দার্জিলিং এ সাধারনত ৩টা সাইট সিয়িং এর অপশন দেয়। 7 places, 5 places or 3 places। আগের বার আমি ৭টা জায়গা নিয়েছিলাম, পরেরবার ৩টা। পরেরবারেরটাই আগে বলি। ৭টা জায়গা শুনে লাফ দেয়াটা মোটেই ঠিক না, কারন তার মাঝে বেশীর ভাগই ভুয়া। আসল জায়গা দুই তিনটাই, বাড়িয়ে কুড়িয়ে এরা ব্যবসার কারনে ৭টা করেছে। বের হতেই আমরা ঘুমে পৌঁছলাম, সেই সমরেশের ঘুম স্টেশন।পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী উচ্চতার রেল স্টেশন। বাচ্চা একটা স্টেশন, দেখেই মায়া লাগে। টয় ট্রেনটা আসলেই খেলনা ছাড়া কিছু না। এত আস্তে আস্তে চলে যে ২০ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে লাগে মনে হয় ঘন্টা তিনেক। প্রেম করার জন্য চমৎকার জায়গা। একবার উঠে পড়লেই হল, খরচ নেই, রোমান্টিক পরিবেশের অভাব নেই, শুধু গল্প! মাত্র ৩টা বগী, একারনে টিকিটের সংকট। আমরা অবশ্য দেখেই শান্ত থাকলাম, কারন টয় ট্রেনে চড়তে গেলে আমাদের কোন সাইট ই আর দেখা হবে না। আমরা চেঁচিয়ে প্যাসেঞ্জারদের উদ্দেশ্য হাত নাড়লাম, তারাও বিপুল উৎসাহে হাত নাড়তে থাকলো। একটু পর দেখলাম, টিকিট কালেক্টর বেড়িয়ে আসলো হাত নাড়তে। তবে এসব কাহিনী ফেরার পথে।
টয় ট্রেন। সব টয় ট্রেন নীল হয় কেন?
সেদিন আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল টাইগার হিল। সূর্যোদয় দেখতে হবে সেখানে। একারনে ভোর ৪টায় যখন বের হই, তখন আবার গোটা শহর ঘুমিয়ে। ঘুম স্টেশন শুনশান, টিমটিম করে দুই একটা বাতি জ্বলছে। সেটা না থাকলে বোঝাই দায় হত যে এটা একটা স্টেশন। স্টেশন পার হয়ে চললাম টাইগার হিল। হিলে পৌঁছে ঠান্ডায় ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। একেক জন ৩/৪ পরত কাপড় চড়িয়েছি গায়ে, তারপরো ঠান্ডা যেখানে খোলা পাচ্ছে, কামড় বসিয়ে দিচ্ছে।কেউ কাউকে চিনতে পারছি না, কাপড় দেখে ঠাহর করছি যে কে কোনটা হতে পারে। টেনিদা যে টাইগার হিলে এসে ঠান্ডায় ক্যাবলাকে মারতে চেয়েছিল, ঠিকই করেছিল। আমাদের এক বন্ধু ঠান্ডায় টিকতে না পেরে কান্না জুড়ে দিল আর শুরু করলো তার বয়ফ্রেন্ডকে ঝাড়ি পট্টি। অভিযোগ, কেন তাকে আনা হলো। অবজারভেটরী বিল্ডিং এ উঠতে ৫০ থেকে ৮০ রুপী লাগে, আর নিচে মাত্র ১০ রুপী। আমি পন্ডিতি করে বললাম যে এমন কি ঠান্ডা! পারবো না ৮০ রুপী দিতে। সবাই নীচেই থাকলাম।কাজটা ভয়ংকর রকমের বোকামী হয়েছিল, কিছুক্ষন পরই টের পেলাম। এদিকে সূর্য আর উঠে না।