অতি সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধয়ম ও রাজনীতিতে বিশেষ আলোচনায় আসেন টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক যাকে আমরা সকলেই টিউলিপ সিদ্দিক নামেই চিনি। টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সেই সাথে একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও । তিনি ব্রিটিশ লেবার পার্টির চার বারের নির্বাচিত এমপি কিয়ার স্টারমার সরকারের সদ্যবিদায়ী ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার। এর চেয়ে তার বড় পরিচয় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের নাতনি এবং বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে অর্থাৎ শেখ হাসিনার ভাগ্নি। টিউলিপ সিদ্দিকে নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার কারন হলো ব্রিটেনে অবৈধ সম্পত্তি ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও বাংলাদেশেও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ।
২০১৩ সালে মস্কোতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে টিউলিপ সিদ্দিক উপস্থিত থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে টিউলিপ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। এই প্রকল্প থেকে টিউলিপ সিদ্দিক তার খালা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপের মা শেখ রেহানার বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের অভিযোগের তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজউকের পূর্বাচল উপশহরে প্লট গ্রহণের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, বোনের ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে পৃথক তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া ও বাংলাদেশে ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপ, তার খালা শেখ হাসিনা, মা শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক।
পূর্বাচলের প্লটের সাথে ব্রিটেনের ফ্ল্যাটের লোভ সামলাতে পারেন নাই টিউলিপ ও তার বোন। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে তার খালা শেখ হাসিনার ই ঘনিষ্ঠ আবদুল মোতালিফ নামের এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডেভেলপার ব্যবসায়ির কাছ থেকে সেন্ট্রাল লন্ডনের কিংস ক্রসে একটি ফ্ল্যাট ঘুষ নেওয়ার প্রমান সহ অভিযোগ তোলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। এর পর ই ব্রিটেনের মাটিতে শেখ পরিবারের দুর্নীতির কথা বিভিন্ন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম প্রচার হতে থাকে। এর পর ই বেরিয়ে আসে টিউলিপের ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তির ফ্ল্যাট ঘুষ নেওয়ার কথা। আরেক গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের তথ্য মতে ২০০৯ সালে উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডের ফিঞ্চলে রোডে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তিকে একটি ফ্ল্যাট ঘুষ মঈন গনি নমের আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ এক আইনজীবী। আর এই ফ্ল্যাটেই দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন টিউলিপ ও তার স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো মঈন গনি যখন রূপন্তিকে এই ফ্ল্যাটটি ঘুষ দেন তখন রূপন্তির বয়স ছিল মাত্র আঠারো বছর। এই মঈন গণি ছিলেন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির বন্ধু। সেই সুবাদে শেখ হাসিনার সরকারের সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আইনি পরামর্শক ছিলেন। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক মামলার আইনজীবী ও ছিলেন । প্রসঙ্গ শেখ হাসিনার শাসনামলে এই খাতগুলি ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্হ। এই মঈন গণির অদুরদর্শিতার কারনেই আন্তর্জাতিক আদালতে বিভিন্ন মামলায় হারে বাংলাদেশ। ফ্ল্যাটের গোমর ফাঁস হওয়ার পর একে একে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করছে টিউলিপের নানা দুর্নীতির গোপন তথ্য। সেই সাথে পুরো শেখ পরিবারের। টিউলিপের দূর্নীতি নিয়ে এখন সরব ব্রিটিশ রাজনীতি। ইতোমধ্যে টিউলিপকে নিয়ে বেশ চাপে আছেন কিয়ার স্টারমারের সরকার। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি পক্ষ থেকে টিউলিপ সিদ্দিককে তার পদ থেকে সরানোর জোর দাবী উঠলে ইতোমধ্যে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
শেখ পরিবারে সাথে সম্পৃক্ত কেউই দুর্নীতির বাহিরে নয়। সেটা যেমন ১৯৭২ সালে শেখ মজিবর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গ্রহনের পর জাতি দেখেছে তেমনি তার কন্যা শেখ হাসিনার ২০২৪ সালে ক্ষমতা ছেড়ে পলায়নের পর ও দেখলো। গত পনের বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ছিল শেখ পরিবার ও তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও সহযোগীদের সোনার ডিম দেওয়া হাঁস। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বা তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের কথায় না হয় পরেই আসি। যেমন ধরেন টিউলিপ সিদ্দিকের চাচা তারিক আহমেদ সিদ্দিক যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন তিনি, তার স্ত্রী এবং মেয়ে ইতোমধ্যে ইউরোপের দেশ মাল্টার দশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে দুই বার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে ও অর্থ পাচার, দুর্নীতি, প্রতারণা ও ঘুষের অভিযোগে প্রত্যাখাত হয়েছেন। শেখ হাসিনার কন্যা পুতুলের শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৯ সাল থেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগিদার হয়ে বনে গিয়েছিলেন ফরিদপুরের জমিদার। তারা ঘনিষ্ঠ সহযোগী রুবেল বরকত ই নাকি বিদেশে পাচার করছিল ২ হাজার কোটি টাকা। পুতুলের স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতুর অবস্হান সম্পর্কে এখন আর জাতি অবগত নন। কথিত আছে পুতু আর মিতুর সম্পর্ক অনেক আগেই ভেস্তে গেছে যার ই ফলশ্রুতিতে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চলে আগের সকল অভিযান।
ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও অর্থপাচারের প্রমাণ পেয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। এফবিআই-এর একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মানি লন্ডারিং অ্যান্ড লিগ্যাল ইউনিটের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে জয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০০ মিলিয়ন ডলার পাচারের প্রমানপত্র হস্তান্তর করেন। সজীব ওয়াজেদ জয় চাকুরি ব্যবসা না করেই কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজকীয় জীবন যাপন করছেন তা সকলের ই প্রশ্ন৷। বাংলাদেশের শেখ পরিবার আরবের শেখদের মত করেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল বাংলাদেশে তার আরো কিছু নমুনা তুলে ধরলেই বুঝা যবে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর খুলনায় শেরেবাংলা রোডে শেখ হেলালের বাড়ীতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত ছাত্র-জনতা। সেখানে বেশ কিছু দামী গাড়ী ভাংচুর হয়। যার সবকটিই ছিল শেখ হেলালের মনোনয়ন বানিজ্যের উপঢৌকন। যা কিনা ঐ সকল সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় পেয়েছিলেন। শেখ মনির ছেলে শেখ ফজলে নুর তাপস তো ছিলেন ঢাকার মুকুটবীহিন সম্রাট। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়ে পারলে ঢাকার পুরাটাই গিলে খেতে চেয়েছিলেন তাপস। শেখ মনির আরেক ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যান হয়ে কিনা করেছেন। শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের কাহিনি ও একই। শেখ সেলিমের ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম দীর্ঘদিন জোড় করে দখল করে ছিলেন এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি। শেখ সেলিমের ভাগ্নে নিরে আলম চৌধুরী লিটন ও মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন তো ছিলেন মাদারীপুর আর ফরিদপুরে সম্রাট। শেখ হাসিনার পরিবার ও তাদের সাথে সম্পৃক্তদের এমন ভুরি ভুরি উদাহর আছে যা নিয়ে ভবিষ্যতে একটি বই লেখার চিন্তা মাথায় আছে।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শেখ মজিবর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ই শেখ পরিবারের সদস্যরা একেক জন হয়ে ওঠেন পরাক্রমশালী। শেখ মজিবর রহমানের ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ভাগ্নে ফজলুল হক মনি, শেখ সেলিম, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবার সহ শেখ পরিবারের সংস্পর্শে আসা সলেই হয়ে ওঠেন একেক জন মহাদূর্নীতিবাজে। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভাসমাবেশ শেখ মজিবর রহমানকে আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেছে, " সবাই পেলো সোনার খনি", "আর আমি পেলাম চোরের খনি "। ১৯৭২ থেকে পর থেকে বাংলাদেশের দূর্নীতি আর লুট তরাজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে শতাব্দীর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পরতে হয়। ৭৪এর দূ্র্ভিক্ষ নিয়ে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের তার " পোভার্টি এন্ড ফেমিনস " বইয়ে দূ্র্ভিক্ষের অন্যতম কারন হিসেবে উল্লেখ করেছেন দূর্নীতিকে। এই দুর্ভিক্ষে ২৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেলেও শেখ মজিবর রহমানের ভিতরে তেমন কোন অনুতাপ ছিলনা বললেই চলে। ১৯৭৫ সালের ১৭ জানুয়ারি শেখ মজিবর রহমানের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৫৫ পাউন্ড ওজনের কেক কেটে জন্মদিন পালন করেছিলেন শেখ মজিবর রহমান নিজে। এক ই বছর ১৪ জুলাই মহাধুমধামে শেখ কামাল এবং শেখ জামালের বিয়ে হয় সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে। অথচ শেখ মজিবর রহমান তখন মুখে মুখে দূর্নীতি বিরোধী কত কথাই না বলতেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেওয়া ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আজকে আমি বলবো বাংলার জনগণকে—এক নম্বর কাজ হবে দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। আমি আপনাদের সাহায্য চাই। কেমন করে করতে হবে? আইন চালাবো। ক্ষমা করবো না। যাকে পাবো ছাড়বো না। " অথচ তার পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের অধিকাংশ ই ছিল দূর্নীতিগ্রস্হ।
টিউলিপ সিদ্দিক জন্মগত ভাবে ব্রিটিশ নাগরিক। লেখাপড়া বেড়ে ওঠা সবই ব্রিটেনের মাটিতে। ১৬ বছর বয়স থেকেই ব্রিটেনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল লেবার পার্টির রাজনীতি সাথে যুক্ত চার বার এমপি ও হয়েছেন। শুধু টিউলিপ ই নয় তার বোন রূপন্তি ভাই ববি খালাতো ভাই অর্থাৎ শেখ হাসিনার ছেলে জয় মেয়ে পুতুল তাদের সবারই তো বেড়ে ওঠা পৃথিবীর সভ্য দেশে। এমনকি বিয়ে করেছেন সেসব দেশের নাগরিকদের কিন্তু বাস্তবতা এসবের পর ও তারা তাদের বংশগত ধারা থেকে বের হয়ে মন ও মননে সভ্য ভদ্র হতে পারে নাই। তাদের সকলের রক্তের ভিতর ই শেখ বংশের সেই দূর্নীতির ধারা বয়েই চলছে।