কেন বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার.....
হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক ১০ জনের একটা গ্রুপ আছে। আমরা বেশীরভাগ সময়ই সমসাময়ীক বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করি। গত তিনদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার নিয়ে। আমাদের আলোচনার বিস্তার অনেক লম্বা হলেও এখানে আমি আমার মতামত তুলে ধরছি। যদিও একই বিষয়ে আলোচনার বিষয় নিয়ে দুই বন্ধু ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে। আমিও সবার বক্তব্যের সারমর্ম ব্লগে শেয়ার করছি।
রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে 'ডিপ স্টেট' শব্দটা বেশ পরিচিত।
প্রকৃতপক্ষে ডিপ স্টেট শুধু একটি শব্দ নয়, ডিপ স্টেট একটা থিউরিও বটে। আমি, আপনি, আমরা যারা সাধারণ মানুষ, সেই আমরা সাধারণ চোখে যা দেখি তার পেছনে যে গেম চলে, সেই গেম যে বা যারা খেলে- সেটাই ডিপস্টেট বা গেম চেঞ্জার।
এখন কথা হচ্ছে- এই ডিপস্টেট কারা?
উত্তরঃ এই ডিপ স্টেট বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র। এই ডিপ স্টেট হচ্ছে ডগিফাই। এই ডিপ স্টেট হচ্ছে আর্মির শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী টু স্টার উর্ধ্বস্তর জেনারেল।
শেখ হাসিনা সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত ছিলো...
"শেখ হাসিনা নিজে চাইলেও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে পারবে না। বাংলাদেশের ডিপ স্টেট তাকে ক্ষমতা ছাড়তে দিবে না।"
একজন মানুষ কখন স্বৈরাচার হয়ে উঠে? কখন তার হাতে এবসুলেট পাওয়ার জমা হয়? মানুষ যখন ক্ষমতাসীন হয় তখন সাধারণত তার মধ্যে অহংকার জন্ম নেয়। সেই অহংকারের সূত্র ধরেই ক্ষমতাসীনদের নৈতিক অধঃপতন শুরু হয়। সে নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে। এই মনে করা থেকেই একজন শাসক স্বৈরাচার হয়ে ওঠে। প্রথমে তার প্রতিপক্ষের উপর চড়াও হয়। কালক্রমে সে স্রষ্টাকেও প্রতিপক্ষ কিম্বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে দ্বিধা করে না। এসব স্বৈরাচারের ইতিহাস নতুন নয়। প্রাচীন যুগের নমরুদ, ফেরাউন থেকে মধ্যযুগের ইয়াজিদ, হাজ্জাজ ও হাল আমলের আইয়ুব, মুজিব, শেখ হাসিনা, মোদি। কোনো যুগেই স্বৈরাচারের অভাব ছিল না।
আওয়ামী লীগ কি শুধু রাজনৈতিক কিম্বা রাজপথের শক্তি দিয়ে টিকে ছিলো? সন্ত্রাসীদের দিয়ে টিকে ছিলো?
উত্তরঃ না।
আওয়ামী লীগ টিকে ছিলো কারণ, 'ডিপ স্টেট' চেয়েছে আওয়ামী লীগ টিকে থাকুক। ৪ ই অগাস্ট পুলিশ যখন পরীক্ষামূলক ভাবে দেশের কিছু জায়গায় গুলি বন্ধ করে দিলো, সেদিন আওয়ামী লীগ সারা দেশে যে মার খেয়েছে...সেই মারই প্রমাণ করে...আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রেখেছিলো ডিপ স্টেট। এই ডিপ স্টেটের সর্বাত্মক পরাজয় ঘটে ৫ই অগাস্ট। তবে তার আগেই ডিপ স্টেটের একটা অংশ কেবলা বদলে নিরব থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
১/১১ তে উত্থিত শক্তি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরাজিত হয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঘাপটি মেরে থাকলেও সেই পরাজিত শক্তি জুলাই ২০২৪' গণঅভ্যুত্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। আসলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কে ভূমিকা রাখে নাই? ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসর ছাড়া ছাত্রজনতা, রাজনৈতিক দল সবাই ভূমিকা রেখেছে। কিন্ত ৫ই অগাস্টের পর হাসিনা পতনের পর যে যার এজেন্ডায় ফিরে গেছে।
ডক্টর ইউনুস সরকার ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার যে পাওয়ার স্ট্রাকচার সেই পাওয়ার স্ট্রাকচারে কি পরিবর্তন ঘটেছে?
না, একদমই না।
অল্প কিছু আমলার চাকরি গেছে। কিছু পুলিশ অফিসার এরেস্ট হয়েছে। কিছু আর্মি অফিসার এর চাকুরি গেছে। কিন্ত এর বাইরে কি হয়েছে?
