somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা : অরাজকতার পালে নতুন হাওয়া!

২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশে আজকাল দাবি না জানালে কেউ আর মানুষ থাকে না—ছাত্র, শিক্ষক, গৃহিণী, পুলিশ, পিয়ন, কবি, কুস্তিগির, সবাই 'অধিকার' চায়। তবে অধিকার মানে এখানে মোটেই দায় বা কর্তব্য নয়, বরং ছিনিয়ে নেওয়ার লাইসেন্স। দাবির ঢেউ এতটাই উত্তাল যে, মনে হয় এই দেশটা আর যমুনার বাঁধ নয়, যেন এক বিশাল 'দাবির রাজ্য' , যেখানে ন্যায্যতা নয়, গলার জোরই বিচার।

তাই পরামর্শ সহজ—'জাতীয় দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি সংস্থা' গঠন করো, নচেৎ একদিন দেখা যাবে ঢাকা শহরের প্রতিটা মোড়ে একটি করে চায়ের দোকান এবং একটি করে অবরোধ। সারা দেশে ছাত্ররা ক্লাস বাদ দিয়ে আন্দোলন করে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয় চায়, কেউ ভিসির পদত্যাগ। অথচ পাঠ্যসূচি দেখে মনে হয়, এরা যেন 'গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়ার চর্চা ১০১' নামক নতুন কোন কোর্সে ভর্তি হয়েছে। শিক্ষার মান নিয়ে এদের যতটা না মাথাব্যথা, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগ আছে কে কার আগে মাইক ধরবে তা নিয়ে।

দাবির বিষয়েও বৈচিত্র্য আছে। কেউ চায় কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, কেউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বায়ত্তশাসন, আর কেউ সরাসরি রাষ্ট্রপতি হতে চায়। একটা কলেজ, যার র‍্যাঙ্কিং ঢাকার শেষ মাথায় ঝুলছে, সেটিও রাস্তায় নেমে চেঁচায়—"আমরা বিশ্ববিদ্যালয় হবো!" কে যেন বলে, “তোমরা আগে কলেজ হও, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখো।” কিন্তু এই দেশে কে কাকে শোনে?

একটা কথা ঠিক—এই দাবিদাওয়ার চর্চা সবাই চায়, কিন্তু কেউই চায় না নিজেকে তার যোগ্য করে তুলতে। দাবির পূর্বশর্ত হলো যোগ্যতা, কিন্তু সেটা তো আর দেয়ালে লেখা নেই, তাই পাত্তা দেয় কে?

তাই প্রস্তাব একটাই—একটা কেন্দ্রীয় সংস্থা হওয়া দরকার, যেখানে প্রত্যেক দাবিদারকে আগে আবেদন করতে হবে। রাস্তায় নামা যাবে না, ফেসবুকে ‘লাইভ’ চালানো যাবে না, মিডিয়ায় কান্নাকাটি চলবে না। আগে দাবি নিবন্ধন করো, তারপর শুনানি হবে। যে দাবি শুনেই বোঝা যায় রাষ্ট্র দেউলিয়া করে ছাড়বে—সেটা সরাসরি কাউন্সেলিং বিভাগে পাঠাও। প্রয়োজনে বোঝাও—"ভাই, আপনি যে চাচ্ছেন সবাইকে চিরতরে চাকরি দিতে হবে—এটা সম্ভব না, কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থা জাদুর বাক্স নয়।"

আর যে দাবি যৌক্তিক—যেমন সরকারি চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো বা নিরাপদ সড়ক—সেটা সরকারের কাছে পৌঁছাবে। তবে সিদ্ধান্ত তিন মাস বা ছয় মাসের মধ্যে আসবে—এই শর্তে।

এই সংস্থার প্রধান হবেন একজন 'ন্যায়পাল' —নাম শুনলেই বোঝা যায় তিনি দুর্নীতিমুক্ত দেবদূত, যিনি সরকারের ফাইলে আটকে থাকা জনগণের বেদনা নিয়ে ভাবেন। তাঁর অধীনে থাকবে তিনটি বিভাগ: যাচাই-বাছাই, আইন, আর কাউন্সেলিং—যেখানে শোকাহত ছাত্রকে বলা হবে, “ভাই, হাসপাতালের ডাক্তার না থাকায় আপনার বন্ধুটি মারা গেছেন—এটা ভয়ংকর ঘটনা, কিন্তু রাস্তা বন্ধ করে গণমানুষকে শাস্তি দিলে আপনি নিজের দাবি দুর্বল করছেন।”

এ সংস্থা হবে না অন্য সরকারি সংস্থার মতো, যেখানে ‘ফাইল চলে না, ফাইল ঘোরে’। এটি হবে 'সংকট ব্যবস্থাপনা টিম' —প্রজাতন্ত্রের 'ফায়ার ব্রিগেড', যারা দাবি আগুন লাগার আগে পানি ছিটাবে। তবে কিছু দাবি অকর্মযোগ্য—একজন ছাত্রের মৃত্যুতে তাঁর বন্ধুরা রাস্তায় নামে, বাস পোড়ায়। হ্যাঁ, আমরা সবাই কষ্ট পাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন দাবির ফলাফল কী? কাউকে ফিরিয়ে আনা যায় না, আর আন্দোলন করে আরেকজন মরলে লাভ কার?