পেয়ালার পর পেয়াল কফি আর চা চালাচ্ছি, দ্রুত খেতে হচ্ছে। একটু দেরী করলেই চা পুরো বরফ। আগের বারো মেঘের কারনে সূর্যোদয় দেখতে পারিনি, আমি তো আল্লাহ আল্লাহ শুরু করলাম। এবার আল্লাহ নিরাশ করলেন না। ৩০ মিনিট ঠান্ডায় জমিয়ে দেয়ার পর বাতাস মেঘগুলো সরিয়ে গেল। চারপাশ পরিস্কার হয়ে গেল, কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া স্পস্ট হলো, কিন্তু আলো? একটু পর পূর্ব দিগন্ত লালিমায় ভরে গেল, সূয্যি মামা উঁকি দিলেন। আবার সেই অপূর্ব দৃশ্য। একটি একটি করে চূড়া প্রথমে লাল, এর পর কমলা এর পর হলুদ আলোয় ভরে গেল। পিছে রংধনুর সাতটি রঙ এসেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। লেখক হলে নিশ্চই আমি বিশেষনে ভরিয়ে দিতাম, কিন্তু এই অধমের চোখে মুগ্ধতা আর কন্ঠে সুবহানাল্লাহ ছাড়া আর কিছুই এলো না। নেপালের সারংকোটের অন্নপূর্না আর কাঞ্চনজঙ্ঘার মাঝে কোন তুলনা আসা ঠিক না, কিন্তু তারপরো আমি অন্নপূর্ণাকেই এগিয়ে রাখবো। আরো কয়েক দফা চা পানের পর আমরা নীচে নামলাম। এবার শহরমুখী যাত্রা।
যখন পৌঁছালাম টাইগার হিলে।
মেঘের সমুদ্র।
অবজ়ারভেটরী বিল্ডিং, ভাঙ্গা চোরা।
লালিমা শুরু।
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল।
রক্তিম কাঞ্চনজঙ্ঘা।
সূর্য আবার মেঘের আড়ালে যাবার পর।
দার্জিলিং এ বিখ্যাত সব স্কুল। অনেকেরই আত্মীয় বা ভাই বোন পড়ে গেছে এখান থেকে। অবশ্য কোনটার নাম এখন মনে নেই, তবে বেশীর ভাগ স্কুলই বেশ বড় সড় আর দেখতে ভালো। সারা রাস্তা ছোট ছোট বাবু গুলো লাল লাল কোট পরে হেঁটে স্কুল যাচ্ছে একা একাই। গাল গুলো ঠান্ডার জন্য টকটকে লাল, দেখলেই আদর লাগে। দার্জিলিং এর বাড়ী গুলি সবই বহুতল। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের সর্বোচ্চ তলা টা হচ্ছে আমাদের একতলা। মানে পাহাড়ের কিনারে বানানো বাসা, নীচ থেকে উঠতে উঠতে রাস্তায় এসে শেষ হয়েছে। দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথম সবচেয়ে উপরের তলা, এর পর নীচে নামতে হয়। এখানকার মানুষজন খুবই সৌন্দর্যপ্রিয়। চমৎকার সব ফুলের টব, প্রতিটি বাসা বাড়ীর সামনে। অদ্ভুত রকমের রঙিন সব ফুল। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। এখানকার কুকুর গুলিও মহা আদুরে। লম্বা লম্বা লোম। ব্যক্তিগত ভাবে আমার সাথে সকল পশু পাখির শত্রুতা, আমিও সবাইকে ভয় পাই, ওরাও সেটা বুঝে মজা নেয় একেবারে পুরো মাত্রায়। কিন্তু এখানকার কুকুর গুলি অনেক ভদ্র। কারো সাতে পাঁচে নেই।
প্রতি বাড়ীর সামনে এরকম ফুলের টব।
আদুরে কুকুর, পিঠে চাপড় দিলেও রা কাড়ে না।
