ভূমিকা
বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমবাজারে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা এখন এক অনস্বীকার্য শক্তি। আপওয়ার্ক, ফাইভার, ফ্রিল্যান্সার ডটকম, টোসল, গুরু ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে তারা প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা করে অর্জন করছে কোটি কোটি ডলারের কাজ। কিন্তু সেই পরিশ্রমের মূল্য নিজ দেশে পৌঁছাতে গিয়ে তাদের প্রতিনিয়ত পড়তে হচ্ছে এক অনাবশ্যক জটিলতার মুখে। এ জটিলতার কেন্দ্রবিন্দু—PayPal-এর অনুপস্থিতি।
পৃথিবীর ২০০টিরও বেশি দেশে যেখানে PayPal কার্যকরভাবে সেবা দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ তার বাইরে। কেন? শুধু কি প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা? না কি এর পেছনে রয়েছে কোনো গভীর রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক ষড়যন্ত্র?
পেপ্যাল কী এবং কেন এটি অত্যাবশ্যক?
PayPal একটি বিশ্ববিখ্যাত অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, যা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাঝে নিরাপদ ও দ্রুত লেনদেন নিশ্চিত করে। বিশ্বব্যাপী শত শত অনলাইন মার্কেটপ্লেস, ক্লায়েন্ট, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান—সবাই PayPal-এর উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে পেপ্যাল চালু হলে:
ফ্রিল্যান্সাররা সরাসরি ডলার গ্রহণ করতে পারতেন,
লেনদেন হতো মাত্র ১–২ ঘণ্টায়,
এবং ৪০% পর্যন্ত বেশি আন্তর্জাতিক কাজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো।
তাবেদার ফ্যাসিবাদী শাসনের গোপন বাধা
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে PayPal চালু না হওয়ার মূল কারণ প্রযুক্তিগত দুর্বলতা নয়, বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ।
১. ভারতীয় প্রেসক্রিপশন ও প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ
বিগত তাবেদার সরকার দীর্ঘ সময় ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি-সেবা বাধাগ্রস্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারতে Paytm, RazorPay, PhonePe-এর মতো সার্ভিসের বাজারে আধিপত্য ধরে রাখতে বাংলাদেশে PayPal-এর প্রবেশ ঠেকানো হয়। এতে উপকৃত হয় ভারতের ফিনটেক ইকোসিস্টেম, ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা।
২. ব্যাংকিং লবির ষড়যন্ত্র
PayPal সরাসরি ডলার লেনদেনের সুযোগ দেয়, যা অনেক স্থানীয় ব্যাংক ও ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের কমিশননির্ভর ব্যবসায় বাধা তৈরি করে। এই মহল চায় না এমন কোন ব্যবস্থা আসুক, যাতে তাদের মাধ্যম ছাড়া ফ্রিল্যান্সাররা অর্থ আনতে পারেন।
৩. নিয়ন্ত্রণের ভয়
সরকার চায় বৈদেশিক লেনদেন পুরোপুরি ব্যাংকিং চ্যানেলের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। অথচ ফ্রিল্যান্সিং কোনো রেমিট্যান্স নয়, এটি রপ্তানি আয়ের অংশ। এখানে নিয়ন্ত্রণ নয়, স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বর্তমান বাস্তবতা: ফ্যাসিবাদ পালিয়েছে, কিন্তু বাধা কাটেনি
বর্তমানে দেশের নেতৃত্বে আছেন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। নতুন সরকারের কাছে প্রযুক্তিপ্রেমী তরুণরা আশা করেছিলেন—অবশেষে পেপ্যাল চালু হবে। কিন্তু সেই আশায় এখনও জল ঢালা হয়নি।
এর পেছনে কারণ:
আমলাতান্ত্রিক গোঁড়ামি ও জ্ঞানের ঘাটতি
স্থানীয় মুনাফাখোর লবির চাপ
বিদেশি চাপে গঠিত পুরনো চুক্তির দাসত্ব
ফ্রিল্যান্সারদের আর্থিক ক্ষতি: প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার লোকসান
বিকল্প মাধ্যমে (পেওনিয়ার, ওয়াইজ, স্ক্রিল) টাকা আনতে হয় ৩-১০% বেশি ফি দিয়ে
সময় লাগে ৫-৭ দিন, যার কারণে অনেক ক্লায়েন্টের আস্থা হারায়
অনেক ক্লায়েন্ট একমাত্র PayPal পেমেন্ট গ্রহণ করে, ফলে তারা বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের এড়িয়ে চলে
করণীয়: পেপ্যাল চালুর বাস্তব পদক্ষেপ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন: PayPal কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও বাস্তবধর্মী চুক্তি
ডিজিটাল পেমেন্ট নীতিমালার সংস্কার: বিদেশি পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহারে আর্থিক স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রগতিশীল রেগুলেশন
জাতীয় স্বার্থে লবি প্রতিরোধ: দেশীয় স্বার্থবিরোধী লবির বিরুদ্ধে আইনি ও নীতিগত অবস্থান
ফ্রিল্যান্সিং রেমিট্যান্স স্বীকৃতি: জাতীয় বাজেট ও নীতিমালায় ফ্রিল্যান্স আয়ের জন্য আলাদা সুবিধা ও সংরক্ষিত প্রণোদনা
উপসংহার
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ রাত জেগে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্ববাজারে দেশের পতাকা তুলে ধরছে। অথচ রাষ্ট্র এখনো তাদের পাশে নেই।
PayPal চালু না করা শুধু প্রযুক্তি-বান্ধবতার অভাব নয়—এটি এক গভীর রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
দেশের ফ্রিল্যান্সিং অর্থনীতি বাঁচাতে হলে পেপ্যাল চালু করতে হবে এখনই।
আর নয় দেরি, আর নয় গড়িমসি—এবার প্রয়োজন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, স্বচ্ছ নীতি ও সময়োপযোগী বাস্তবায়ন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