গরু নিয়ে সব থেকে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম কোনটি? মহেশ হওয়ার কথা। বাংলা সাহিত্যে মহেশ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছোট গল্প। গরীব রাখালের কাছে মহেশ পুত্র সমান। শত গরীবি হালেও তাকে ত্যাগ করেনি। গ্রামের নাম কাশীপুর। গ্রাম ছোট, জমিদার আরও ছোট, তবু, দাপটে তাঁর প্রজারা টুঁ শব্দটি করিতে পারে না—এমনই প্রতাপ। শেষে অবশ্য গরীব রাখাল নিজ হাতেই হত্যা করেন। হ্র্দয় বিদারক ব্যাপার ছিল। আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ'রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক'রো না।
সামনেই ইদুল আযহা, কোরবানীর ঈদ। কোরবানী ঈদের তাৎপর্য ব্যাপক। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমরা পশু কোরবানী দিয়ে থাকি। মাংস তিন ভাগ। এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, এক ভাগ গরীব দুঃখীদের জন্য। আমি বড় হয়েছি সরকারী কলোনীতে। শৈশব বেইলি রোড স্কয়ার কলনী, কৈশোর ইস্কাটন গার্ডেন অফিসার্স কোয়ার্টার, যৈবন (যৌবন হবে) অবশ সিদ্ধেশরী কাটাচ্ছি, যেখানে এসে বয়সের কারনেই হোক আর অন্য কোন কারনেই হোক গরু ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। ছোট বেলা ব্যাপারটা সেরকম ছিলনা। তখন ব্যাপারটা ছিল আনন্দের। কতটুকু আনন্দের ঠিক বুঝিয়ে লেখা যাবেনা। পাড়ায় প্রথম গরু আসা মানে হল সাথে সাথে ঈদ শুরু, নো পড়ালেখা। প্রথম গরু প্রবেশের সাথে সাথেই চিৎকার গরু আসছে , গরু আসছে, কাউ হ্যাস কাম। চিৎকারের সাথে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ সমানুপাতিক। পাড়ার সবাই তখন নেমে যেত গরু দেখতে। আমরা বিচক্ষনের সাথে পর্যবেক্ষন করতাম। এই গরু ওমুক হাট থেকে কেনা। ঐ হাট থেকে কেনা একদম ঠিক হয়নি। ঐখানে দাম কম যাচ্ছে না। পাড়ার কোন আংকেল যখন গরু কিনতে যেত আমরা তাঁদের জ্ঞান দেওয়া পবিত্র কর্ম মনে করতাম। গরুকে আমরা কয়েক ভাগে ভাগ করতাম। প্রথম ভাগ হল শান্ত গরু। আমাদের আব্বারা এই ধরনের গরু কিনলা খুবই অপমানিত বোধ করতাম। অনেক মানুষই যেমন এই ধারনা রাখে যে রাগ দেখানোই ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ আমরা গরুদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটাকে অধিক গুরুত্বের সাথে নিতাম। বস্তুত, শান্ত গরুর মালিক হবে পাড়ার কোন মেয়েদের বাসার গরু। আমার ভাগে একবার শান্ত গরু পড়েছিল। আব্বারা এই গরু কই থেইকা পাইছে কে জানে! মানে গরু ভাল ছিল। শান্ত শিষ্ট আদব-কায়দা ওয়ালা। কসাইয়ের ছুড়ি দেইখা কোন বেয়াদবী নাই নিজেই পারলে শুয়ে পড়ে আর বলে, স্যার , আমি আপনাদের কোরবানী হওয়ার জন্য নিয়োজিত। আমাকে কোরবানী করে বাধিত করবেন। তা ভাল কিন্তু আমার যে তাতে ইজ্জত থাকেনা। বাপেরা কেন যে ৮-১০ বছরের বাচ্চাদের ইমোশন বুঝেনা!! তবে ভাগ্যে তেজী গরুও পড়ছিল। কালা জাহাঙ্গীর টাইপ গরু। বিরাট ব্যাক্তিত্ব-ওয়ালা গরু। যেই আসে তারেই গুতা দেয়। বিরাট