ভারত আজ আর গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়—আজকের ভারত এক হিন্দুত্ববাদী নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক প্রকল্প, যেখানে সংবিধানকে অস্ত্র বানিয়ে একের পর এক সংখ্যালঘু নিধন চালানো হচ্ছে। 'ওয়াক্ফ সম্পত্তি আইন ২০২৫' তারই সর্বশেষ অধ্যায়, যেখানে মুসলিমদের শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক অধিকারে রাষ্ট্রীয় লোভের থাবা বসানো হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির সরকার এই আইনকে "দুর্নীতি রোধ" ও "স্বচ্ছতা" আনার উদ্যোগ হিসেবে প্রচার করছে—আসলে এটি এক পরিকল্পিত মুসলিম উচ্ছেদ অভিযান, যা সুপ্রিম কোর্টের রায় না, বরং রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের রূপরেখা।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক—ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার। মুসলিমদের দান-করা মসজিদ, কবরস্থান, দরগাহ—যেগুলোর অস্তিত্ব ধর্মীয় পবিত্রতা ও ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত—সেগুলোর দেখভাল করবে এমন মানুষ, যারা ঐ ধর্মে বিশ্বাস করে না। এটি শুধু ধর্মীয় অধিকার হরণ নয়—এটি একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখার রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত।
নতুন আইন অনুযায়ী, ওয়াক্ফ সম্পত্তি দাবি করার জন্য এখন জেলা প্রশাসকের অনুমতি প্রয়োজন। শত শত বছর ধরে যেসব মসজিদ, কবরস্থান বা দরগাহ মৌখিকভাবে সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, যাদের নথিপত্র নেই, সেগুলো এবার 'অবৈধ' হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে তৈরি হবে 'পুনরুদ্ধারের' অজুহাত—হিন্দুত্ববাদী সংগঠন তখন বলে বসবে, “এই জায়গায় একসময় মন্দির ছিল!” আইন এবার সেই দাবির পক্ষে দাঁড়াবে। বাস্তবে, মুসলমানদের জমি রাষ্ট্রীয় ও জনতা আদালতের মাধ্যমে কেড়ে নেয়ার বৈধতা পাচ্ছে।
বিজেপি বলছে, ওয়াক্ফ বোর্ডের বিশেষ সুবিধা অসাংবিধানিক। অথচ, সারা ভারতে তিরুপতি, জগন্নাথ, কাশী বিশ্বনাথ ট্রাস্ট—হাজার হাজার কোটি টাকার হিন্দু ট্রাস্টের কোনো তদারকি নেই। তাদের দুর্নীতি, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা নিয়ে সরকার নিরুত্তাপ। তাহলে একমাত্র ওয়াক্ফ বোর্ডকে নিশানা করা হচ্ছে কেন? উত্তর একটাই—এটি মুসলিম ট্রাস্ট , তাই একে দুর্বল করতে হবে, খর্ব করতে হবে।
বিজেপির দাবি, ওয়াক্ফ বোর্ড জনসাধারণের সম্পত্তি দখল করছে। এটি চূড়ান্ত মিথ্যাচার। ভারতের ইতিহাসের গভীরে গেলে দেখা যাবে, এই সম্পত্তিগুলো মুসলমান সমাজের দান, কওমি চেতনা এবং পুণ্য অর্জনের বিশ্বাসে উৎসর্গ করা হয়েছে। কারো জমি অবৈধভাবে ওয়াক্ফ হলে আদালতে যাওয়ার সুযোগ তো আগেও ছিল। তাহলে হঠাৎ এই আইনি 'শুদ্ধি অভিযান' কেন? এর পেছনে আছে একমাত্র উদ্দেশ্য—সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত ধ্বংস করা।
এই আইন আসলে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চাপিয়ে দেওয়ার পদধ্বনি—যা হিন্দু জাতীয়তাবাদের আড়ালে একধরনের হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীলনকশা। এটি সংবিধানে স্বীকৃত পার্সোনাল ল সিস্টেমকে মুছে ফেলার সূচনা। মুসলমানদের নিজস্ব আইন, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান—সবকিছুকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। এটি একটি 'আইনি দখলদারি', এক ধরনের 'শুভঙ্করের ফাঁকি', যেখানে সংবিধানের ভাষা ব্যবহার করে সংবিধানেরই আত্মা হত্যা করা হচ্ছে।
ভারতে এই আইন পাস হওয়া মানে কেবল মসজিদ বা কবরস্থানের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া নয়—এটি গোটা মুসলিম সমাজকে ভবিষ্যতের অস্তিত্ব সংকটে ঠেলে দেওয়া। যে ইতিহাস মুছে ফেলা হচ্ছে, তা কেবল গম্বুজ আর ইট-পাথরের নয়—তা এক জাতির আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং বিশ্বাসের উপর সরাসরি আগ্রাসন।
বিরোধী দলগুলো এখন সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন, মুসলিম সমাজ আন্দোলনে নেমেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কতদূর যাবে এই লড়াই ? যখন আইনই হয়ে ওঠে অস্ত্র, তখন সংখ্যালঘুদের পক্ষে প্রতিরোধ করা একরকম অসম যুদ্ধ।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর প্রভাব ভয়ানক হতে পারে। ভারত যদি হিন্দুত্ববাদের পথে উন্মুক্ত গতিতে এগোয়, তাহলে বাংলাদেশে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান ঠেকানো কঠিন হবে। মোদির ভারত শুধু নিজের সংখ্যালঘুদের নয়, পার্শ্ববর্তী দেশের সাম্প্রদায়িক ভারসাম্যকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে।
এই আইন পাস করে বিজেপি ঘোষণা করেছে—ভারত এখন আর কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। এটি এখন সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মে পরিচালিত এক রাষ্ট্রযন্ত্র, যেখানে সংখ্যালঘুদের স্থান কেবল নীরবতা ও আতঙ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ।