ছোটবেলা থেকেই একটা বাজে জিনিস আমি করে আসছি । করে আসছি বললে ঠিক হবে কি না জানি না আমার দ্বারা হয়ে আসছে। ঈদ আমার কাছে মন খারাপের একটা বিষয়বস্তু মনে হয়। কেন যে ঈদ আসে আমি তাই তো বুঝি না। রোজা মাসই তো কত ভাল। কত কম খরচ হয় এই মাসে। কম হয় বলছি কারন আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অন্যদের মতো বাহারী ইফতার করার শখ অবশ্য আছে কিন্তু সাধ্য নেই। এই ক্ষেত্রে আমাদের বাবার একটা কথা সবাই মেনে চলতে চেষ্টা করি। বাবা সবসময় বলত ইফতারের সময় তিনটা খেজুর খেলেই সব শেষ হয়ে যায়। বাকীটা হচ্ছে শুধু দেখানো। আমরা অবাক হয়ে বাবাকে দেখতাম যে জায়গায় আমরা গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে কলিজা ঠান্ডা করছি সে জায়গায় বাবা মাত্র তিনটা খেজুর খেয়েই দিব্যি পার করে দিতেন। পানির কথা মনেই আসত না। পরে অবশ্য অল্প একটু পানি খেতেন। জিনিসটা বাবা কেন করতেন এখনো বুঝি না। এটাকি আসলেই বাবার একটা দর্শন ছিল নাকি আমাদের অর্থনৈতিক মন খারাপ ঘুছাতে এমন করতেন এখনো বের করতে পারি নি। যাই হোক বাবার এই পদ্বতিটা অনেক কাজে দিয়েছিল।
ওহ! যা বলছিলাম। ঈদ আসলেই আমার কাছে অপ্রিয়। কেউ হয়তো বা বলতে পারেন আমি নাস্তিক টাইপের। আমি নাস্তিক না। আসলে কিছু মানুষের জীবনে সুখ বলে কিছু থাকতে নেই। আমার জীবনটাও মনে হয় তেমন। ছোটবেলা থেকে অনেক অর্থনৈতিক চাপে পড়ে চ্যাপ্টা হওয়া পরিবারে বড় হয়েছি। ঈদ শপিং নামক জিনিসটা শুনলে মুখ পানসা হয়ে যেত। রোজার শেষ দশ দিন পাড়ায় সাজ সাজ রব পড়ে যেত। ইফতার করেই দে ছুট, শপিং করতে হবে। এখনো অবশ্য তেমনটাই হয়। বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়ে এলাকাটা গরম থাকত একদম। এটা ছিল ঈদের পূর্বাভাস। আর ঠিক এই সময়টাই ছিল আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে দুঃখের। কারন বাবার সল্প বেতনে এতো সামর্থ ছিল না যে আমাদের চার ভাই বোনের সবাইকে মন পছন্দ মতো জিনিস কিনে দিবেন। বাসায় যখন প্রতিবাশী আসত আর মায়ের সাথে “ভাবী জানেন, ওই মার্কেটের জামাটা না চোখ থেকে সরাতেই পারছিলাম না। কত্ত সুন্দর যে জামাটা। দামটা অবশ্য একটু বেশীই। আবার তেমন বেশীও না। ৮০০০ টাকা। কিন্তু কি করব ভাবী বলেন। শখের তুলা তো আশি টাকা। কিনে ভালো করি নাই ভাবী?” টাইপের কথা বলে তখন মায়ের শুকনো মুখে ঠোট ফাটা হাসিটা দেখে ভাবতাম কি দরকার ঈদের। এমনিতেই তো ভালো আছি। স্কুল থেকে ফিরে যখন ভাই বোন তাদের বন্ধুদের ঈদ শপিং এর লম্বা লিস্ট বলতো আর চোখে লুকিয়ে রাখত এক ধরনের দুঃখের আলোছায়া খেলা তখন মনে হতো কিভাবে আমার ঈদ আনন্দময় হবে। আমি মনে করি পরিবেশ মানুষকে নিজের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যবস্থা নিজেই করে দেয়। এইজন্যই আমার ছোট ভাই বোন গুলো অল্প বয়সেই তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বুঝতে পেরেছিল।
এতোক্ষন বাবাকে নিয়ে যত কথাই বলেছি তার সবগুলাই ছিল অতীত কাল। বাবা আমাদের ছেড়ে অতীত হয়ে গিয়েছেন। আর ঈদকে ভালো না লাগার অন্যতম আরেকটি কারন হলো এটি। যে অর্থকষ্টে পড়ে বাবা ধুকে ধুকে মারা গেছেন, যে কারনে মা এখনো কান্না করেন এই একই অবস্থায় কিভাবে ঈদ আমার কাছে আনন্দময় হবে? সম্ভব?
