তার ওস্তাদের নাম পাগলা মজিদ। নামের আগে “পাগলা” শব্দটা অবশ্য কিছুদিন আগে যোগ হয়েছে। আজকাল এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, সন্ত্রাসীদের নামের আগে একটা ভয়ংকর বিশেষণ না থাকলে মানুষ ভয় পায়না। তাই ছিনতাই থেকে একলাফে কিডন্যাপিংএর ধান্দা শুরু করায় মজিদ এখন নিজেকে “পাগলা মজিদ” হিসেবে পরিচয় দেয়। তাছাড়া ইদানিং দুই চারজন রাজনৈতিক নেতার সাথে মজিদের খাতির হয়েছে। তাদের হয়ে টুক টাক কাজ করায় মজিদের নামটা চারিদিকে ভালই ছড়িয়েছে। পাগলা মজিদ নামটা শুনলেই এখন অনেকে ভয় পায়!
বদি আর আলামিন ছোটবেলায় টোকাই ছিল। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষের ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র, কাগজ আর প্লাস্টিকের বোতল টুকিয়ে বস্তায় ভরে বিক্রি করে যা পেত তা দিয়ে কোন মতে পেট চলে যেত। মজিদ তাদেরকে সেই অবস্থা থেকে তুলে এনেছে। আশ্রয় দিয়েছে, দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তাই ওস্তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস হয়না তার। এর কারন কি? শুধু সম্মান নাকি ভয়? এই প্রশ্নের উত্তর বদির জানা নেই।
আজ সকাল থেকে বদি লক্ষ করছে তার ওস্তাদ একটা টুলের ওপর চুপ চাপ বসে আছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত। অন্যান্য সময় এতক্ষনে সে বলে উঠত, “বদি একটা গান ধরতো! ঐ যে আমার গায়ে যত দুঃখ সয়- ঐ গানটা একটু গাইয়া শুনা”। অথবা আলামিনকে বলত, “আলামিন, একটা জোকস বল দেখি। ঐযে মাস্টার আর ছাত্রের একটা জোকস আছে না? ঐটা বল”! কিন্তু আজ তার ওস্তাদ একদম চুপ, মুখে কোন কথা নেই।
বদি একটু সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন করে বসল, “বড়ভাই। আপনের কি মন খারাপ?”
মজিল কোন জবাব দেয়না।
“ও বড়ভাই! কিছু কন না ক্যান?”
মজিদ এবারও কোন জবাব দিলনা। উলটো গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, “তোরে যে একটা কাম দিছিলাম, ঐটা ঠিকঠাক মত করসস তো?”
“জী ওস্তাদ। কালকে সারাদিন ঐ মহিলার ওপর নজর রাখছি”।
“কি মনে হয়? পুলিশের লগে যোগাযোগ করব?”
“না মনে হয়। মহিলা মারাত্মক ভয় পাইছে। একটাই পোলা তার, পুলিশের লগে যোগাযোগ করার রিস্ক লইব না”।
“হুম, না করলেই ভাল। আর করলেও সমস্যা নাই, নেতার লগে কথা বইলা রাখমু”। মজিদ একমুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর আবার বলে, “এখন একটা কাজ কর। দোকান থেইকা আমার নাম কইয়া কলা আর পাউরুটি লইয়া আয়। পোলাটারে খাইতে দে, সকাল থেইকা খাওন দেওয়া হয় নাই”।
বদি সাথে সাথে গেলনা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
“কি হইল? কিছু কবি নাকি?”
বদি ভয়ে ভয়ে বলল, “একটা আবদার ছিল, বড়ভাই”।
“কি?”
“মহিলা প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার। স্বামী মারা গেছে অনেক বছর আগে। দুইটা পোলা মাইয়া লইয়া অনেক কষ্ট কইরা চলে। ৫০ লাখ টাকা সে কই থেইকা জোগাড় করব?”
