আজ ২৩ এপ্রিল, বিশ্ব বই দিবস। অনেকেই একে বলেন ‘বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থস্বত্ব দিবস’। ইউনেসকোর উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে দিনটি পালিত হয়ে আসছে বই, লেখক এবং কপিরাইট রক্ষার বার্তা নিয়ে। কিন্তু এই দিবসটিকে ঘিরে আজ আমাদের জন্য রয়েছে এক বিব্রতকর প্রশ্ন—আমরা কী বই পড়ছি ? না আমাদের পাঠাভ্যাস শুধুই উৎসবমুখর বাণীতে সীমাবদ্ধ ? ইউনেসকোর বেছে নেওয়া দিনটি যতটা সম্মানের, ততটাই কঠিন আত্মসমালোচনার। কারণ, যে জাতি বই পড়ে না, সে শুধু পিছিয়ে পড়ে না—সে নেতৃত্বের আসন থেকেও হারিয়ে যায়।
২০২৪ সালে সিইওওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন বিশ্বের ১০২টি দেশে বই পড়া নিয়ে এক জরিপ চালায়। জরিপের ফলাফল চমকপ্রদ—বছরে গড়ে ১৭টি বই পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা, সময় দেন ৩৫৭ ঘণ্টা। ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়, ১৬টি বই, সময় ৩৫২ ঘণ্টা। এরপর ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস। এই দেশগুলো অর্থনীতিতে শক্তিশালী, উদ্ভাবনে অগ্রগামী, প্রযুক্তিতে নেতৃত্বশীল—এবং জ্ঞানে বিনিয়োগে তারা একটুও পিছিয়ে নেই। তারা জানে, নেতৃত্বে টিকে থাকতে হলে পাঠাভ্যাস ও চিন্তাশীলতার চর্চা ছাড়া উপায় নেই।
এই তালিকার ঠিক ৯৭তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। এক বাংলাদেশি নাগরিক বছরে গড়ে বই পড়ে মাত্র ২.৭৫টি, সময় দেন ৬২ ঘণ্টা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পরেই আছে আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মতো দেশ। তাদের নাগরিকেরা বছরে গড়ে ২.৬–২.৭টি বই পড়ে, সময় দেন গড়ে ৬০ ঘণ্টা। অথচ আরব আমিরাত কিংবা সৌদি আরব অর্থনৈতিকভাবে ধনী রাষ্ট্র। বিলাসবহুল জীবন, উচ্চ দালান, প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রযুক্তির ঝলক—সবকিছু থাকলেও, তারা বিশ্ব নেতৃত্বে নেই। কারণ, ধন থাকলেই নেতৃত্ব আসে না। নেতৃত্ব আসে চিন্তা, প্রজ্ঞা, এবং জ্ঞানচর্চা থেকে—যার প্রধান উৎস বই।
বাংলাদেশ ও এই ধনী দেশগুলোর মাঝে রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ মিল: এখানে বই পড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরের এক অলস অভ্যাস, যেন অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা। শিশুদের শৈশব কাটে কোচিং আর পরীক্ষার চাপে, বড়রা মোবাইল স্ক্রিনে আটকে থাকে, আর নীতিনির্ধারকেরা পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার পরিবর্তে মুখে সংস্কৃতির বুলি আওড়ান। ফলে প্রজন্ম তৈরি হয় মুখস্থবিদ্যায় দক্ষ, কিন্তু বিশ্লেষণে দুর্বল; প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী, কিন্তু মৌলিক উদ্ভাবনে শূন্য।
অন্যদিকে, আমেরিকা, ভারত বা ইউরোপীয় দেশগুলো শুধু অর্থে নয়, জ্ঞানচর্চা ও বইয়ের ভেতর দিয়েই নিজেদের নাগরিকদের প্রস্তুত করছে। একজন পাঠক সেখানে শুধু সাহিত্যই পড়ে না, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় নিজেকে আলোকিত করে তোলে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও সেখানে বই পড়া এক সামাজিক সংস্কৃতি—যা নেতৃত্ব, উন্নয়ন এবং মানবিক মূল্যবোধ গঠনের ভিত।
বিশ্ব বই দিবস শুধুই বইয়ের প্রেমে মাতোয়ারা হওয়ার দিন নয়—এটি আত্মসমালোচনার একটি সুযোগ। আমরা কীভাবে বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছি, এবং সেই দূরত্ব আমাদের কীভাবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে দিচ্ছে—তা ভাবার দিন। বই থেকে দূরে সরে গিয়ে জাতি কখনো নেতৃত্বে থাকতে পারে না। ভবিষ্যৎ গড়তে হলে এখনই সময়, আবার বইয়ের পাতায় ফিরে যাওয়ার। আজই শুরু হোক নতুন একটি অধ্যায়। হাতে তুলে নিন একটি বই। কারণ, ইতিহাস বলে—বই পড়ে যে জাতি, সেই জাতিই ইতিহাস রচনা করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৭