বেয়াদব। গরু হওয়ার বেসিক রুলস এন্ড রেগুলেশন তাদের জানা নাই। গরুদের জন্য রচিত সংবিধানে যে স্পষ্ট লেখা আছে যে লাল রং দেখলেই খালি রি-এক্ট করা যাবে অন্য কোন রঙে না তা তারা মানতে রাজীনা। লাল, কালা, নীলা, ধলা যাই দেখুক তারা শিং নিয়া দৌড়ায় আসে। পাড়ায় ইজ্জত বাড়ানোর আরেকটা উপায় ছিল যদি গরু ছূটত। যাদের গরু ছুটত গরু-সমাজ এবং মানব-সমাজ দুই জায়গাতেই তাদের ইজ্জত বাড়ত। পাড়ায় গরু না ছুটলে সেই ঈদ কোন ঈদের পর্যায়েই পড়েনা। গরু ছুটবে আমরা সবাই মিলে তার পিছে দৌড়াব, আমাদের আন্ডার-ওয়ার প্যান্টের নিচে থাকুক আর উপরে থাকুক সেটা কোনো ব্যাপারনা, গরু ছূটলেই আমরা নিজেদের সুপার-ম্যান মনে করতাম আর গরুর পিছে দৌড়াতাম। বিরাট বলশালী কোন লোক এসে গরু উদ্ধার করলেও আমরা দাবী করতাম আমাদের চিল্লানীতেই গরু ধরা পড়ছে। বিপুল আগ্রহ নিয়ে সেটা বাসায় এসে বলতাম। বাসা অবশ্য সুখকর জায়গা না, লেখাপড়া নাই খালি ঠন ঠন এই ধরনের বাক্য শোনার জন্যই বাসা আর বাসার মানুষজন সৃষ্টি হইছে। ক্লাস থ্রী না ফোরে পড়ি তখন কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম ঈদের আগেরদিন রাত বাইরেই কাটায় দিব। গরু পাহাড়া দিব। সেই উদ্দেশ্য ও বিধেয় সফল হয়নায়। গরুকে মাঝে মাঝে মারার জন্য যেই লাঠির বন্দোবস্ত করছিলাম সেই লাঠি দিয়ে আমাদেরকেই প্রহার করা হবে এমন ভয় দেখিয়ে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে বড় খারাপ সময়। তেজী আর রাগী গরুর পাশাপাশি পাগলা গরু টাইপ একটা ক্যাটাগরী ছিল। এইসব গরুর গুলার কোন সমস্যা ছিল। তারা হুদাই পাগলামী করত। মাঝে মাঝেই তিরিং বিরিং কইরা লাফ দিত। আরেক ধরনের গরু ছিল লম্পট গরু। এই বিশেষ ধরনের গরু নিয়া 'বেকায়দা' সিরিজে একবার বর্ণনা দিয়েছিলাম। আচ্ছা যারা আগে পড়েননাই তাদের জন্য এইখানে দিয়ে দিলাম
//
কোরবানির হাটে এ গিয়া একটা গরু ৪৫০০০ টাকা চাইল। কালো রঙের গরু কিনলাম ৩০,৫০০ দিয়ে। গরু এর চরিত্র আমার থেইকাও খারাপ। তাকে আনার সময় আশেপাশে যে কয়টা গরু পাইসে তার সব গুলার সাথে সে আকাম কুকাম করার চেস্টা করসে। এইরকম লম্পট গরু জীবনে দেখিনাই। এর মধ্যে মাঝপথে এক গরুর উপর সে উইঠা গেল। তাকে আর নামানোই যাইতেসেনা। যার গরুর উপর সে উঠসে সেই গরুর মালিক বেচারা ভদ্রলোক কাউকে কিছু বলতেও পারতেসেনা কিন্তু মুখ দেখে মনে হচ্ছে সহ্যও করতে পারতেসেন না। কি বলবেন? নিজের গরু রেপ হইলে তো আর বংশের উপর কলঙ্ক আসেনা কিন্তু তারপরেও নিঃসন্দেহে অপমানজ়নক ব্যাপার। আমার গরুর লোক এবং ওনার গরুর লোক চেস্টা করতেসে গরু-রেপ ঠেকাইতে। আশেপাশের রিকশার লোকজন দেখি বেশ উপভোগ করতেসে। একজন আমার গরুকে বলল, "তুইও পুরুষ ঐটাও পুরুষ, তাও এমন করস ক্যান" !! কথাটা তো ভাল বলসে!! গে-গরু (homo-sexual cow!!) কিনলাম নাকি!! গরু নিয়া আসতেসি, আমি সামনে, পিছনে গরুর দুই লোকের সাথে গরু। তখনও ঐ লোকের কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগল, তুইও পুরুষ, ঐটাও পুরুষ। আমিও (লেখক) তো পুরুষ। আমার গরুর সামনে এখন আর কোনো গরু নাই। শালার পুত আবার আমারেই গরু না মনে করে!! গরুর লোকগুলারে বললাম, আই তোমরা গরু নিয়ে সামনে যাও। আমি পিছন পিছন আসতেসি। চরিত্র খারাপ মানুষ হোক আর গরু হোক ,কোনো কিছুতেই বিশ্বাস নাই। দুইটাই বেকায়দা।
