যতবার বেড়ানোর সুযোগ আসে, সাথে করে ১০১টা ঝামেলা নিয়ে আসে। যখন আম্মু ফোন করে বললো যে রোটারী ক্লাব থেকে ভূটান যাচ্ছে, আমি পারব কিনা, তখনি জানতাম যে ঝামেলা লাগবে। ইন্টার্নশীপ জয়েন করসি মাত্র ১০ দিন, এর মাঝে ছুটি কি করে পাওয়া সম্ভব? এদিকে বরফ পড়া দেখার জন্য তখন আমার ছটফট অবস্থা। সবাই বুদ্ধি দিল যে কাউকে বলার দরকার নাই যে দেশের বাইরে যাব। কাঁচুমাচু মুখে সিএ রে দরখাস্ত দিলাম যে জরুরী কারনে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। যদিও ভূটান থেকে ফিরে এসে টের পেলাম আমার এক গুনধর বন্ধু আমি যাওয়ার দ্বিতীয় দিনেই ঢাক পিটিয়ে দিয়েছিল!!! সে যাই হোক, আমার তো আর মিস হলো না আরেকটা ট্রিপ!
ভূটান বাই রোডেও যাওয়া যায়, কিন্তু কেউ ট্রানজিট ভিসার ঝামেলায় যেতে চাইল না (যাওয়া উচিতও না!!!), ঠিক হল ড্রুক এয়ারে করেই যাব ল্যান্ড অফ থান্ডার ড্রাগন।ড্রুক শব্দটা তিব্বতী, এর অর্থ থান্ডার ড্রাগন। ভূটানিরা নিজেদের দেশকে বলে ড্রুক ইউল (Druk Yul)। প্লেনটা যথেষ্টই ছোট, তবে অনেক কিউট এটা বলতেই হবে। প্লেনে উঠে দেখলাম ভূটানের একটা পত্রিকা রাখা, TASHI DALEK, ভূটানি ভাষায় welcome বা blessing! আগে ভাগেই জানালা দখল করেছিলাম, পরে দেখলাম কাজটা খুবই ভালো হয়েছিল! মেঘের রাজ্যে বিরক্ত হয়ে বেশীর ভাগ সময়ে আমি প্লেনে হয় ঘুমাই নতুবা বই পড়ি। কিন্তু ভূটান যাত্রায় দুইটার একটাও করতে হয়নি। বাংলাদেশ সীমানা পার হওয়ার কিছুক্ষনের মাঝেই মাথা খারাপ হয়ে গেল। দূরে আবার সেই হিমালয় রেঞ্জ! বরফের পাহাড় যা বারবার দেখলেও পুরানো হয়না। আব্বুর বদ্ধমূল বিশ্বাস সেটা কাঞ্চনজঙ্ঘা, আমি যদিও নিশ্চিত নই হিমালয়ের কোন অংশ সেটা। নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর বিশাল সবুজ পাহাড়… চোখে না দেখলে বোঝা সম্ভব না কবিরা কেন এত সরব! আর দূরে গর্বের সাথে বরফের পাহাড় তো রয়েছেই। ভূটানের প্লেন জার্নি যেরকম উপভোগ করেছি, সেরকম আর আমি কোথাও করিনি। প্লেন থেকে তোলা ছবিগুলো পুরো ট্রিপে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি।
মেঘের সমুদ্র
মেঘ, পাহাড় আর আকাশ….সবাই একসাথে
ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, হঠাৎ এয়ার হোস্টেসরা খাবার নিয়ে আসলো। জঘন্য খাবার। স্যান্ডউইচের মত একটা সহজ সাধারন খাবারকে কি করে এত বাজে বানালো সে এক রহস্য। বরাবরের মতই কফিতে যতই ক্রিম আর কফি ঢালা হোক না কেন, সেটা মিষ্টি গরম পানি ছাড়া আর কিছু হয়না। খাবারের ব্যাপারে মনে হয় বাংলাদেশ বিমান আর ড্রুক এয়ার একেবারে ভাই ভাই।