“সেইটা আমাগো মাথা ব্যাথা না। আমরা আমাগো টাকা পাইলেই খুশি। কই থেইকা টেকা আইব সেইটা ঐ মহিলার মাথা ব্যাথা। তোর এইটা নিয়া চিন্তা করনের কাম নাই”।
“বড়ভাই, মুক্তিপনের টাকাটা ৫০ লাখ থেইকা কমাইয়া ১০ লাখ করন যায়না?”
মজিদ ব্যাঙ্গ করার ঢঙয়ে বলল, “তোর এত দরদ উথলায় উঠল কেন মহিলার লেইগা?”
“বড়ভাই, কিডন্যাপ করলে বড়লোকের পোলাপাইন কিডন্যাপ করন দরকার। হেরা যত টেকা চাই, তাই দিতে পারব। খামাখা গরীব মানুষের দুঃখ বাড়াইয়া লাভ কি?”
মজিদ কয়েক সেকেন্ড ভাবল, তারপর শান্ত গলায় বলল, “বড়লোকের নিজের পোলা মাইয়ার প্রতি মায়া কম থাকে, ওগো পোলাপাইন ধইরা আনলে ওরা পুলিশে যোগাযোগ করব, সন্তান বাঁচল কি মরল সেই খবর নাই। কিন্তু গরীবের তো সন্তান ছাড়া কিছুই নাই, ওরা নিজের সন্তানরে বাঁচানের জন্য জান দিতেও রাজি থাকে। শুন, এই লাইনে দুই চার পয়সা ধান্দা করার জন্য শুধু শক্তি থাকলে চলেনা, লগে বুদ্ধিও থাকা লাগে, বুঝছস?”
বদি হয়ত আরও কিছু বলত, কিন্তু মজিদ তাকে থামিয়ে দিল, “শুন বদি। তোরে আমি আগেও কইছি এই লাইনে কাজ করতে চাইলে এইসব চিন্তা বাদ দেওয়া লাগব। মনের ভিতরে মায়া দয়া থাকলে এই লাইনে উপরে উঠতে পারবি না। আজকে যা কওয়ার কইছস। সামনে যদি আর কোনদিন এই সব মায়া দয়ার কথা তুলস, তোরে বাইর কইরা দেওয়া ছাড়া আমার কোন গতি থাকব না বদি। কথাটা মাথায় রাখিস”।
বদি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
মজিদ এবার গলার স্বর একটু নরম করে বলল, “শুন বদি। এই দুনিয়াতে বাচতে গেলে আর একজনরে মাইরা তোর বাঁচন লাগব। তুই যদি পেট ভইরা খাইতে চাস তাইলে আর একজনরে অভুক্ত রাখতে হইব”।
বদির ইচ্ছে হল বলে যে, “একজনরে অভুক্ত রাইখা পেট ভইরা খাওয়ার কি দরকার? একজনের খাবার দুই জনে ভাগ কইরা নিলে তো দু জনের পেটেই কিছু যায়!” কিন্তু কথাটা বলার সাহস তার হলনা! মাথা নিচু করে ওস্তাদের সামনে থেকে সরে গেল।
***
শাহিন গত তিনদিন যাবত যে ঘরটাতে অবস্থান করছে সেটা মাঝারি আকৃতির। ঘরের ভেতর আসবাব বলতে ছোট্ট লোহার খাট আর একটা আলমারি। শাহিনের একটা পা খাটের পায়ের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা। অনেক চেষ্টা করে দেখেছে শাহিন, তার পক্ষে নিজ চেষ্টায় এই শিকল থেকে মুক্তি পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। ঘরটায় একটা জানালা আছে, সব সময় বন্ধ করে রাখা হয়। জানালার একটা কাঁচ ভাঙা, দিনের বেলা সেই ফাক গলে খুব সামান্য একটু আলো আসে। ঘরের ভেতর অল্প পাওয়ারের একটা বাল্ব আছে। রাতের বেলা সেই বাল্বের আলোতে ঘরের ভেতরে এক আধিভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। দেয়ালগুলোকে দেখলে মনে হয় যেন দগদগে পচন ধরা ঘা হয়েছে! যায়গায় যায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে আর অসংখ্য ময়লা দাগ। মেঝেটা ভীষণ নোংরা, কতদিন পরিষ্কার করা হয়নি কে জানে! পুরোটা মেঝে জুড়ে ময়লা কাগজ, খাবারের উচ্ছিদ্দ অংশ আর ধুলবালি জমে আছে।
এখানে আনার পর প্রথম দুই দিন শাহিন খুব কেঁদেছে। ১৫ বছর বয়স হয়েছে, এখনও সে মাকে ছেড়ে একটা রাত কোথাও থাকেনি। তবে গতকাল থেকে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে শাহিন। “বিপদে ধৈর্য ধরতে হয়”- এই শিক্ষা সে তার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।
শাহিন শুয়ে ছিল, দরজা খোলার আওয়াজ শুনে উঠে বসল। কেউ একজন ভেতরে ঢুকছে। দরজা খুলতেই বদির মুখটা শাহিনের নজরে এল। বদির হাতে দুইটা কলা আর একটা পাউরুটির প্যাকেট। তার মুখে হাসি। ভেতরে ঢুকেই প্রশ্ন করল, “কেমন আছ শাহিন?”
