somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ঔপন্যাসিক জিল্লুর রহমান
চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। তারপর গল্প, উপন্যাস। এ যাবত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা-২১ টি।

জীবনের শেষ গোধূলী-২

২১ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাঁটতে হাঁটতে ইরা ঠিক সেই জায়গায় গেলো আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে যেখানে সে আর জয় বছরের শেষ বিকেলটা কাটিয়েছিলো। তারপর ইরাকে মোশা নিয়ে গেলো তার বাসায়, তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে প্রথম কয়েকদিন ঘরে বন্দি করে রাখলো, তারপর স্কুল যাওয়ার সময় কাউকে না কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতো, স্কুলের সবাই জানতো তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তার চাকরিকে জিম্মি করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা। তাই সবাই একরকম পাহারা দিয়ে রাখতো ইরাকে, সে যেনো কারো সাথে কথা বলতে না পারে। তার সবসময় নিজেকে কয়েদি মনে হতো, কয়েদি বললে ভুল হবে, চিড়িয়াখানার প্রাণি মনে হতো নিজেকে। হ্যাঁ চিড়িয়াখানার প্রাণিই তো সে, তা না হলে সবাই তাকে দেখতে আসবে কেনো, সবাই তাকে দেখতে আসতো, আর ঘৃণা করতো, আড়ালে ফিসফিস করে বলতো, ছি: এই বয়সে স্বামী-সংসার ছেড়ে মহিলাটা পালিয়ে গিয়েছিলো অন্য পুরুষের সঙ্গে।

পাশে থাকা আরেকজন বললো, শুধু পালিয়ে গিয়েছিলো, বিয়েও করেছিলো কিছুদিন সংসারও করেছে তারপর আবার ফিরে এসেছে। কেউ কেউ বলতো, যখন পালিয়ে গিয়েছিলো তখনো একটা দিক ছিলো তার। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে বিচ্ছেদ হয়, সেই বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তো চলে গিয়েছিলো তো আবার ফিরে এলো কেনো?

একদিন তার এক কলিগ বললো, চলে এলেন কেনো আপা? গেছেন যখন তখন আবার ফিরে এলেন কেনো? সবাই খুব ছি: ছি: করছে। ইরা কারো কথার কোনো জবাব দেয় না। চিড়িয়াখানার প্রাণিগুলোকে কেউ কিছু ছুঁড়লে যেমন তারা আশ্রয় খুঁজে এক কোণ থেকে আরেক কোণে যায়, খাঁচার মধ্যেই নিজের আশ্রয় খুঁজে, ইরাও তেমনি মুখ বুজে চুপ করে নিজের কাছেই নিজের আশ্রয় খুঁজে। কিন্তু এতো বড় পৃথিবীতে তার আশ্রয় কোথায়! গোটা পৃথিবী যেনো আঙ্গুল তুলে তাকে ঘৃণা করছে, তিরস্কার করছে। পৃথিবীতে একটি মানুষও কি নেই তার মনের ভাষা বোঝার। আছে একমাত্র জয়ই ছিলো যে তার মনের ভাষা বুঝতো, সেই মানিক-রতন সে নিজেই ছেড়ে এসেছে। তার সেই স্মৃতি, মানুষের অপমান সইতে না পেরে সে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

মোশা তাকে ঢাকায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালো। ডাক্তার ঔষধের সঙ্গে কিছু পরামর্শও দিলো। তাকে একা থাকতে নিষেধ করলো, তার স্মৃতিময় জায়গাগুলো থেকে দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসার পরামর্শ দিলো। ডাক্তারের পরামর্শ শুনে ইরা হিহি করে হেসে উঠলো, ডাক্তার সাহেব আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, আমার বায়ুবদল দরকার, আগের দিনের উপন্যাসগুলোতে পড়তাম, ডাক্তাররা এমন পরামর্শই দিতেন। এখনকার দিনে এমন হয় না কিন্তু আপনি সেই সেকেলেই রয়ে গেছেন।

মোশা ইরার দিকে একবার রাগান্বিত চোখে তাকাতেই ইরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, তাকাবে না, আমার দিকে এভাবে তাকাবে না। তুমি, তুমি তো আমার সর্বনাশ করেছো, তুমি যদি আমাকে জোর করে নিয়ে না আসতে, জোর করে আবার বিয়ে না করতে তবে আমার কিচ্ছু হতো না। আমার এ অবস্থার জন্য তুমি দায়ি, তুমিই।
যে চাকরিকে জিম্মি করে মোশা জোর করে, কৌশলে, কুটচাল দিয়ে ইরাকে তার কাছে ফিরিয়ে এনেছিলো ইরার মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য সেই চাকরিটা আর থাকলো না।

ততদিনে শুভ’র লেখাপড়া শেষ করে চাকরিও হয়েছে। শুভ’র পোস্টিং হলো পাবনায়। শুভ ইরাকে পাবনায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালো কিন্তু পরামর্শ সেই একই। স্মৃতিময় জায়গাগুলো আর মোশা কাছ থেকে দূরে রাখা। ডাক্তারের পরামর্শে শুভ ইরাকে নিয়ে গেলো তার বাসায় আর মোশা পড়ে রইলো তার গ্রামের বাড়িতে। ইরার ইচ্ছাও তা-ই ছিলো। জয়ের কাছ থেকে তোমরা যদি আমাকে নিয়েই যাও তবে আমি আমার ছেলের কাছেই যাবো। ইরা, তার বউমা ইভা আর শুভ এই তিনজনের সংসার ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। প্রায় বছর দু’য়েক পর ইভার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে, ইরার মতোই হয়েছে। ইরা তার নাতনির নাম রাখলো জুঁই।