কাউন্সেলিং দরকার। হ্যাঁ, মানসিক স্বাস্থ্য, আবেগ ব্যবস্থাপনা, শোকের প্রক্রিয়া—এসবও 'নীতি'র অংশ হওয়া উচিত। দাবিদাওয়া মানেই গ্ল্যামার নয়, সেটা সমাজে ভারসাম্য রাখার দায়িত্বও বটে। আর সবথেকে ভয়াবহ দাবির উৎস হচ্ছে 'রাজনীতি' । রাজনৈতিক দাবিগুলো যদি রাজনৈতিকভাবে না মীমাংসিত হয়, তাহলে একসময় দেখা যাবে, ছাত্রদের ভিসি পদত্যাগ চাই, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি চাই, আর নেতাদের দাবি হবে—“আমাকে আগামী প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করো, না হলে দেশ অচল !”

তাই আজকের প্রস্তাব একটা সামাজিক প্রতিরোধ—দাবি জানাবে সবাই, কিন্তু শর্ত সবার জন্য এক:
১. দাবি আগে সংস্থায় জমা দাও
২. সংস্থা যাচাই করবে
৩. কোনো দাবি রাস্তায় না, রিপোর্ট টেবিলে
৪. আর সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে যাও আদালতে—খুলে দেখো সংবিধান

জাতি হিসেবে আমরা যদি প্রত্যেক ছোটো ও বড়ো আকাঙ্ক্ষাকে যুক্তির ছাঁকনি দিয়ে ফেলতে না পারি, তাহলে একসময় আমাদের সত্যিকারের দাবি হারিয়ে যাবে হ্যান্ডমাইক আর ব্যানারের নিচে।

তাই সময় এসেছে 'একটা বুদ্ধির সংস্থা' গঠনের—যেটা না স্রেফ সরকারী, না বিরোধী, বরং নাগরিক বুদ্ধিমত্তার সংহত রূপ। কারণ এই দেশে সমস্যা শুধু দাবি নয়, সমস্যাটা হলো— দাবি জানাতে গিয়ে বিবেক হারিয়ে ফেলি।

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:২১
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। তোমরা সংযত হও, নাহলে আমি পদত্যাগ করবো।

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:০৬




প্রফেসর ইউনূস এখন কী করবেন? তার সামনে বিকল্প খুবই কম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার নেতৃত্ব অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে । হয় তিনি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবেন, না হয় পদত্যাগ করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পুতুল নাচের মাঝের গল্প : ওয়াকার বনাম ইউনূস !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:০৯


বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান অবস্থা দেখে একজন সাধারণ নাগরিক কি ভাবছেন? তাদের ভাবনার আদৌতে গুরুত্ব আছে কোনো ? দেশে ইন্টেরিম সরকার ক্ষমতায় থেকে টেনেটুনে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে নির্বাচন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে...

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২২ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:৪৪


পঞ্চগড় সদর উপজেলার পানিমাছপুকুরি এলাকায় তাওহীদ মডেল মাদরাসার এক শিক্ষার্থী (সুমনা)’র রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের দাবি, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

নিহতের বড় বোন আমেনা খাতুন জানান, কিছুদিন আগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরব বসন্তের মত ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের জুলাই বিপ্লব

লিখেছেন ইশতিয়াক ফাহাদ, ২৩ শে মে, ২০২৫ রাত ১:৫১

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের স্বৈরশাসনের একটি নিদারুণ চক্র যেন ক্রমাগত ফিরে এসেছে। প্রতিটি স্বৈরশাসকের শাসনকাল যেন পূর্বসূরির তুলনায় দ্বিগুণ সময় ছিল ।
শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি - জুলাই বিপ্লবের বিশ্বাসঘাতক

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ২৩ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৩:০১



ডক্টর ইউনুস আর এই দেশের ক্ষমতায় আর থাকতে চাচ্ছেন না। তবে এর দায় ভারতের নয়, পলাতক স্বৈরাচারী আওয়ামিলীগের নয়। এই দায় সম্পুর্নভাবে এই দেশের বৃহত্তম রাজনৈ্তিক দল বিএনপির।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×