শাহিন কোন জবাব দেয়না।
“সকাল থেইকা কিছু খাও নাই। এই যে তোমার লেইগা কলা-পাউরুটি আনছি”।
“খাবনা”। সংক্ষেপে জবাব দিল শাহিন।
“ক্যান খাবানা?”
“খিদে পায়নি”।
“সেই রাইতে খাইছ আর এখন বাজে বেলা ১২টা। কইতাছ খিদা পায় নাই!” বদি লক্ষ করল গতকার রাতে বিরিয়ানির প্যাকেটটা সে যেখানটায় রেখে গিয়েছিল সেটা ঠিক সেখানেই আছে। বদি বিরিয়ানির প্যাকেট খুলে দেখল শাহিন সেটা ছুয়েও দেখেনি। “ইয়া খোদা! তুমি দেখি রাইতেও খাও নাই। ঐ পোলা এমনে না খাইয়া থাকলে তো মইরা যাইবা”।
শাহিন নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “এমনিতেই যখন মরতে হবে, তখন খেয়ে আর লাভ কি?”
“ধুর পাগল! তুমি মরবা কেন? আর তিন চার দিন বাদেই তোমারে ছাইড়া দিমু আমরা। তোমার মায় টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করতেছে”।
হঠাৎ করেই শাহিনের চোখে পানি চলে এল। সে অতি কষ্টে কান্না চেপে রেখে বলল, “ভাই, আপনারা আমার মাকে এত কষ্ট দিয়েন না। ৫০ লাখ টাকা আমার মা কিছুতেই জোগাড় করতে পারবেন না। আমাদের সহায় সম্বল কিছুই নাই। আমরা খুব গরীব, কোনমতে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি”।
বদি কি বলবে ভেবে পায়না।
শাহিন বলে চলেছে, “আমাদের আত্মীয় স্বজন কেউ নাই যে এতগুলা টাকা দিতে পারে। ভাই আপনাদের আল্লাহর দোহাই লাগে, এত নিষ্ঠুর হবেন না”।
বদি একটু আমতা আমতা করে বলল, “দেখ.. তোমার কষ্ট আমি বুঝি। তোমার মার লগে আমি কথা কইছি... ধার দেনা করে কিছু টাকা ম্যানেজ কইরা ফালাইছে... তিনি বলছেন বাকি টাকাও ম্যানেজ কইরা ফালাইবেন তিন চার দিনের মধ্যে, মারে নিয়া টেনশন কইর না তুমি”।
শাহিন আর কান্না চেপে রাখতে পারেনা। তার দুচোখের কোন বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ঝরতে থাকে। সে বলে, “আপনি আমার কষ্ট কি বুঝবেন? আপনি কেমন করে বুঝবেন আমার মা আমার কাছে কি!”
কথাটা বদিকে একটু নাড়া দিয়ে যায়। সে বলে, “হ তুমি ঠিকই কইছ। মা কি জিনিস সেইটা আমি ক্যামনে বুঝমু? বুঝ ক্ষমতা হওয়ার পর থেইকা আমি তো আমার মারে দেখি নাই”।
শাহিন একটু শান্ত হল। জিজ্ঞেস করল, “আপনার মার কি হয়েছিল?”