বাবা মারা যাওয়ার দুই বছর পর ঢাকা এসেছি। সপ্ন অনেক বড় মানুষ হব। বাবার মতো মানুষ। যে কিনা নিদারুন অর্থকষ্টে থেকেও নীতি বিসর্জন দেয় নি। তবে আমি অর্থকষ্ট চাই না। আমি চাই না দেখতে আমার ভাই বোনের চোখে দুঃখের আলোছায়া খেলা, আমি চাই না মায়ের মুখে দুঃখ চেপে রেখে “বাবা, কেমন আছিস?” শুনতে। আমি একটা সুন্দর জীবন চাই। কিন্তু একটা কথা মানি যে সুন্দর জীবন গড়তে পরিশ্রমের পাশাপাশি সমর্থন জিনিসটা জরুরী। পরিবারের মানুষ ছাড়া যেটা এখনো আমার কাছে দুস্প্রাপ্য এক বস্তু।
আজ তিনমাস হয় অফিস থেকে বেতন পাই না। কত কাকুতি মিনতি করলাম কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। ভাই বোনের জন্য এইবারও কিছু কিনা হবে না। তারা অনেক আশা করে চেয়ে থাকবে পথের দিকে। তাদের ভাই আসবে অনেক কিছু নিয়ে। কিন্তু তারা জানে না তারা কি মরীচিকার মধ্যে আছে। তাদের ভাই যে এইবারও তাদের সাথে ঈদ করবে না। কেমন করে তাদের মুখ দেখাবে। আমার ছোট ভাইটা যে শুন্য মুখ পছন্দ করে না। এইবারও মাকে বলবে “মা, কাজের অনেক চাপ ছুটি দিচ্ছে না। সাথে পড়ার চাপ টা তো আছেই। তোমরা ভালো করে ঈদ করো মা।” আমি জানি মা ওদের ননিয়ে কখনোই ভালোভাবে ঈদ করতে পারবে না। কিন্তু কি করবো। তাদের ঈদ ভালো করার সামর্থ যে আমার নেই। তাই বরাবরের মতো এইবারও আমার ঈদ আনন্দের হচ্ছে না। ব্যাপার না। আমাদের সামনে তো উজ্জ্বল আলো অপেক্ষা করছে। এখন না হয় বড়দের বড় হতে দেই। আমরা আরো কিছুদিন কষ্টে থাকি। ইনশাল্লাহ আমাদের সামনে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
আসলে এখনো কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে ঈদ আনন্দের নয় বরং বিষাদের। তারা অন্যের আনন্দের মধ্যের নিজের আনন্দ খুজে পায়। নিজেকেও না হয় এর দলভুক্ত করে নিলাম।
পুনশ্চঃ এক বড় ভাইয়ের এই অবস্থা হয়েছে। বেতন না পাওয়ার কারনে বাড়ি যেতে পারছে না। মন খারাপের মাঝে এই কথাগুলো বের হলো।
সবাই ভালো থাকবেন।