শাহ আলম পেছন ফিরে তাকায়। চারদিক নিরব। কোথাও কেউ নাই। কেবল একটা কবুতর আছে আকাশে। শাহ আলমকে সহজে ঠান্ডা কাবু করতে পারে না। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। কেউ দেখার আগেই তাকে জায়গাটা থেকে সরে পড়তে হবে ।
ঘটনা ঘটার পর থেকে ভীষন শীত করছে তার। হাঁটু দুটোতে কোন জোর পাচ্ছে না সে। সে জানে ব্যাপারটা মানসিক। কোন রকমে শরীরটা টেনে বাসায় ফিরতে পারলে সোজা কম্বলের নিচে ঢুকে পড়বে। জায়গাটা ভাল না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আরও দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করে সে। রেল লাইনের ছড়ানো পাথরগুলোর উপর দিয়ে হাঁটা খুব একটা সহজ কাজ না। আবার পেছন ফিরে তাকায় শাহ আলম। কোথাও কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না তার। কবুতরটা আছে আগের জায়গাতেই।
জায়গাটার নাম জোড় দিঘী। দুটো যমজ দিঘী পাশাপাশি থাকায় এ নাম। দিঘীর এক পাশটায় বিদ্যুৎ বিভাগের অফিস। অফিসটার পাশ দিয়েই চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন। বেশ ব্যস্ত। কিছুক্ষন পরপরই রেলগাড়ির হুইসেল শোনা যায়। দিঘীর অন্য দু’পাশের জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যের পর অফিস ঘেঁষে চলে যাওয়া রেললাইনের উপর গাঁজার আসর বসে। আজ এখনও ব্যাপারটা শুরু হয় নাই। আঁধারটা আরেকটু জমে আসলে মানুষের আনাগোনা শুরু হবে। গতকালের কলকেগুলোর দু’তিনটে ছড়ানো রয়েছে লাইনের পাশেই। দিঘীর অপর দ’ুপাশের জঙ্গলে মানুষের আনাগোনা কম। জঙ্গলটায় অসামাজিক কাজ-কর্মের আলামত স্পষ্ট । শাহ আলমের আগমনের কারন ছিল শেষটা।
রেললাইন ধরে এগিয়ে চলে শাহ আলম। তার শরীরে এক ধরনের কাঁপুনি উঠছে। অফিস ভবনটার আড়ালে দিঘীটা হারিয়ে যাবার আগে শেষবারের মত ওদিকটায় নজর দেয় শাহ আলম। সবকিছু আগের মত। এমনকি কবুতরটাও। কবুতরটার রং কি ছিল? সাদা। নিশ্চয়ই সাদা। আবার ধূসরও হতে পারে । কবুতরটা কি তখনও ছিল? শাহ আলম মনে করতে পারে না।
সে তখন ব্যস্ত ছিল রুনুকে নিয়ে। রুনুর বড় বড় চোখ দুটো তখন আরও বড়। শাহ আলম নিশ্চিত কোন সাক্ষী নাই। রুনু প্রাণপ্রন চেষ্টা করেছে বাঁধা দিতে। ছোট-খাট রুনুর দৈহিক শক্তিতে শাহআলমের কাছে পরাজিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেবল বলে, আল্লাহ তোমার বিচার করবে।
তা তো নিশ্চয় করবে, ভাবে শাহ আলম কিন্তু গলা ছাড়ে না। ধীরে ধীরে শাহ আলমের আঙ্গুলের চাপ বাড়তে থাকে। রুনুর বুকটা খালি হয়। এক সময় হাত-পা খিঁচিয়ে স্থির হয়ে যায় সে। সেই সাথে হাঁফ ছাড়ে শাহ আলম। আপদ দুটো বিদেয় হল। শাহ আলমের স্ত্রী আছে। সন্তান আছে। সামাজিক পরিচয় আছে। এ সবকিছু ক্ষনিকের মোহের ভুলে নষ্ট করতে পারে না সে। রেললাইন পেরিয়ে ফুট ওভারব্রিজের সিঁড়িতে পা রাখে সে।