“শুনছি আমার মায় পানিতে ডুইবা মরছে। আমার মার আত্মা ঐ পানিতে মিশশা আছে। আমি যখন পানিতে ডুব দেই সারা শরীরে কেমন জানি একটা আরাম লাগে, মনে হয় মায় আমারে আদর করতাছে! তাই মাঝে মাঝে এই বাড়ির পিছনের পুস্কুনিটাতে গিয়া ইচ্ছা মত ডুব দেই আর মা মা কইয়া চিক্কুর পাইড়া কান্দি। মারে খুঁজি পানির তলে, কিন্তু খুইজা তো পাইনা...” বলতে বলতে বদিও কেঁদে ফেলে।
শাহিন অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষন নীরবে কাঁদল বদি, তারপর সামলে নিয়ে নরম গলায় বলে, “কিন্তু তোমার মা তো বাইচা আছেন। তিনি যদি টাকা জোগাড় করে এসে দেখে তুমি না খাইতে খাইতে মইরা গেছ তাইলে ক্যামনে হবে? তোমার মা তো টাকা জোগাড় করতাছে তোমারে বাঁচানোর জন্য তাইনা? অহন টাকা আর পোলা দুইটাই হারাইলে উনি বাঁচব কি নিয়া?”
শাহিন দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিল।
বদি তার দিকে কলা পাউরুটি এগিয়ে দিতে দিতে বলল, “লও লও খাইয়া লও। খাইয়া নিজেরে সুস্থ রাখ”।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে, সত্যি জবাব দিবেন?”
“কি কথা?”
শাহিন একটা কলা ছিলতে ছিলতে প্রশ্ন করল, “টাকা নেওয়ার পর আমাকে কি আসলেও জীবিত অবস্থায় আমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবেন?”
“কেন দিমুনা?”
“না, আমি শুনেছি এই রকম কিডন্যাপ করার পর, কিডন্যাপাররা টাকা নিয়ে যাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে তাকে মেরে রেখে পালিয়ে যায়”।
“কে বলছে এই বোগাস কথা?”
“পেপারে পড়েছি”।
“এই সব ভুয়া খবর। আমাগো ওস্তাদ অনেক ভালা মানুষ। কথা দিলে কথার বরখেলাপ করেন না। তোমার মায় টাকা নিয়া আসলে তোমারে সুস্থ অবস্থায় তার কাছে ফিরায় দেওয়া হইব”।
শাহিন আর কথা না বলে খেতে থাকল। কিন্তু বদি তখন চিন্তায় পড়ে গেছে। অনেক গুলো প্রশ্ন জমেছে তার মনে। সে কি তার ওস্তাদকে আসলেও চেনে? ওস্তাদ কি আসলেও ছেলেটাকে জীবিত অবস্থায় মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবে? শাহিন তাদের সবাইকে চিনে রেখেছে, এই বাড়িটি কোথায় সেটাও তার জানা, ছাড়া পেয়ে যদি পুলিশের কাছে গিয়ে সব তথ্য বলে দেয় তাহলে তাদের সবাইকে জেলের ভাত খাওয়া লাগবে। এই রিস্ক কি পাগলা মজিদ নেবে?
মনে মনে ঠিক করে নিল বদি। যা হয় হবে, পাগলা মজিদ যদি এই ছেলেটাকে মের ফেলে তাহলে সে নিজ হাতে নিজের ওস্তাদকে খুন করবে!
***
“মহিলা টাকা জোগাড় কইরা ফেলছে?”
“হ বড়ভাই”। আলামিন উত্তর দিল।
মজিদ বলল, “ঠিক আছে। তুই মহিলারে কইয়া দে টাকা নিয়া রেললাইনের পাশের বস্তির ভিতরে আমাগো যে আস্তানা আছে সেইখানে আইতে। তুই লুকাইয়া লুকাইয়া সারা পথে নজর রাখবি মহিলার লগে আর কেউ আছে কিনা। বুঝতে পারসস?”