দার্জিলিং এর আনাচে গানাচে অসংখ্য বুদ্ধ মনাস্টারি। খুবই চমৎকার, তবে বিখ্যাত হাতে গোনা দুই একটি। তার মাঝে একটির নাম সবার আগে আসে, ঘুম মনাস্টারি বা ইগা চোলিং বৌদ্ধমঠ। ১৮৫০ সালে তৈরী এই মঠ দার্জিলিং এর সবচেয়ে পুরানো মঠ। দেয়ালে চমৎকার সব শিল্পকর্ম, বেশীর ভাগ দেখলেই মনে হয় ছোট বেলায় যে চিনা রূপকথা পড়তাম, তার চরিত্র। মূল মন্দিরে যাওয়ার আগে আরেকটি বিল্ডিং পড়ে, এখানে দেয়ালে তিব্বতি বা চিনা ভাষায় অনেক মন্ত্র লিখা। মূল মন্দিরের মাঝে বিশাল এক বৌদ্ধ মূর্তি। বাতাসে মিষ্টি ফুলের গন্ধ, ভিক্ষুরা পবিত্র জল ছিটাচ্ছে আর জপযন্ত্র ঘুরাচ্ছে। জপযন্ত্র দেখলেই আমার জটায়ুর কথা মনে পড়ে। সাথে সেই বিখ্যাত উক্তি, “ওম মণি পদ্মে হুম হুমকি”।বাহিরে বাচ্চা ভিক্ষুরা ছুটাছুটি করে খেলছে। সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা পরিবেশ, গেলে আপনা থেকেই মন শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু এখানকার ভিক্ষুরা বড়ই কড়া, ভিতরে একটি ছবিও তুলতে দিল না। বাহির থেকে যা দেখা যায়, শুধু তার ছবি তোলা অ্যালাউ করে। তাই তুল্লাম, কি আর করা। সেদিন চরম ঠান্ডা, কুয়াশা আর মেঘে সর্বত্র মোড়া। একারনে ছবি গুলি একটু ঘোলা।
মূল গেট।
দেয়ালের চিত্র।
মূল মন্দির।
প্রেয়ার হুইল।
মন্দিরের ঠিক বাইরে একটা বিশাল গোল ঘন্টা। দূর্যোগ বা বিশেষ ঘটনা সবাইকে জানানোর জন্য এতে কাঠের হাতুরি দিয়ে বাড়ি দেয়া হয়। দেখেই হাত নিশপিশ করতে থাকলো। ভালো করে তাকিয়ে যখন দেখলাম কেউ নেই, তখন ভাবলাম একটা বাড়ি দেই। কেবল হাতুরিটা হাতে নিয়েছি আমি আর ফারিয়া, চিল চিৎকার দিয়ে এক ভিক্ষু ছুটে এসে কেড়ে নিল। শুধু কেড়েই নিল না, সবাইকে ডেকে যে বললো তা বাংলায় অনুবাদ করলে হয়, “আপনারা এসেছেন অনেক খুশী হয়েছি, কিন্তু অনেক হয়েছে। এখন আমাদের প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটছে”। কি কথা! অথচ এর আগেরবার আমি ঘুমে আসিনি, অন্য একটি মঠে গিয়েছিলাম। সেটাও মোটামোটি বিখ্যাত, নাম দালি মনাস্টেরি। ঘুমের চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু সবাই অনেক ফ্রেন্ডলি ছিল। এমনকি ভিক্ষুরা আমাদের সাথে ছবিও তুলেছিল। দালি মঠে গৌতমের ধর্ম প্রচারের গল্প চমৎকার করে রঙিন কালিতে দেয়ালে আঁকা। আর বাইরে বিশাল এক পাপ মোচন ঘন্টা।
সেই ঐতিহাসিক ঘন্টা।
মন্দিরের বাইরে ভিক্ষুদের বসার জায়গা।
দালি মনাস্টেরির গৌতম বুদ্ধ।
দেয়ালে সচিত্র গল্প।
