অারাফাতের মেজাজ কিঞ্চিৎ খারাপ। তরফদার সাহেব অনুমতি না নিয়ে তার সামনে বসে পড়েছে। স্টাফদের এমন অাচরন সে সহ্য করতে পারে না। কষে একট চড় লাগাতে তার ইচ্ছা করছে। চাকুরি বিধি অনুযায়ী চড় দেবার ক্ষমতা থাকলে এতক্ষণে সে নির্ঘাত একটা চড় বসিয়ে দিত। তা যেহেতু করার উপায় নেই তাই চড় থাপ্পড়ের বিষয়টা চেপে রেখে সে জিজ্ঞেস করল, কি খবর?
তরফদার সাহেব কিছু একটা বললেন। অারাফাতের কানে অবশ্য সে কথাগুলো ঢুকল না। তার চোখ টিভির দিকে। তরফদার সাহেবের চাকুরি সামনের সপ্তাহে শেষ। চাকুরি শেষের দিকে এসে সবাই অযথা বকবক করে। তরফদার সাহেবও গত ক'দিন ধরে অযথা বকবক করছেন। তরফদার সাহেবকে সে কোন কারন ছাড়াই সহ্য করতে পারে না। তবে অার কয়েকটা দিন তাকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হবে। লোকটা টানা ছত্রিশ বছর এ অফিসে চাকুরি করেছে। চাকুরি শেষ হওয়ার ঠিক অাগে তার সাথে খারাপ ব্যবহার সে করতে চায় না। বয়সে সে তরফদারের ছেলের বয়সী হলেও অারাফাতই অফিসের বস। অার বস মানেই অভিভাবক। অভিভাবকের অাচরন হবে পিতৃসম।
তরফদার সাহেব বকবক করছেন। অারাফাত শুনছে না। তার মনে কি জানি একটা চিন্তা চলছে। তবে কথার পিঠে কথা না বলাটা ভাল দেখায় না। কথার কথা হিসেবে অারাফাত জিজ্ঞেস করল, অবসরে কি করে সময় কাটাবেন?
তরফদার সাহেব খানিকটা গদগদে গলায় বললেন, ছাদ বাগান করব স্যার। ফ্রেশ শাক সবজি যেমন পাওয়া যাবে তেমনি শরীরটাও নড়াচড়া হবে।
অারাফাত এ উত্তরটা অাশা করেনি। তবে কথা বাড়াল না। টিভিতে এক ভদ্রলোক খুব মন দিয়ে বেহালা বাজাচ্ছে। চট করে অারাফাতের বেহালার নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বহু বছর ধরে তার ইচ্ছে বেহালা শেখার। অালসেমী করে শেখা হয়নি। অারেকটা কারনও অাছে। সে অন্য এক উপন্যাস। এখানে অপ্রাসঙ্গিক। অপ্রাসঙ্গিক কারনটার জন্য অারাফাত অাচমকা অন্য রকম হয়ে গেল। তরফদার সাহেব তার স্যারের পরিবর্তনটা ধরতে পারলেন। তিনি উঠে যেতে শুরু করলেন। তবে উঠার অাগেই অারাফাতের কথায় থামতে হল। অারাফাত তাকে জিজ্ঞেস করল, অাচ্ছা তরফদার সাহেব চাকুরি তো শেষ করলেন। জীবনটাও তো শেষ করলেন। জীবনের শুরুর স্বপ্নটার কতটুকু পূরন করতে পারলেন?
তরফদার সাহেব চুপ করে থাকল। কি বলবেন তা খুঁজে পাচ্ছেন না। তার এই স্যারটা অন্য রকম। মাঝে মাঝে এমন কথা বলে বসে যার কোন উত্তর তাদের কাছে থাকে না। অারাফাত অাবার জিজ্ঞেস করল, স্বপ্নটা কি ছিল অাপনার তরফদার সাহেব?
তরফদার সাহেব এবারও উত্তর দিলেন না। তার স্বপ্নটা কি ছিল তা তার মনে পড়ছে না। অাবছাভাবে মনে অাসছে তার একটা টিয়া পাখির শখ ছিল। কখনও পাখিটা পোষা হয়নি। রেলের ইঞ্জিনের ভেতরটা দেখার শখ ছিল এক সময়। ওটাও দেখা হয়নি। অারও বড় বড় কিছু স্বপ্ন হয়ত ছিল। কিন্তু তিনি বহু কষ্ট করে অার একটা স্বপ্নের কথাও মনে করতে পারলেন না। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।
অারাফাত এবার অার তাকে থামাল না। সে বেহালার সুরে ডুবে গেছে। তরফদার সাহেবের বড্ড মায়া হল মানুষটার জন্য। মায়া বড় খারাপ জিনিষ। তরফদার সাহেব হুট করে বলে বসলেন, জীবনের শুরুতে কি স্বপ্ন দেখে ছিলাম তা বহু কষ্ট করেও মনে করতে পারলাম না স্যার। ভুলে গেছি। চাকুরি করেছি। পেট ভরিয়েছি। ছেলে-মেয়ে মানুষ করেছি। এ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে স্বপ্নগুলো যে কখন মরে গেছে তা টের পাইনি। ভেতরটা বহু অাগেই মরে গেছে স্যার। এখন অপেক্ষায় অাছি কবে শরীরটা মরবে।
কথাগুলো বলে তরফদার সাহেব বেরিয়ে গেলেন। টিভিতে বেহালায় পরিচিত সুর। অারাফাতের ভেতর থেকে কে জানি সুরের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে মৃদু স্বরে বলতে শুরু করল -
সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।।
অারাফাত অাপনমনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চোখ দুটো মুছতে শুরু করল। তরফদার সাহেবের স্বীকারোক্তির শুনে কান্না করা অারাফাতকে মানায় না।