসার সবার ঘুমের সমস্যা হতো। আমার হতনা। ঘুমিয়ে পড়লে পৃথিবী দুলে উঠলেও হয়তো টের পাবোনা হয়তো। ক্লান্তিসুখের ঘুম! সুখী মানুষ? পাগলীটা এখন আর আসেনা। মনে হয়, সে সেই সব পাগলদের একজন-যারা শুধু শীতকালেই পাগলামো করে।
আমার পিসিতে একটা গানের ফোল্ডার আছে- ‘তন্দ্রাহারা রাত’। পুরনো দিনের বাংলা গানের ছোট্ট একটা সংগ্রহ। নিস্তব্ধতা আরও নেমে এলে চালিয়ে দিই উইন্যাম্প-এ। শাফল মুডে বাজতে থাকে, যতক্ষণ আমি জেগে থাকি, কিংবা যতক্ষণ ইলেকট্রিসিটি থাকে। ইউপিএস নেই যে আমার! ইলেকট্রিসিটি’র যাওয়া আসাটা আমার রাতের রুটিনকেও পরিবর্তন করে দিয়েছে। রাত দশটায় সে চলে গেলে ঘুমিয়ে পড়ি। কখনও রাত শেষ হবার ঠিক আগের প্রহরে উঠে পড়ি। নেটে ঘুরি। ব্লগ পড়ি। গান শুনি। কখনও একবারে সকালটাকেই দেখি।
গানেরও হাজার রকম পছন্দভেদ আছে। কত ধরণের গান। কত ধরণের শ্রোতা। তবে বিরহের গানগুলো-ই মনে হয় বেশির ভাগ শ্রোতার মন ছুঁয়ে যায়। ‘তন্দ্রাহারা রাত’ ফোল্ডার থেকেই একটি গান। গানের গলা- খুব সম্ভবত হৈমন্তী শুক্লা’র।
গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে
দূর গগনে প্রিয় তিমির পারে।।
জেগে যবে দেখি হায় তুমি নাই পাশে
আঙ্গিনায় ফোটে ফুল ঝরে পড়ে আছে।।
বান বেঁধা পাখি সম
আহত এ প্রাণ মম
লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে অন্ধকারে
দূর গগনে প্রিয় তিমির পারে।।
গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে।
মৌন নিঝুম ধরা, ঘুমায়েছে সবে
এসো প্রিয় এই বেলা বক্ষে নিরবে
কত কথা কাঁটা হয়ে বুকে আছে বিঁধে
কত অভিমান কত জ্বালা এই হৃদে
দেখে যাও, এসো প্রিয়
কত সাধ ঝরে গেলো
কত আশা মরে গেলো হাহাকারে।
গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে
দূর গগনে প্রিয় তিমির পারে।।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৩:১৪