এরপর গেলাম ঘুম মনাস্টেরি থেকে প্রায় ৩ কিমি দূরে, বাতাসিয়া লুপ। একে লুপ বলে কারন বিখ্যাত টয় ট্রেন দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ী যাওয়ার পথে এটা প্রদক্ষিন করে একটা লুপ তৈরী করে। হিমালয়ের একটা অংশ এখান থেকে স্পস্ট দেখা যায়। লুপের মাঝে গোরখা মেমোরিয়াল সৌধ। সৌধের গায়ে মাতৃভূমিকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হওয়া সকল গোরখা যোদ্ধাদের নাম লিখা। সৌধের জন্য এত চমৎকার জায়গা বুঝি আর হয় না। প্রতিদিন টয় ট্রেন একবার চক্কর দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়, আর হিমালয় তার বিশাল ভালোবাসা নিয়ে ঘিরে রেখেছে।
হিমালয় দিয়ে ঘেরা স্মৃতিসৌধ।
সৌধের পাশে একটি ছোট বোটানিকাল গার্ডেন আছে, শুধু ওষধি বৃক্ষের। বাহিরে আবার স্ট্রীট ফুডের পসরা। ইশ, এরা কি আমাকে শান্তি দেবে না? আবার খেলুম, যা পেলুম সব। তেলে ভাজা গুলি যেন হেলাল হাফিজের কবিতা! একেকজন ৩/৪ প্লেট করে খেয়ে ফেললাম। এখানে দার্জিলিং এর জাতীয় পোশাক পাওয়া যায়, ৫০-১০০ রুপীতে ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা সবাই পড়ে ফেললাম, একেক জনকে দেখতে যে কি লাগলো, সে আর বলার না। দেশে এসে আমার পহেলা টার্গেট ছিল, সবার ক্যামেরা থেকে ওই পোশাক পরা আমার ছবিগুলি মুছে দেয়া! তাই বরং পিচ্চি একটা বাবু যেও কিনা বাংলাদেশ থেকেই গিয়েছিল, তার ছবিই দেয়া যাক।
পরের জায়গাটা ছিল সবচাইতে সুন্দর। গঙ্গামায়া পার্ক এবং রক গার্ডেন একসাথে। গিয়ে মুগ্ধ। রক গার্ডেন দার্জিলিং থেকে প্রায় ১২/১৩ কিমি দূরে।পাথুরে রাস্তা, বড় বড় পাথরে পার্কটা ভরা। ঝরনার পানি তীব্র গতিতে নামছে, পাথরে ধাক্কা খেয়ে ক্ষনিকের জন্যও থমকাচ্ছে না, বরং চারিদিকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। অ্যাডভেঞ্চারের জটিল জায়গা। পাথর বেয়ে উঠতে গিয়ে একটুর জন্য কয়েকবার আছাড় খেলুম না। টলটলে পানি, পা ডুবিয়ে রাখতে ভীষন ভালো লাগে।
পাথরের মাঝে বসবাস।
মন্তব্য নিস্প্রোয়জন।
রক গার্ডেন ঘোরা শেষে পার্কটা ঘুরে দেখলাম। একটা সবুজ রঙের লেক আছে পাথর গুলো থেকে বেশ দূরে, ঝরনা থেকে পানি পড়ছে। পাখির ডাকে পাহাড় মুখরিত আর একটা শান্ত ঝরনা, কেমন যেন একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব। জুটিগুলো প্রকৃতিকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সেই হারে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। পানি পরিশ্রুত করে দার্জিলিং এর এই পাশটাতে পানি বুঝি এইখান থেকেই কিছু সরবরাহ করে, ঠিক মনে নেই কি বলেছিল। অনেক ক্ষন থাকলাম।আরেক দফা আইসক্রিম এবং চাট খাওয়া দিলাম।
আবার ছায়া। তবে আসলেই বুঝতে পারছি না আমি কোনটা, সাধারনত আউলা ঝাউলা চুলের কারনে আমাকে চেনা যায়, এখানে দেখি আরেকটার চুলেরো আমার মত কাউয়ার বাসা।
(চলবে)
দার্জিলিং জমজমাট! (প্রথম পর্ব)