ইউনুস সরকার প্রশাসন সাজাবার জন্য নিয়ে আসেন আলী ইমাম মজুমদারকে। আলী ইমাম মজুমদার যুক্তি দেখান বিএনপি পন্থী আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসালে...তাদের কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের হারাবার কিছু নাই। এই সেন্স থেকে তিনি আওয়ামী লীগ পন্থী আমলাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো শুরু করেন এবং এর মাধ্যমেই ডিপ স্টেট আস্তে আস্তে খেলায় ব্যাক করে। প্রশাসন ক্যাডারের মাধ্যমে আবারো পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এবং বিচার বিভাগের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়।
জামাতকে সান্তনা পুরস্কার হিসেবে জামাত মনোনিত আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার এবং বিশেষ সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্ত মূল খেলা দেখা যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাছে। পুলিশ আবারো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নিয়ন্ত্রণে ফেরত যায়।
আপনারা জানেন কয়েক দিন আগে ডিবি প্রধান রেজাউল মল্লিক কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার দোষ ক্রুটি থাকতে পারে। তিনি দুর্নীতিগ্রস্থও হতে পারেন।
কিন্ত তার মূল অপরাধ একটাই-
তিনি একের পর এক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করাচ্ছিলেন ডিবি দিয়ে। আপনারা এই সপ্তাহেই ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টে দেখেছেন যে, ডি এম পি হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ জারী করা হয়েছে যাতে "কতৃপক্ষ" কে না জানিয়ে কোন আসামীকে গ্রেফতার করা না হয়।
ডিবি প্রধান রেজাউল মল্লিক এই নির্দেশনা মানছিলেন না। একারণে প্রথম সুযোগ পাওয়া মাত্র তাকে কুরবানি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে...মিডিয়া / কালচারাল সেক্টর একদম ইন্ট্যাক্ট আছে। অনেক বড় বড় রাজনৈতিক ফিগার এবং কিছু সরকারী লোকজন এখনো দাদা বাবুদের সেবা করে যাচ্ছেন! কারণ উনাদের আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ভয়ে আছেন। অতএব, আপনারাই বুঝবেন, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে কারা?
৫ তারিখের পর বিএনপির বড় একটা প্রাথমিক ফেইলিওর ছিলো তার দলকে কন্ট্রোল করতে না পারা। কিন্ত বিএনপি ধীরে ধীরে কন্ট্রোল গেইন করেছে।
কিন্ত গুজব ছড়ানো কি থেমে আছে?
গত কয়েক দিন একটা ভিডিও ভাইরাল হলো যেখানে দেখা যাচ্ছে- মতিঝিল থানা বিএনপির সভাপতি পরিচয় দিয়ে কেউ একজন চাঁদা দাবি করছেন। কিন্ত আদতে জানা গেলো মতিঝিল থানায় বিএনপির কোন কমিটিই নাই।
একই রকম গুজব লুতফুজ্জামান বাবরের বিরুদ্ধে ছড়ানো হয়েছে। মাহফুজ এর বাবা গণহত্যার সাথে জটিত ছাত্রলীগ নেতাদের বাঁচাতে গিয়ে আহত হন। সেই ঘটনায় গ্রেফতার হয় লোকাল বিএনপি নেতা-কর্মী। ভেবে দেখুন, গণহত্যাকারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার হবার কথা? নাকি গ্রেফতার হবার কথা বিএনপি নেতা-কর্মীদের।
আবার অপপ্রচার এর কথা বলে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নাই...বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে গেছে। কিন্ত তাদের থামাবার কথা কার? সরকারে কে?
ডক্টর ইউনুসকে পাঁচ বছর চেয়ে একটা ক্যাম্পেইন চলছে।
মেক নো মিস্টেক...এইটার একটা অংশ অর্গানিক। শহুরে মধ্যবিত্ত এর একটা অংশ আসলেও চাচ্ছে ইউনুস সাহেব পাঁচ বছর থাক। এরা এটা মনে-প্রাণেই চাচ্ছে।
কিন্ত ক্যাম্পেইনটা অর্গানিক না। একাধিক এক্টিভিস্ট বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে কিভাবে একই পোস্ট বিভিন্ম পেজ থেকে হুবুহু পোস্ট দিয়ে ভাইরাল করা হচ্ছে। এই মেকানিজম বাংলাদেশে একটা সংস্থা সবচেয়ে পার্ফেক্টলি ব্যবহার করে। তারা হচ্ছে- ডগিফাই।
ইউনুসকে পাঁচ বছর চেয়ে করা অর্গানিক ক্যাম্পেইন আমাদের বুকে ভয়ের কাপন ধরায় না। আমরা ভয় পাই...যখন দেখি এখানে ডগিফাই এর ইনভলভমেন্ট আছে।
সরকারের মূল এজেন্ডা কি?
সংস্কার, নাকি বিচার?
বিচারের কাজ কতো দূর এগিয়েছে?