খুন ব্যাপারটা ঘটনার আগে এবং পরে অসম্ভব একটা কাজ। খুন করার সময় ব্যাপারটার গভীরতা টের পাওয়া যায় না। উল্টো এক ধরনের উল্লাসের ছোঁয়া যেন পেয়েছিল সে। চারপাশের মানুষের কোলাহলে শাহ আলম এখন বিশ্বাস করতে পারছে না সে খুন করেছে। সত্যিই কি রুনু মারা গেছে? পুরো ব্যাপারটাই তার কল্পনা না তো? ফুট ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শাহ আলমের ইচ্ছে করছিল ফিরে গিয়ে ওখানে রুনুর লাশটা সত্যিই আছে কিনা তা খুঁজে দেখতে।
ওভারব্রিজের উপর থেকে দু’টাকার বাদাম কেনে সে। মানুষের কোলাহলে ঠান্ডাটা এক লাফে কমে যায় অনেকখানি। খোসা ভেঙ্গে বাদাম দানা মুখে দেয় ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়ানো শাহ আলম। রেল লাইনের সিগন্যালের লাল আলোগুলোর তাকিয়ে আনমনে নিজেকে বিচার করতে চায় সে। নিজের ভেতর কোন আতংক খুঁজে পায় না সে। পায় না কোন গ্লানি। কেন পায় না তা ভেবে অবাক হয় সে। খুন ব্যাপারটা গল্প-উপন্যাসে যেমন জেনেছে তাতে তো খুনের পর তার ভেতরে তীব্র মানসিক যন্ত্রনা হবার কথা। কিন্তু তার হচ্ছে না। তাহলে কি তার ভেতর একজন পেশাদার খুনী লুকিয়ে ছিল এত বছর? নাকি সে পুরোপুরোই একজন বিবেকহীন মানুষ। অবশ্য লেখকরা যেমন খুন পরবর্তী অভিজ্ঞতার কথা বলেন তার সবটুকু মিথ্যা হওয়ারই কথা। ওরা তো খুন করে অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা লেখে না। কোন খুনীর সাথে পরিচয় থাকলে বেশ হত। ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করা যেত।
কবুতরটা উড়ে এসে ব্রিজের রেলিং এ বসে। বাদামগুলো শেষ করতে করতে একটু পরপর কবুতরটা দিকে নজর দিতে থাকে সে। কবুতরটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই কবুতরটাই কি ওখানে ছিল তখন ? শাহ আলম দ্রুত পা চালায়। একটু এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে তাকায় সে। কবুতরটা বসে আছে রেলিং এ। নজর তার দিকে।
বাসায় এসে ফিরে স্বাভাবিকভাবে হাত-মুখ ধুয়ে নেয় সে। ছেলে পড়ছে। বৌ রোজকার মত হাঁটতে নেমেছে। অন্যদিনের সাথে আজকের দিনটার কোন পার্থক্য পায় না শাহ আলম। গতকালের মতই সন্ধ্যার নাস্তা রাখা আছে টেবিলের উপর। আজ ছোলা-মুড়ি। গতকাল ছিল নুডলস। সরিষার তেল দিয়ে ছোলা মুড়ি মাখিয়ে কম্বল জড়িয়ে টিভি খুলে বসে শাহ আলম।
কোথাও কোন স্বাক্ষী নাই। জঙ্গলের অত ভেতরে অসামাজিক মানুষজনের আনাগোনা হয় না। লাশটা পঁচে গন্ধ না ছড়ালে টের পাওয়া যাবে না। রুনু এক সময় তাদের ফ্যাক্টরীতে চাকুরি করত। পেটে বাচ্চাটা আসার পর ওকে অন্য ইউনিটে বেশী বেতনে পাঠিয়ে দিয়েছিল শাহ আলম। ওদের মেলামেশার কথাটা কেবল জানত ওরা দু’জনই। কাজেই অফিসের দিকে থেকে সে নিরাপদ।
শাহ আলম সংবাদ দেখে। টক -শোর বক্তা পছন্দ না হলে একের পর এক চ্যানেল পাল্টায়। বউ সিরিয়াল দেখে। ছেলের পড়ালেখা নিয়ে কথা বলে। রাতের খাবার এক সাথে খেতে বসে। কবুতরের মাংস রান্না হয়েছে। আজ শাহ আলম কবুতরের মাংস খেতে পারে না। তার গা গুলিয়ে উঠে। এটা ঐ কবুতরটা না তো? শাহ আলমকে চেয়ার ছাড়তে দেখে বউ অবাক হয়। কি হল?
