দক্ষিণেশ্বর থেকে আনা লাল সুতা হাতে দেখে আর্মি মেডিক্যালের AFMC-তে AMC কোরে ভর্তি পরীক্ষায় শেষ ধাপের আগে আমাকে বাদ দেয়া হয়। আজ ঢাবির জগন্নাথ হলের এক ছাত্রের হাতে লাল সুতা দেখে গণধোলাই দিয়েছে 'মার্চ ফর ফিলিস্তিন'-এ অংশ নেওয়া তৌহিদী জনতা। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
উক্ত অভিজ্ঞতাটি এতোদিন শেয়ার করিনি, কারণ আমি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, এমন কিছু হতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার বাবার আসল নাম কমল কৃষ্ণ গুহ হলেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধা একাত্তর সাল থেকেই কবি বাবু ফরিদী নামে পরিচিত। তাঁর রহস্যজনক অকালমৃত্যুর পর সবাই অবাক হয়েছিলো তাঁর লাশ শ্মশানে নিতে দেখে। তো, আমার সাথে হয়ে যাওয়া উক্ত বে-ইনসাফিতে আমার এই চির-অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বাবাও অসম্ভব রকমের ভেঙে পড়েছিলেন। পরের বছরই মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তাঁর রহস্যজনক অকালমৃত্যু হয়।
অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে ISSB এর আগের ধাপে IQ Test হয়। সেই ধাপের পরীক্ষা ছিলো সেদিন আমার। অতি সম্প্রতি জীবনে প্রথমবার চিকিৎসার্থে বাবার সাথে ভারত গিয়েছিলো মা Krishna Guho। ফেরার পথে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির থেকে আমার জন্য লাল সুতা এনেছিলেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান আমি, ঢাকায় একা থাকি। আমার যাতে কোনো অনিষ্ট না হয়, তাই সুতাটি মা হাতে বেঁধে দেন। আমিও সরল বিশ্বাসে জীবনে সেবারই প্রথম লাল সুতা হাতে পড়ি আর বরাবরের মতো শার্টের হাতা গুটিয়ে পরীক্ষা দিতে যাই। কে জানতো এটা দেখে আমাকে বাদ দেবে আর তখন ২০০৭ সালেও হিন্দুদের সেনাবাহিনীতে নিতে চায় না? এখন মনে হয় এটা আমার এলাকার শত্রুদের ষড়যন্ত্র হতে পারে, কেউ হয়তো এই বুদ্ধি দিয়েছিলো মাকে, যাতে আমি আটকে যাই। আজ জিজ্ঞেস করলে ১৮ বছর পর মা বুদ্ধিদাতাকে ঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে না।
যাহোক, IQ Test এর আগে একটা টেবিলে বসা দুজন আর্মি অফিসার আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কেন হাতে লাল সুতা পড়েছি। আমি উত্তর দেই, "এটা আমার মা হাতে পরিয়ে দিয়েছেন, যাতে আমার কোনো বিপদ-আপদ না হয়। ঢাকায় একা থাকি তো!" আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোথা থেকে আনা হয়েছে সেটা। আমি সরল বিশ্বাসে বলে ফেলি, "ভারতের দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির থেকে"। তারপর তাঁরা নিজেদের মাঝে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকেন। তাঁদের একজন আমাকে পালটা প্রশ্ন করেন, " তুমি কি এগুলো বিশ্বাস করো?" অবস্থা বেগতিক দেখে আমি বলতে বাধ্য হই, "না, মা দিয়েছে তাই পরেছি। আমি অতোটা ধর্মভীরু নই। আপনারা বললে খুলেও ফেলতে পারি"। তখন পাশেরজন মুচকি হেসে বলেন, "থাক, যাও। লাগবে না"।
এরপর অনেক ভালো পরীক্ষা দিলেও আমার নামটা উত্তীর্ণের তালিকায় আসেনি। আমার আশংকাই সত্যি হয়। আমি খুব ভেঙে পড়ি, ফোনে বাবাকে জানানোয় বাবার মতো 'জিরো থেকে হিরো' হওয়া চূড়ান্ত রকমের জীবন সংগ্রামী মানুষটাকেও আমি কাঁদতে শুনেছি। আমি তখন ভীষণ অসুস্থ, সরকারি মেডিক্যালেও ০.৫ মার্কের জন্য টিকিনি। নটরডেম কলেজ থেকে দ্বিতীয় এ প্লাস নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, বাবা-মাসহ সবার প্রত্যাশার পারদ ছিলো তুঙ্গে। এই আর্মি মেডিক্যালের নানা ধাপ পেরিয়ে ঐ পর্যন্ত যেতে আমার ২ মাস সময় নষ্ট হয়, ঐ সময়টায় আর অন্যত্র পরীক্ষা দিতে পারিনি। অনেক ভর্তি পরীক্ষা আর্মি মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার সময়ের সাথে মিলে যাওয়ায় বাদ দিতে হয়। পরে বাকৃবিতে কৃষি প্রকৌশলে ভর্তি হই। মন খারাপ থাকায় সেখানেও চয়েজ লিস্ট পূরণের ভুলে ঐ বিষয় পাই।
এর আগে নটরডেম কলেজে পড়াকালীন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ বিদ্যার্থী ভবনে ছিলাম। তারা এইচএসসি শেষ হতেই হোস্টেল থেকে সবাইকে নামিয়ে দেয়। আমার স্কুলের বন্ধু বলাই কর্মকার কথা দিয়েছিলো হোস্টেল থেকে নামিয়ে দিলে ভর্তি পরীক্ষার আগের ৩ মাস ওর ভাড়া করা শ্যামলীর ফ্ল্যাটে থাকতে পারবো। কিন্তু হোস্টেল ছাড়ার আগে আগে ও আমাকে মিথ্যাকথা বলে যে বাড়ির মালিক নাকি আমাকে উঠতে দেবে না। পরে মালিকের কাছে গিয়ে মাসহ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, বলাই তাঁর সাথে আলাপই করে নাই। নটরডেম কলেজ থেকে এ প্লাস পাওয়া ছেলে তাঁর ফ্ল্যাটে থাকলে তিনি বরং খুশিই হতেন। এরপর জীবনের মহাগুরুত্বপূর্ণ তিনটি মাস আমাকে তিন জায়গায় থাকতে হয়। সেসব জায়গার একটি ঢাকার মহাপ্রকাশ মঠ, সেখানেও আমার বাড়ির পাশের শ্রী অঙ্গনের মতো শব্দদূষণ করে, নানা টর্চার করে আমাকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলে। এসব কারণেও বাবা অনেক ভেঙে পড়েছিলো। কারণ বাবা নিজেই বাকৃবিতে চান্স পেয়েও অসুস্থ মায়ের নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারেননি। আমার পেছনে এত শ্রম-অর্থ ঢালার পরেও আমিও সেই বাকৃবিতেই যাচ্ছি-- এটা বাবা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। পরের বছরই শ্রী অঙ্গন দক্ষিণ পল্লীতে ৩নং গলিতে ননী গোপাল সরকারের বাসার দোতলায় বাবার লাশ উদ্ধার হয়।
যাহোক, আমার জীবন থেমে থাকেনি। এরপর অসুস্থ বিধবা মায়ের খেয়াল রাখার সুবিধার্থে, বাড়ি থেকে কাছে হওয়ায় এবং টিউশন-লেখালেখি করে সংসার চালাতে পারবো ভেবে বাকৃবি ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ফরিদপুর ও ঢাবির জগন্নাথ হলে অনেক নির্যাতন সয়েও দুটি প্রথম শ্রেণি নিয়ে উত্তীর্ণ হই। ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রথম আলোর মতো প্রতিষ্ঠানে নিজ গুণে লেখালেখি-সাংবাদিকতা করি ৭ বছর, এরপর প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেই। বলছি না হিন্দু আবার নামের মাঝেই 'দেব দুলাল' আছে বলেই আর্মিতে চান্স পাইনি বা প্রশাসন-ফরেইন ক্যাডার পাইনি। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি। আফসোস নেই, আবার আছেও। সেদিন শত্রুদের বুদ্ধিতে আমার সহজ-সরল মা আমার হাতে লাল সুতাটা না পড়ালে হয়তো আজ বন্ধু Irad এর মতো আমিও আর্মির মেজর থাকতাম, বিনা চিকিৎসায় মায়ের মৃত্যু দেখা আমার বাবা আমাকে ডাক্তারি পড়তে দেখে হয়তো আজ বেঁচে থাকতো! আমার জীবনটাও হয়তো আরেকটু সুন্দর হতো!
দেব দুলাল গুহ।
[উক্ত ছাত্রের আজকের অভিজ্ঞতার লিংক: https://www.facebook.com/share/p/1AhzToLH6Q/ ]