“জী, বড়ভাই”।
“ঠিক আছে যা”।
আলামিন চলে যেতেই বদির দিকে ফিরল মজিদ, “বদি তুই আস্তানায় গিয়া সব ঠিক ঠাক কইরা রাখ। আমি আইতাছি পোলাটারে নিয়া”।
বদি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় তার ওস্তাদের দিকে।
“কি? কিছু কবি?”
“ওস্তাদ আপনি আস্তানায় জান না। আমি পোলাটারে নিয়া আসতেছি”।
মজিদ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার আমার মুখের ওপর কথা কইতাছস? যেইটা কইলাম সেইটা কর। যা, আস্তানা ম্যানেজ কর। আমি আইতাছি”।
ভয়ের একটা স্রোত বদির মেরুদণ্ড বেয়ে নামে। ওস্তাদের কথা তার বিশ্বাস হয়না। তার ওস্তাদ হিসেবি মানুষ। সম্ভবত ছেলেটাকে জীবিত অবস্থায় মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে চায়না।
“কিরে খাঁড়ায় আসস কেন খাম্বার মত? কথা কানে যায় নাই?”
“জী বড়ভাই”।
“দৌড় লাগা হারামজাদা”।
“বড়ভাই একটা কথা...”
“যা কইসি জলদি কর বদি। মেজাজ বিলা করিস না”।
“ভাই, পোলাটা মায়ের খুব আদরের... পোলাটারে না পাইলে মা টা বাঁচব না...”
পাগলা মজিদ গরম চোখে তাকিয়ে থাকল বদির দিকে। বদি ঐ চাউনির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার সাহস পেলনা। চুপ চাপ চলে এল আর মনে মনে বলতে থাকল, “আল্লাহ। আমার ওস্তাদের মনে একটু দয়া দিও। সে যেন পোলাটারে মাইরা না ফালায়!”
***
দড়াম করে ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হল। শাহিন দেখল ঘরে ঢুকছে পাগলা মজিদ। মজিদের হাতে ধরা জিনিসটা যে একটা পিস্তল সেটা বুঝতে কোন সমস্যা হলনা শাহিনের।
“ঐ পোলা। তোর মা তো টাকা নিয়া আইতাছে”।
কথাটা শুনে শাহিন খুশি হতে পারছে না। তার সমস্ত মনোযোগ মজিদের হাতে ধরা পিস্তলের দিকে।
“অহন তোর লগে দুইটা কথা কওন দরকার”।
“কি কথা?” ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল শাহিন।
“তুই এই এলাকা চিনে রখাছস। আমারা যারা যারা তোরে ধরছি তাগোরেও তুই চিনস। তুই ছাড়া পাওনের পর কি পুলিশের কাছে সব খবর ফাস কইরা দিবি?”
“না। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না”।
“কথাটা কেন জানি বিশ্বাস হইতাছে না”।
“বিশ্বাস করেন ভাইজান। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না”। শাহিনের কণ্ঠে বাঁচার আকুতি।
“তুই পোলাটা তেজি স্বভাবের। এমন পোলাদের দিয়া ভরসা নাই। কেন জানি লাগতাছে তুই বাইর হইয়া আমগোরে ধরা খাওয়াইয়া দিবি”।
শাহিন বুঝতে পারলনা কি বলা উচিত।
“আমাগো টাকা পাওয়া নিয়া হইছে কথা। তোর মায় টাকা নিয়া আইতাছে। তোরে বাঁচায় রাখি আর মাইরা ফেলি তাতে কিচ্ছু হইব না। টাকা আমরা ঠিকই পামু। বাঁচায় রাখাটা তো আমাগোর জন্য রিস্ক”।
এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল শাহিনের কাছে। মজিদ আসলে একটা কারন খুজছে তাকে মেরে ফেলার জন্য। মায়ের সাথে আর দেখা করার সুযোগ হয়ত সে পাবেনা। হঠাৎ করে শাহিন নিজের নিয়তিটা মেনে নিল। বলল, “ভাইজান একটা অনুরোধ রাখবেন?”