//
ছোটবেলায় কোরবানীর হাটে যাওয়ার ব্যাপারে তীব্র আগ্রহ প্রকাশ করতাম। কিন্তু সেই আগ্রহ তীব্রতার ডেসিবেল লেভেল আব্বা-সমাজে তেমন পাত্তা পেতনা। আম্মার ধারনা হাটে গেলে আমি হারায় যাব। কোন একবার ম্যানেজ করলাম। গেলাম জীবনে প্রথম হাটে। গরু, গরু আর গরু। গোবর গোবর আর গোবর। এই হাটে যাওয়ার পর যেই ব্যাপারটা চিন্তা করেছিলাম সেটা আসলে তখন বুঝিনাই। এই বুঝাটা পরিষ্কার হল তার অনেক বছর পর। ঢাবি ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের নাসির স্যার এমবিএ ক্লাসে ইকোনোমিক্স পড়ান। বয়স্ক এই টিচার মাঝে মাঝেই অতীতে হারিয়ে যান। ১৯৭৩ সালে চিনির দাম বাড়ার কারনে তার চা খাইতে কি সমস্যা হয়েছিল এই টাইপ আলাপ। তিনি একদিন বললেন , গরু গুলা আসলেই গরু। আমরা নড়েচড়ে বসলাম। গরু তো গরুই হবে। আর কি হবে? উনি বললেন ১০ জন মানুষ মিলে ১০০ টা গরু বাইধা রাখে। গরু গুলা কখনই প্রতিবাদ করেনা। এরা সবাই মিলে মানুষকে আক্রমন করলেই পারে। এ কিরে বাবা। এ তো পুরা রাইজ অফ দ্যা প্ল্যানেট অফ দ্যা এপস মুভির মত রাইজ অফ দ্যা প্ল্যানেট অফ দ্যা গরু মার্কা কথাবার্তা। গরু গুলা আসলেই গরু।
ছোটবেলায় কিন্তু আমরা সবাই রচনা শিখার সময় গরুর রচনাই আগে শিখি। গরু রচনা ছাড়া আমাদের সাহিত্য শিখা কখনো শুরু হয়না। গরু গৃহপালিত পশু। ইহার দুটি চোখ, চারটি পা ও দুটি শিং রয়েছে। গরু আমাদের দুধ দেয় কাউ গিভস আস মিল্ক। গরু ঘাস খাইয়া জীবন যাপন করে কাউ লিভস অন গ্রাস। আর সব রচনার শেষ লাইন একটাই - উই শুড টেক কেয়ার অফ কাউ। লেখা শেষ করার আগে কোরবানী ঈদে ঘটা আমার সব থেকে হ্রদয় বিদারক দুটি ঘটনা বলে শেষ করি। প্রথমটা ২০০৩ সালে। আগের দিন বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কানাডার কাছে হারে। তখনও টিনেজ বয়স। এই কষ্ট সহ্য হয়নায়। কান্নাকাটিও করেছিলাম। ঈদের পরের প্রথম যেদিন পেপার বের হয়েছিল হেড লাইন ছিল- বার কোটি মানুষের ঈদের আনন্দ মাটি করে দিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
আরেকটা ঘটনাও ঐ ঈদেরই। বিকালে বের হলাম। দেখি কাল-মতন একটা ছেলেকে সবাই মিলে মারছে। যে নাকি মাংস চুরি করেছে। ছেলেটার চোখ অদ্ভুত সুন্দর। এরকম মায়াবী চোখের কেউ চোর হতে পারেনা। ভিতর থেকে এক মহিলা আসল। গৃহকর্তী হবে। ছেলেটাকে মারের হাত থেকে বাঁচাল। তার কয়েক বছর পর এই দুইজনকে নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম। গল্পের নাম মাংস চোর কাউলা ।
গরু যে আসলেই গরু এটা যে খালি নাসির স্যারের বক্তব্য ছিল তা কিন্তু না। ক্লাসিক বাংলা সিনেমাতেই গরু নিয়া একটা বিখ্যাত গান আছে। গানের প্রথম লাইন- গরু তুই মানুষ হইলিনা।