প্লেন থেকেই টের পাচ্ছিলাম যে ভূটানে আর যাই থাকুক, সমতল জায়গা একেবারেই নেই। পুরোটা দেশ পাহাড়ের উপরে। সেজন্য মনে হয় এয়ারপোর্টটাও পারোতে, রাজধানী থিম্পুতে নয়। পারোর রানওয়ে দেখে মাইল্ড স্ট্রোক হল, ঢাকার ৫ ভাগের এক ভাগ হবে কিনা কে জানে, এতই ছোট। প্লেনটা যখন নীচে আস্তে আস্তে নামা শুরু করলো আমার মনে হলো আমি কম্পিউটারের গেমসের একটা ক্যারেক্টার। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সরু জায়গা দিয়ে একবার যাচ্ছে, আরেকবার কোন এক পাহাড় থেকে বেড়িয়ে আসা বড় পাথরের নীচ দিয়ে।মাঝে মাঝে মনে হল যে গাছের ডালে প্লেনটা বাড়িই খায় কিনা! জানালা থেকে চোখ সরানো অসম্ভব। আড়চোখে একবার দেখলাম আম্মু কি করছে, নিশ্চিন্ত হলাম দেখে যে ম্যাগাজিনে ডুবে আছে। একটু টেনশন হচ্ছিল যে নামার সময় করবেটা কি! সবার টেনশন দূর করে ভালোয় ভালোয় নামলো। পরে শুনলাম যে ভূটানে ল্যান্ডিং করার জন্য নাকি মাত্র ৭/৮ জন অভিজ্ঞ পাইলট আছেন, সবাই এখানে প্লেন নামাতে পারে না।
দুই পাহাড়ের মাঝখানে।
এয়ারপোর্ট দেখে আরেকটা ধাক্কা খেলাম। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যে এমন হতে পারে ধারনাই ছিল না। চারিধারে সবুজ বিশাল পাহাড়ে ঘেরা মিষ্টি ছোট একটা এয়ারপোর্ট। একটাই মাত্র বিল্ডিং, ভূটানের ঐতিয্যবাহী ড্রাগনের ছবি আঁকা। আমাদের প্লেনটাই একমাত্র প্লেন, আর একটু দূরে প্লেন থেকে নামার আরেকটা সিঁড়ি। খুবই হোমলি একটা ভাব। দরজার সামনে ভূটানি পোষাক পড়া দুইজন স্টাফ সবাইকে চেক করলো। সোয়াইন ফ্লুএর জন্য সাবধানতা, আর কিছু না। ওদের পোষাক দেখে একটু চিন্তা হলো, ছেলে মেয়ে সবাই এরকম খাটো স্কার্ট পড়ে, এরকম বরফ পড়া দেশে শীত মানে কি করে! ভুটানে on arrival ভিসা দেয়, সাথে করে অবশ্যি ছবি নিয়ে যেতে হয়। নেপালে এক আংকেল ছবি আনতে ভুলে যাওয়ায় পুরো ২০০ রুপী দিয়ে ছবি তুলতে হয়েছিল এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টতা যেমন ছোট, স্টাফ সংখ্যাও সেরকম। ভূটানীরা সবাই খুবই ঢিলা মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। মাত্র ৫০।৬০ জন যাত্রী, তাতেই ঘন্টা লাগালো! ভিতরে ঘুরে দেখারো কিছু নেই, দোকানও মাত্র ৫/৭টা হবে। এয়ারপোর্টে সব রাজাদের ছবি একত্রে আছে। বর্তমান রাজা জিগমে খেসার নামগেল ওয়াংচুক একদম ইয়াং এবং বলতে নেই, যথেষ্টই হ্যান্ডসাম! আমার ভালোই পছন্দ হলো।
মূল বিল্ডিং।
একেবারে ডানে বর্তমান রাজা।
গাড়ী করে পারো থেকে থিম্পু যেতে বেশ সময় লাগে। রাস্তার এক পাশে পাহাড়, আরেক পাশে হয় খাদ, নয় খরস্রোতা পাহাড়ী নদী, আর সব পাহাড়ী দেশের মতই। তবে পাহাড়গুলোর সব সবুজ নয়, বাংলাদেশ বা নেপাল যেমন একেবারে সবুজে ঢাকা, ভূটানের অর্ধেক পাহাড়ই ধূসর। কিছু দেবদারু টাইপ গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেসব এ।কিছুক্ষন যাওয়ার পরই হঠাৎ দেখি সাদা সাদা বরফ পড়ে আছে আর রোদে একটু একটু করে গলছে। চিৎকার শুরু করলাম সবাই। নেমে বরফ গুলো হাতে নিয়ে শান্তি। গতরাতের বরফ এখনো পুরোপুরি গলে যায়নি। ভূটান আসা সার্থক!
পথ চলতি দৃশ্য।
ঐ দূরে বরফের পাহাড়।
বরফ!!!!
ভূটান: ল্যান্ড অব থান্ডার ড্রাগন (দ্বিতীয় পর্ব)