(লেখাটা বড় হলেও পড়ে দেখার আমন্ত্রন জানাই) বিএনপি নিয়ে কিছু লিখতে বা বলতে আমার নিজের মায়া হয় (যদিও লিখছি সাহস করে কারন বিএনপি উগ্র দল নয় বা আমাকে মেরে ফেলবে না, কেইস দিবে না ভেবেই), কারন বিএনপির প্রধান অফিসের কাছাকাছি আমি গত প্রায় ১৫ বছর ধরে আছি, আমি গত এই সময়ে দলের প্রায় প্রতিটা সমাবেশ নিজ চোখে দেখেছি, সাহসী নেতা কর্মীদের দেখেছি, লীগের পুলিশ দিয়ে এদের কি নির্মম পিটানো, ধরা, গুলি প্রায় সবই দেখেছি। লীগ এদের প্রতি কি অত্যাচার করেছে তা তো দেশবাসী সবাই জানে, হত্যা গুম খুন আহত করা সবই আমাদের চোখের সামনে। এই অত্যাচার সইতে সইতে বলা চলে পুরা দেশবাসীর সহানুভুতি তারা পেয়েছিল, নিরপেক্ষ লোকজন এদের পক্ষেই কথা বলত, নিশ্চিত ভোট সুষ্ঠু হলে এই দল ক্ষমতা পেতেই পারত।
লীগের প্রধান বক্তিতায় বলেছিলেন, প্রতিটা গ্রামে গ্রামে যারা বিএনপি করে তাদের লিষ্ট নিয়ে ধরে ধরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে, ঘর বাড়ি ভেঙ্গে দিতে। প্রায় ১৬ বছর বিএনপির সধারন কর্মীরা কি কষ্ট করেছে তা যারা গ্রামে গঞ্জে যান নাই তারা ছাড়া সবাই দেখেছে। কত গুম খুন হারিয়ে যাওয়া সমর্থক নেতা এই দলে ছিলেন/আছেন, তা বলা বাহুল্য।
শিক্ষার্থী জনতার আন্দোলনের ফলাফল এখনো এই দলের কাছেই বেশী, কারন তারাও দেশবাসীর সাথে মুক্তি পেয়েছে, তারাও বুক ফুলিয়ে এখন রাস্তায় বের হতে পারছে। তবে এই কয়েক মাসে তারা সাধারন মানুষের সমর্থন হারিয়েছে, মানুষ এখন আর তাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। কারন অনেক তবে আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন আমি নিন্মের কয়েকটা কারন বলবো।
১। লীগের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং তাদের পূর্নবাসনে আগ্রহ দেখানো। এত সাধারন মানুষের মনে একটা বদ্ধমূল ধারনা এসেছে যে, তারাও ক্ষমতায় গেলেই সেই একই কাজ করবে, যা লীগের নেতা কর্মীরা করেছে। কুমিল্লায় এক বিএনপি সমর্থক প্রার্থীকে দেখলাম তিনি তার অফিসের লিখেছেন, 'লীগের সাথে যার সামান্য সম্পর্ক আছে, তিনি বা তারা যেন তার অফিসে প্রবেশ না করেন'। বিএনপির উর্ধ নেতারা যদি এই সামান্য নেতার মত ঘৃণাও প্রকাশ করতেন তবে অনেকেই মুখ ফিরাতো না।
২। বিএনপির মাঝারি নেতা, সমর্থকেরাও উচু নেতাদের আচরণে মনঃকষ্টে আছেন, তাদের এক্টিভিটি নেই বললেই চলে। আগে যাদের মিছিল মিটিং করতে দেখতাম তাদের দেখে বুঝা যেত, এরা টাকার জন্য মিছিলে আসে নাই, এসেছে ভালবাসার টানে। আর এখন মিছিল মিটিং এ যাদের দেখি, দেখেই বুঝি এদের অনেকেই এসেছে টাকার টানে। মানে দেশ প্রেমিক রিয়েল বিএনপির সমর্থকেরা এখন আর কথাই বলেন না। আগে যাদের সভাতে ভাষন দিতে দেখতাম, এখন তারা গেল কই। এখন যারা ভাষণ দেয় (মাঝারি নেতা) এদের কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এখন প্রায় উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতা!