কেন গণহত্যার সাথে জড়িত লীগের নেতা-কর্মীরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে? কেন যে পুলিশ অফিসারই লীগের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে- তাকেই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
ভেবে দেখেছেন- কেন জামাত নিবন্ধন ফেরত পাচ্ছে না? সমস্যাটা কোথায়? ভেবে দেখেছেন- কেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হলো না।
কারণ একটাই, পুলিশ সংস্কার নিয়ে যাতে কোন ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত না হয়। অলরেডি এডমিন ক্যাডারের লোকজন বলে দিয়েছে- পুলিশে কোন সংস্কারের প্রয়োজন নাই। তারা পুলিশ কমিশন হতে দিবে না।
আপনারা নারায়ণগঞ্জের সাজা প্রাপ্ত আসামীর মুক্তি নিয়ে আতংকিত।
হাসিনারে কি তার সন্ত্রাসীরা টিকাইয়া রাখছিলো?
নাকি পুলিশ-র্যাব-বিজিবি?
প্রাথমিক ভাবে উনাদের টার্গেট তিনটা।
প্রথম টার্গেট:
ইউনুসকে টিকিয়ে রাখা পাঁচ বছর। এবং এর মাঝে লীগের বিকল্প কাউকে প্রস্তুত করা যারা ডিপস্টেট এর স্বার্থ দেখবে।
বিএনপিকে ডিপ স্টেট এবং প্রতিবেশী দেশ, কেউই বিশ্বাস করে না। যে তারেক রহমানকে পিটিয়ে ডগিফাউ কোমড়ের হাড় ভেংগে দিয়েছে...সেই তারেক রহমান আসবেন আর ডগিফাইতে হাত দিবেন না...সেটা তারা বিশ্বাস করে না।
টার্গেট দুই:
এই পাঁচ বছরের মাঝে আওয়ামী লীগকে মূল ধারার পলিটিক্সে পুনর্বাসিত করা। তাদের বিশ্বাস এটা করতে পারলে ১০-১৫ বছরের মাঝে লীগের আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
টার্গেট তিন:
যদি বিএনপি ক্ষমতায় চলেই আসে...তাহলে হয় ডিপস্টেট দিয়ে বিএনপি কে টেক ওভার করা, অথবা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে না পারে।
ডিপ স্টেট হার মানবে না। কেউ আমাদের কথাকে গাল গল্প ভেবে উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্ত নিজের কাছে প্রশ্ন করেনঃ
১। কেন র্যাব ভেংগে দেওয়া হলো না?
২। কেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট রাজনৈতিক দল গুলোর কাছে গেলো না?
৩। কেন যে বা যারাই লীগের নেতাদের গ্রেফতার করছেন...তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
৪। কেন প্রশাসনে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হচ্ছে?
৫। কেন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার গতি পাচ্ছে না।
৬। কেন ডগিফাউ এর প্রপাগান্ডা মেকানিজম এখনো এক্টিভ? ডগিফাই এর মেকানিজম কেন এখনো বিএনপি বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে।
বিএনপি তে চাঁদাবাজ আছে। সন্ত্রাসী আছে।
দুর্নীতিবাজ আছে- বর্তমান রাজনৈতিক কালচারে এটা অস্বীকার করার উপায় নাই।
কিন্ত নাগরিক পার্টিকে দেশ চালাবার সক্ষমতা অর্জন করতে আরো ৫/১০ বছর লাগবে। এই দশ বছর লীগের শক্তির সাথে পাল্লা দেবার ক্যাপাসিটি এখন পর্যন্ত বিএনপিরই আছে।
আজকে যদি বিএনপিকে আপনারা মাঠ থেকে উঠে যেতে বাধ্য করেন...কালকেই দিল্লী থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢাকায় ঢুকবে। এক-দেড় মাসের মাঝে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হবে যে, ইউনুস সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে।
জাস্ট এতো টুকু মাথায় রাখেন- কালচারাল সেক্টরে, মিডিয়াতে, প্রশাসনে, আর্মিতে এখনো লীগের সেটাপ অটুট আছে। এটাকে ফাইট দেবার মেকানিজম নিশ্চিত না করে সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্রের বিরুদ্ধে লাগতে যাবেন না। তাহলে আপনিও মারা খাবেন। আমিও মারা খাবো। আমরা সবাই মারা খাবো। এই প্রশাসন সংস্কার করতে না পারলে, এরা ফেরেশতাকেও ফ্যাসিস্ট বানাবে।
মনে রাখবেন, আপনার মেইন শত্রু/চ্যালেঞ্জ রাজনীতিবিদরা না।
আপনার মেইন শত্রু ডিপ স্টেট।
আপনার মেইন শত্রু ব্যুরোক্রেসি।
বিএনপি'র বিরুদ্ধে কথা বলেন।
কিন্ত তারচেয়ে বেশি কথা বলেন পুলিশ, প্রশাসন সংস্কার নিয়ে। কথা বলেন ইন্টার্নাল রাজনীতিতে ডগিফাই এর ইনভলভমেন্ট নিয়ে। এইটা নিশ্চিত করা গেলে, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে চাইলেও হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট হইতে পারবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:১৫