“কি? জলদি বল”।
“আমাকে মেরে ফেলেন, আপত্তি নাই। শুধু আমার মায়ের কাছ থেকে টাকাটা নিয়েন না। জীবনে আপনারা টাকা অনেক কামাতে পারবেন। শুধু আমার মাকে একটু মুক্তি দিন। ঐ টাকা তিনি ঋণ করে আনছেন। বাকিটা জীবন তাকে সেই ঋণের বোঝা বইতে হবে। আমি মরে যেতে রাজি আছি কিন্তু আমার মায়ের একটু কষ্টও দেখতে রাজিনা”।
মজিদ ঝাড়া দুই মিনিট কিছু একটা চিন্তা করল। সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কি করবে। তারপর মনঃস্থির করে নিল, “ঠিক আছে। তোরে মারলাম না। কিন্তু মনে রাখিস, ভুলেও এই এলাকার ধারে কাছে আর আসবি না। পুলিশে যাওয়ার কথা ভাবলেই তোদের মা ছেলেরে এক্কেবারে উপরে পাঠায় দিমু। মনে থাকব?”
শাহিন আর কিছু বলল না। ছলছল চোখে উপরে নিচে মাথা ঝাকাল শুধু।
***
বস্তির ভেতরে এই ঘুপচির মত বেড়ার ঘরটা পাগলা মজিদের অস্থায়ী ডেরা। ভেতরে একটা টেবিল আর কিছু চেয়ার পাতা আছে। মাঝে মাঝে মদ আর জুয়ার আসর বসে এখানে। বহুগামি রমণীদের নিয়ে এসে দুই চার ঘণ্টা নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য এর চেয়ে উত্তম কিছু হয়না। মজিদ অবশ্য মাঝে মধ্যে সুযোগ বুঝে যায়গাটাকে ধান্দার কাজে লাগায়। এই যেমন আজ কাজে লেগে গেল!
একটা চেয়ারে বসে আছে মজিদ। পাশে বসিয়ে রেখেছে শাহিনকে। বদি দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। বদির চোখে মুখে এক ধরনের চাপা আনন্দ। তার কেবল মনে হচ্ছে সে আসলে যতটা খারাপ ভাবে, তার ওস্তাদ ততটা খারাপ না। শাহিনকে সুস্থ অবস্থায় তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার যে কথা দিয়েছিল সেটা সে রাখতে পারবে ভাবতেই ভাল লাগছে।
আলামিন ঘরে ঢুকে খবর দিল, “রাহেলা বেগম আসছে”।
“রাহেলা বেগমটা আবার কেডা?” বিরক্ত হল মজিদ।
“রাহেলা বেগম... ঐযে স্কুলের মাষ্টারনি। এই পোলার মা”।
“ওহ! ওনারে ভেতরে নিয়া আয়”।
রাহেলা বেগম ভেতরে এসে ঢুকলেন। মহিলার বয়স পঞ্চাশের মত। এই মুহূর্তে তাকে আরও বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। গত কয়েকদিনের ধকলে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকে শাহিনের ওপর চোখ পড়তেই তার চোখে মুখে এক অপার্থিব আনন্দ ফুটে উঠল। সাতদিন হয়েছে ছেলেকে দেখেননি, এখন মনে হচ্ছে কত্ত বছর পরে দেখছেন! শাহিনও তার মাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলল। কিন্তু এইসব দৃশ্য মজিদের চোখে পড়ছে না। সে একদৃষ্টিতে রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মাথায় রাহেলা বেগম নামটা ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে। সে প্রশ্ন করে বসল, “আপনার নাম রাহেলা বেগম?”