৩। বিএনপির নেতা কর্মীদের মামলার সংখ্যা তো সবাই জানেন, যদিও এখন সবাই নিজের প্রচেষ্টায় কিছু তুলতে সক্ষম হয়েছে, তবে অনেক মামলা এখনো তুলতে পারে নাই (হয়ত জামিন পেয়েছে), কারন বড় নেতারা এই বিষয়ে আর সাহায্য করতে প্রস্তুত নন। এখনো অনেক মাঝারি নেতা ও তাদের সন্তান জেলে, কেহ সাহায্য করে না। বিএনপির গুম খুন আহতদের কোন লিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। মি চৌধুরী আলম কিংবা মি ইলিয়াসের গুম খুনের কথাও তাদের মুখে শুনি না, বাদ বাকী তো দুরের কথা! মুলত উর্ধ নেতারা এদের কোন খবর রাখছে না, ফলে উর্ধ এই নেতাদের কথার কোন মুল্য নেই সাধারন কর্মীদের কাছে। নির্যাতিতরা হয়ত ফিরে গেছে কিংবা নিজেরাই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, ফলাফল গ্রাম গঞ্জে দখল, চাঁদা ইত্যাদি ইত্যাদি। কি আর করবে, কত অপেক্ষা করা যায়!
৪। সাধারন মানুষের কাছে বিএনপির কিছু বড় নেতাকে (অন্তত ২০জন হবেই) একদম স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতক বলেই মনে হচ্ছে, তাদের কথা, আচরণ সব কিছুই যেন দেশের মানুষের জন্য নয়, পুরাই তাদের নিজেদের জন্য। মানে এদেরই বিরাট খাই খাই অবস্থা। পেলেই গ্রাস করবে যা মুলত মানুষ আর দেখতেই চায় না।
৫। পাশের দেশ কানেকশন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখন নিজেরাই বাঁচতে শিখেছে, সত্য মিথ্যা বুঝতে পারছে। বিশেষত মানুষ এখন অনলাইন নির্ভর, অনেকের কথা শুনে নিজেরা সিধান্ত নেয়। বিএনপি পাশের দেশের কথামত চলবে এমন আভাস প্রায় দিয়েছে, যা সাধারন সমর্থক বা সাধারন জনগণ যারা লীগ পছন্দ করে না, তারা পুরাই রিজেক্ট করেছে। মানুষ পুরানো গোলামীর জীবন আর চায় না, সব কিছু দেশেই সব গড়ে উঠবে বা উঠাতে হবে এই ধারনা মনে করে। বিএনপি এখানেও স্পষ্ট করতে পারে নাই, সেই নতজানু নীতিতেই পড়ে আছে।
৬। জামাত কানেকশন বিএনপির জন্য আরেক প্যারা। সাধারন অনেক মানুষ, শিক্ষিত লোকেরা, নুতন ভোটারেরা জামাতকে পছন্দ করে না। অথচ বিএনপি এই বিষয়ে কিছুই স্পষ্ট করে না, কখনো কোলে নেয়, আবার ফেলে দেয়ার ভান করে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিএনপির এই কানেকশনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও বিশ্বাস করে না বা আসতে চায় না। দেশের অধিক মানুষ এখন আর বোকা নয়, অথচ তাদের বড় নেতারা তাদের বোকা ভেবে আছে।
৭। ৫ আগষ্ট ২০২৪ এর বিপ্লবকে ধারন করে বুকে নিতে পারছে না বিএনপির অনেক বড় নেতারা, অথচ দেশবাসী জানে, কাদের জন্য এই মুক্তি মিলেছে। শুরু থেকেই বিএনপির উচিত ছিলো এই শিক্ষার্থী জনতাকে সন্মান দেখিয়ে মাথায় তুলে রাখা, যাতে কোন দুরত্ব তৈরী না হয়। শিক্ষার্থী জনতার বিশ্বাস ভঙ্গের ফলে এখন নুতন নুতন দল হচ্ছে এবং লীগ ফেরার ভয়ে মানুষ এমন দল খুজতেই থাকবে।
৮। সংস্কার না মানা আরো একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। একজন সাধারন নাগরিক হিসাবে আমার কাছেই বার বার মনে হয়, কেন মানছে না? অথচ নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তো বিএনপির সবার আগে থাকা উচিত ছিলো, প্রফেসর ইউনূস সাহেব এই সংস্কার করে দিয়ে গেলেতো আগামীতে দোষ তাদের ঘাড়ে পড়ত না, তারা ক্ষমতায় এলে সমস্যা হলে তারা অন্যের ঘাড়ে দোষ দিতে পারত। অথচ বিএনপির বড় নেতারা এই হিসাব মানলোই না, এই কারনে বিএনপির অনেক নেতাই এখন বুকে সাহস নিয়ে রাস্তায় নামতে পারে না, কারন ভয় পায়, যদি মানুষ আক্রমন করে বসে!
