হাসপাতালের এক ওয়ার্ডবয়। আসলে ওদের ওয়ার্ড‘ম্যান’ই বলা উচিত। বয়স ৪৫-এর মতো। নাম বলছিনা, কারণটা বলছি পরে। কথা বলে একদম উচ্চশিক্ষিতের মতো শুদ্ধ বাংলায়, মাঝে-মধ্যে চমকে দিয়ে ইংলিশও বলে! ওয়ার্ডে আমার সাথে কাজ করে সে। খুবই পছন্দ তাঁর আমাকে, অন্য কোথাও যাবে না। অন্যদের ব্যতিক্রম- আমি ‘আপনি’ বলি, খোঁজ-খবর নেই একটু বেশি, আমার নাকি ব্যবহারও ভালো! নিজ জেলা চাঁপাই থেকে কয়েকবার আমও এনে খাইয়েছে।
তাঁকে ভালোভাবে না দেখলে বুঝার উপায় নেই যে, ওর একটা চোখ নেই, পাথর বসানো। ১৭ বছর বয়সে সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, হিলট্র্যাক্সে এক নাইট-এক্সারসাইজে চোখে কি যেন এক বিষাক্ত পোকা পড়েছিল, হাসপাতালে আনতে আনতে চোখটা নাকি নষ্ট হয়ে যায়। পরে ওকে মেডিক্যালি আনফিট হয়ে চাকরী ছাড়তে হয়। তবে, আর্মি ওকে ফুল বেনিফিটসহ টাকা দিয়েছে এবং হাসপাতালে এই চাকরীটিও তাদেরই ব্যবস্থা করে দেয়া।
কিছুদিন আগে হটাত সে আমাকে চাকুরী ছেড়ে দেয়ার কথা বললো। কারণ জানতে চাইলে বললো, স্যার, আমি ছুটি নিয়ে নিয়ে এরমধ্যে বিএ এবং এমএ পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছি। গ্রামে লোকেরা আমাকে ‘ওয়ার্ডবয়/পিয়ন’ ইত্যাদি ডাকে। আমার ছেলেমেয়েরা একদিন বড় হয়ে ওদের বাবার এই পরিচয় দিবে - সেটা আমি হতে দিবো না। আমি মফস্বলের একটি কলেজে সোশিয়লজিতে লেকচারারের চাকরি পেয়েছি স্যার।
আমি খুবই খুশি হলাম, উৎসাহও দিলাম তাঁকে। আরো বললাম, আমাকে এতদিন বলেননি কেন? সে বললো, স্যার, গত ১৫ বছর যাবত আমি টিউশনি করি। প্রতিবছরই বেশ কয়েকজনকে ফ্রি পড়িয়েছি। আরো জানলাম, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ৩/৪ প্যাকেট ভাত-ডাল আর আলুভর্তা পলিথিনে ভরে সাইকেলের ক্যারিয়ারে নিয়ে বের হয় সে। বাসস্ট্যান্ড/ট্রেনস্টেশনে গিয়ে অভাবীদের দিয়ে আসে! ‘আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় আজ আমি আমার পরিচয় বদলাতে পেরেছি, স্যার! আমার জন্য দোয়া করবেন।’
তন্ময় হয়ে গেলাম আমি! কোথায় আছি আমরা?! মনে মনে এই নীরব-নিঃস্বার্থ সমাজসেবকটিকে অন্তর থেকেই স্যালুট দিতে ইচ্ছে হলো, দিলামও! ভাবলাম, সব মানুষের বাহির দেখে অন্তরটা বুঝা যায় না। আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম: ‘হে আমার রব! লোকেরা আমাকে যেমন জানে - আমার অন্তর, আমার আসল আমি আর কাজকে তার চেয়েও অনেক অনেক ভালো করে দাও!’
কৈফিয়ত: আজ তিনি কলেজ-শিক্ষার্থীদের সম্মানিত টিচার। তাই তাঁর নাম বললাম না।