রাহেলা বেগমের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, “হ্যা, কোন সন্দেহ আছে? আর নাম দিয়ে আপনার দরকার কি? আপনি টাকা চেয়েছেন আমি এনেছি, চাইলে গুনে নিতে পারেন। একটা টাকাও কম হবেনা বরং বেশি হতে পারে”।
মজিদ যেন তখন চলে গেছে অন্য কোন জগতে। সে তখন আর কোন কথা বলার পর্যায়ে নেই। তার চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। তাকিয়ে আছে রাহেলা বেগমের মুখের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরাচ্ছে না।
“এই যে টাকা নিন। ব্যাগটা ছুড়ে দিলেন রাহেলা বেগম মজিদের দিকে। ছেড়ে দিন আমার ছেলেকে”।
মজিদ ব্যাগটা ধরল না। শুধু মুখে বলল, “আমি আপানার ছেলেরে ছাইড়া দিতাছি। আপনি টাকাও নিয়ে যান। আমি টাকা চাইনা, অন্য একটা জিনিস চাই আপনার কাছে”।
“অন্য জিনিস?” রাহেলা বেগমের চোখে মুখে ঘৃণার অভিব্যাক্তি। সম্বোধন আপনি থেকে তুইতে নামিয়ে আনলেন, “আর কি চাস তুই? আমার গায়ের রক্ত চাস?”
“একবার শুধু আপনারে...”
“আমাকে কি? আমাকে কি করতে চাস? কথা শেষ কর জানোয়ার!”
“মা কইয়া ডাকতে চাই!”
প্রথমে একটু অবাক হলেন রাহেলা বেগম। এমন কিছু শুনবেন সেটা আশা করেন নি। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তার নিজেকে সামলে নিতে। তারপর গর্জে উঠলেন, “খবরদার! আমি মরে যেতে রাজি আছি কিন্তু তোর মত একটা বেজন্মা কুকুরের মুখে মা ডাক শুনতে পারব না”।
মজিদের চোখে তখন জল টলমল করছে। গত পাঁচ বছরে বদি আর আলামিন তাদের ওস্তাদকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। নিজের চোখকে তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। মজিদ অনুনয় করল, “একবার... শুধু একবার আপনেরে মা কইয়া ডাক দিতে চাই। আমার আর কিচ্ছু চাইনা”।
“নাহ! তোকে ৫০ লাখ দিয়েছি, লাগলে আরও দেব। কিন্তু তোকে মা বলে ডাকার অনুমতি দিয়ে আমি মা শব্দটাকে কলঙ্কিত করতে পারব না”। রাহেলা বেগমের কণ্ঠে একই সাথে রাগ, ঘৃণা ও বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ।
“শুধু একবার ডাকমু... আর কোনোদিন ডাকমু না”! মজিদ কণ্ঠে প্রবল আকুতি।
কিন্তু সেই আকুতিতে রাহেলা বেগমের মন গলল না। তিনি শাহিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলে আয় শাহিন”। এই সব তামাশা দেখতে আর ভাল লাগছে না”।
শাহিন উঠে এল। তাকে একবার বুকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন রাহেলা বেগম। সংক্ষিপ্ত পুনর্মিলনী শেষে মা ছেলে বেরিয়ে গেল মজিদের আস্তানা ছেড়ে।
বদি আর আলামিনকে হতবাক করে দিয়ে হঠাৎ তাদের ওস্তাদ পাগলা মজিদ শব্দ করে কেঁদে উঠল। তার চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। ওস্তাদের এই অন্যরকম রুপ দেখতে প্রস্তুত ছিলনা তারা। এমন শক্ত আর পাথর প্রকৃতির একটা মানুষ কাউকে মা ডাকার সুযোগের না পেয়ে এভাবে ভেঙে পড়তে পারে, এই চিন্তা তাদের কল্পনায়ও কখনো আসার অবকাশ পায়নি।
বদি এগিয়ে এল, বলল, “কি হইল বড়ভাই? কান্দেন কেন?”
মজিদ কিছু বলছে না দেখে সে আবার প্রশ্ন করল, “ঐ মহিলারে একবার মা ডাকার বিনিময়ে আপনে ৫০ লাখ টাকা ফিরায় দিতে চাইছিলেন বড়ভাই! ক্যান?”
মজিদ কান্না জড়ানো গলায় বলল, “আরে! তোরা বুঝবি না রে! আমার মায়ের নাম ছিল রাহেলা বেগম”।
“কি কন বড়ভাই!"