৯। দলের ভারপাপ্ত প্রধানের না ফেরাকেও মানুষ স্বভাবিক নিচ্ছে না, এখন তো আর মামলা নেই বা যা আছে তা নেগোসিয়েট করে ফেলাই যায়, প্রফেসর ইউনূস সাহেব নিশ্চিত মেনেই নেবেন বা নিচ্ছেন বলেই মনে হয়। কিন্তু কেন কি কারন এর কোন ব্যাখ্যা নেই। মাঝারি নেতারাও জবাব দিতে পারে না, যখন কেহ তাদের জিজ্ঞেস করে, মাঠ পর্যায়েও এই নিয়ে ব্যাপক কানাঘুষা।
১০। আমি মনে করি না যে, কর্মীদের দখল চাঁদাবাজি দেখে মানুষ তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, মানুষ আগেও দিয়েছে, সামনেও দিবে, দিতে দিতে মারা পড়বে, তবে এর ফয়সালা চায় মানুষ, এখন নির্বাচন হলে বিএনপির কাছে ক্ষমতা যাবেই, তবে এই অসুস্থ্যতা থেকে মুক্তির দাওয়াই চায় সাধারন মানুষ, যা বিএনপির বড় নেতারা চিন্তাও করছে না, কেমন উদাসীনতা তাদের মধ্য, স্পষ্টতার দেখাই নেই।
১১। দেশের বিরাট একটা অংশ এখন প্রবাসী, প্রায় পরিবারেই ২/৩জন প্রবাসী আছেন। মুলত তাদের ডলারেই আমরা অনেক জায়গাতেই এগিয়ে আছি, এই অংশের প্রতি বিএনপির কোন কমিটমেন্ট এখনো নেই। বিএনপির নেতারা এদের অবজ্ঞা করেন বলেই মনে হয়, কারন এদের নিয়ে কিছু কখনো বলতেই শোনা যায় না। এই প্রবাসীরা তারা তাদের পরিবারের প্রধান, তারা পরিবারের অর্থ নিয়ন্ত্রন করেন। ফলে তাদের মতামত গুরুত্বপূর্ন, প্রবাসীরা যা বলবেন তাদের পরিবার সন্তানেরা তা শুন্তে বাধ্য, বাবা চাচাদের মতের বাইরে যেতে পারা সহজ নয়। বাবা চাচা যাকে ভাল মনে করবেন, যা বুঝবেন তাই তাদের পরিবার বুঝবে বা মানবে।
যাই হোক, বিএনপি দেশের বড় দল, এখনো লীগ জামাতের চেয়ে অনেক বেশী সমর্থক তাদের, এই দলে সর্ব শ্রেণীর মানুষ আছে, আছে অনেক মানুষের ভালবাসা। ভারপাপ্ত নেতা/প্রধান দেশে ফিরে নুতন ডাইমেনশনে কাজ করলে নিশ্চিত আবারো দাঁড়িয়ে যেতে পারবেই। মানুষের যে বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে, তা ফিরতেও পারে। নির্বাচন নির্বাচন না করে সংস্কার গুলো মেনে একটু দেরী হলেও ক্ষমতা যে তাদের হাতেই যাবে, কোন সন্দেহ নেই।
(আপনার মতামত বা আমার ভুল গুলো জানাতে পারেন)
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:২০