সেই জুঁই’র বয়স এখন বিশ বছর। এই বিশ বছরে ঈদে কোরবানীতে ইরা গ্রামের বাড়ি এসেছে কিন্তু বাড়ি এলেই ইরার মাথাটা গোলমেলে হয়ে যায়। ইরা উত্তরের জানালায় বসে স্কুলের সেই বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে, এই বিল্ডিংয়ের কাজ দেখতে জয় আসতো আর তখনই ইরার সঙ্গে জয়ের পরিচয় হয়েছিলো। ইরা সুযোগ পেলেই বিল্ডিংয়ে চলে যায়, দেয়ালে মাথা ঠুকে বলে, কেনো? কেনো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে আবার বিল্ডিংয়ের কাজ দেখতে আসবে। কেনো? আসো না কেনো?

রাতের আঁধারে বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানের ক্রিস্টমাস ট্রিতে ওড়না পেঁচিয়ে ইরা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ইরার সঙ্গে জয়ের কথা ছিলো প্রতি বছর বড়দিনে ইরা এই ক্রিস্টমাস ট্রিকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করবে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবে। জয়ের সাথে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে, স্মৃতিময় দিনগুলোতে ইরার মাথাটা গরম হয়ে উঠে।

জয়পুরহাট এলে ইরা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে যায়। জোরে চিৎকার করে বলে, ঐ যে ক্যাটস পো, আমি আমার জয়কে এই ক্যাটস পো’তে শার্ট কিনে দিতাম, জয় নতুন শার্ট পরে ট্রায়াল রুম থেকে বের হতো, কী স্মার্ট আমার জয়।
জুঁই এসব কথা শুনছে ছোটবেলা থেকে, এখন সে বড় হয়েছে, দাদির কষ্ট সে এখন বোঝে। একদিন জুঁই ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা দাদি তুমি যে সবসময় জয়, জয় করো, কই তোমার জয় তো একবারো তোমার কাছে এলো না। আজকাল তো মোবাইল ফোন আছে, ইন্টারনেট আছে, তোমার জয় তো একবারো তোমার খোঁজ নিলো না।

ইরার মুখ কালো হয়ে গেলো। সে যেনো বুকে একটা ধাক্কা খেলো, আসতো, আসতো কিন্তু আমার মনে হয় তোর দাদু ওকে নিষেধ করে দিয়েছে, হয়তো অনেক বকা দিয়েছে। তোর দাদু যে জটিল, যে পেঁচুক মানুষ, ওর সঙ্গে আমার জয় পারবে না। তুই দেখিস্‌ এবার বাড়ি গেলে আমি ঠিকই জয়কে ডেকে নিয়ে আসবো তোর কাছে, দেখিস্‌ আমার জয় কত সুন্দর আর স্মার্ট।
জুঁই মুখ বিকৃত করে বললো, আছে তোমার জয় এখনো স্মার্ট আছে, সুন্দর আছে, সত্তর বছরের বুড়োর আবার স্মার্টনেস।
ওর শরীরের গড়নটা খুব ভালো। বয়স বোঝা যায় না। দেখিস্‌, ওকে দেখলে তুই আবার বলে ইরা হি হি করে হেসে উঠলো।
জুঁই মুচকি হাসি হেসে বললো, কি ভাবছো আমি তোমার জয়ের প্রেমে পড়ে যাবো?
হ্যাঁ যাবিই তো। তুই দেখিস্‌ কালই আমি ওকে নিয়ে আসবো। কাল একত্রিশ ডিসেম্বর না?
হ্যাঁ, তাতে কী?
একত্রিশ ডিসেম্বর জয় আসবে, আমার সাথে দেখা হবে। আমাকে ও কথা দিয়েছে প্রতিবছর আমরা একত্রিশ ডিসেম্বর একসাথে সূর্যাস্ত দেখবো। কাল আমরা যখন সূর্যাস্ত দেখবো তখন ওকে আমি তোর কাছে নিয়ে আসবো।
জুঁই হি হি করে হেসে উঠলো, দাদু তোমাকে কিছু বলবে না?
ইরা চটে গেলো, কেনো বলবে? কেনো? আমি তো ওরই বউ, মোশা তো আমাকে জোর করে, আমার চাকরিকে জিম্মি করে নিয়ে এসেছে। আমার মনের স্বামী তো জয়-ই।
জুঁই বুঝতে পেরেছে ইরার মাথাটা আবার ডিসটার্ব শুরু করেছে। সে আর কথা বাড়ালো না।
চলবে...


এই গল্পটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:এই গল্পটির প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:জীবনের শেষ গোধূলী-০১
এই গল্পটির শেষ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন:জীবনের শেষ গোধূলী-শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৯:৩৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×