“ আমার বাপ আমার জন্মের আগে মইরা গেছিল। আমাগো অভাবের সংসার ছিল। আমার যখন ২ বছর বয়স, আমার নানী আমার মারে না জানাইয়া আমারে রাইখা আসছিল এতিম খানায়। আর আমার মাও সুখের আশায় অন্য এক লোকরে বিয়া কইরা পালায় গেছিল। আর কোনদিন বাড়ি ফিরে নাই। এতিম খানা থেইকা বাইর হওয়ার পর ১০ বছর ধইরা আমি মারে খুঁজতাছি। আইজ ও তার দেখা পাইলাম না!”
“বড়ভাই! এমনও তো হইতে পারে এই মহিলা আপনার মা! আপনি কেন পরিচয় দিলেন না বড়ভাই?”
"ভয় পাইছিরে বদি। বড় ভয় পাইছি! উনি সত্যি সত্যি আমার মা হইলেও আমি ক্যামনে কমু যে আমি তার পোলা? কোন মুখ নিয়া কমু? আমার মায় যখন জানব তার পোলা বড় সন্ত্রাসী হইছে সেইটা কি সে সহ্য করতে পারব?”
বদির একবার মনে হল বলে যে, “আপনের মায় হেইদিন ভাইগা গেছিল দেইখাই তো আপনে আজকে সন্ত্রাসী হইছেন। মায়ের আদর ভালবাসা পাইলে তো এমন হইত না”! কিন্তু ওস্তাদের মা সম্পর্কে খারাপ কিছু বলার সাহস তার হলনা। শুধু বলল, “বড়ভাই, একটা কথা শুনবেন?”
মজিদ নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল, “কি?”
“আপনের মায় আপনেরে ফালাইয়া গেছে কিন্তু আমার মায় তো আছে। চলেন আমার মায়ের কাছে যাই। আমার মায় কাউরে কম আদর করেনা”।
মজিদ উঠে দাঁড়ায়। বদির সাথে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। আলামিন কিছুক্ষণ কি করবে ভেবে না পেয়ে শেষে সেও বদি আর মজিদের পিছু নেয়। এদিকে ঘুপচির মত ঘরটাতে যে ৫০ লাখ টাকা ভর্তি একটা ব্যাগ পড়ে রয়েছে, সেটা কারো খেয়াল থাকেনা।
কিছুক্ষন পর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল, ভর-দুপুরে তিনটা মানুষ পুকুরে ক্রমাগত ডুব দিচ্ছে আর আর অনবরত “মা” “মা” বলে চিৎকার করে কাঁদছে...
(সমাপ্ত)
***************************
গল্প প্রসঙ্গেঃ
কিছুদিন আগে ব্লগার স্বপ্নবাজ অভি তার একটা পোস্টে সবাইকে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন মা কে নিয়ে ভাল ভাল আর্টিকেল, গল্প, কবিতা ইত্যাদি লেখার জন্য। কারন গুগলে সার্চ করলে প্রথমে বেশ কিছু বাজে সাইটের লিংক আসে। অনেকেই সেই আহবানে সাড়া দিয়েছেন। জননী গল্পের মাধ্যমে আমিও এই মিছিলে শামিল হলাম। আর সঙ্গত কারনেই গল্পটা স্বপ্নবাজ অভিকে উৎসর্গ করছি।
আর একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। গুগলে সার্চ করলে সেই লিংকগুলো আগে চলে আসে যেগুলোতে বেশি বেশি হিট পড়ে। তাই মাকে নিয়ে ভাল ভাল লেখা লিখলেই চলবে না। সেগুলো যথেষ্ট পরিমান মানুষ পড়তে হবে এবং বেশি হিট থাকতে হবে। নইলে আমাদের উদ্দেশ্য অপূর্ণ থেকে যাবে। আপনাদের প্রতি অনুরোধ করব, মাকে নিয়ে লেখাগুলো আপনারা পড়বেন এবং অন্যকে পড়তে উৎসাহিত করবেন। তাহলেই আমরা বাজে সাইটগুলোকে হারিয়ে ভাল লেখাগুলো সামনে নিয়ে আসতে পারব।