কিছু না। গ্যাস জমেছে। এন্টাসিড প্লাস খেতে হবে।
ওষুধ পরে খেও। তোমাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যই তো রাঁধলাম। একটু খেয়ে নেও।
শাহ আলম কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ে। শুধু শুধু বউকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া ঠিক না। সুযোগ দিলে পুরো সপ্তাহ কবুতর নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করবে।
শাহ আলম কবুতর খায় এবং খাবার শেষে বমি করে কবুতরটাকে পেট থেকে বের করে দেয়। বউ মনে মনে লজ্জিত। ওকে জোর করাটা ঠিক হয়নি। গরম দুধ খেয়ে ঘুমাতে যায় শাহ আলম। অন্যদিন সে মড়ার মত ঘুমাতে পারে। আজ পারল না। আধো ঘুম আর আধো জাগরনে সময়টা কাটে তার। একটু পর পর কবুতরের বাক-বাকুম শুনতে পায় সে। ঘুমের ঘোরেই মেজাজ খারাপ হয় তার। নাহ এটার একটা বিহীত করতে হবে। ঘুম থেকে উঠে বসে শাহ আলম।
বিভৎস ঘটনা। কে বা কি জিনিষ গতরাতের বাড়িওয়ালার ছাদের সবগুলো কবুতরকে মেরে রেখেছে। ছাদের দরজা খোলা। তালাটা কোথাও পাওয়া গেল না। শাহ আলম সবার সাথে ছাদ ঘুরে আসে। পুলিশ এসেছে। ব্যাপারটার কুল কিনারা এখনই করা সম্ভব না। সন্ধ্যার দিকে দারোগা সাহেব আবার আসবেন। এখন যে যার কাজে যেতে পারে। শাহ আলম গোসল শেষে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ে। ফ্যাক্টরীর সব কিছু স্বাভাবিক। কেবল কবুতরটা শাহ আলমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
সারাটা সকাল কবুতরটার কথা ভুলে থাকে সে। কবুতরের দিকে তার নজর যায় দুপুরের লাঞ্চ টাইমে। হাত মোছার পর টিস্যুটা বাস্কেটে ফেলতে গিয়ে তার খেয়াল হয় জানালার পাশে একটা কবুতর। রং সাদা। কাজে মন বসে না তার। শরীফকে তার টেবিলটা দেখতে বলে বেরিয়ে পড়ে শাহ আলম। আজ আর মন বসবে না তার। বাইরে বেরিয়ে কবুতরের খোঁজে এদিক-সেদিক তাকায় সে। কোথাও কিছু নাই।
রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ছে। পাঁচটা হতে হতে ভিড়টা জমে যাবে। শাহ আলম বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে যাত্রী সংখ্যা নেহাতই কম না। একটা বাস আসলে বাচ্চা-বুড়ো সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। শাহ আলমকে নিত্যদিন এ হুড়োহুড়ির ঝামেলা সইতে হয় না। অফিসের বাস আছে। নিশ্চিন্তে, নিরাপদে এসির হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া আসে করে সে। আজকে যেতে তার কষ্ট হবে। এসব ভাবনা-চিন্তার ফাঁকেই পাশের মহিলার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটা আঙ্গুল উপরে তুলে বলতে শুরু করে, মা, মা। কবুতর।
শাহ আলম মাথাটা পেছনে হেলিয়ে উপরে তাকায়। কবুতরটার তার মাথার হাত দশেক উপরে ডানা ঝাপটাচ্ছে। ব্যস্ত রাজপথে এমন দৃশ্য বিরল। চোখ কুঁচকে ভাল করে দেখার জন্য চার-পাঁচ কদম এগিয়ে যায় সে। এটা কি সেই কবুতরটা?
রশীদের চোখেও কবুতরটা পড়েছিল। নজরটা ওদিকে চলে যাওয়াতেই বাস ছেড়ে পালাতে হচ্ছে তাকে। হেলপারটা যে কোনদিক দিয়ে ভেগেছে কে জানে। দৌড়াতে দৌড়াতে কবুতরটার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে রশীদ। কবুতরটা না থাকলে তার নজর ওইদিকে যায় না আর মানুষটার উপরও বাসটা এমনভাবে সে তুলে দেয় না।
জোড় দিঘীর পাড়ে আজকাল দুটো সাদা কবুতরকে প্রায়ই বসে থাকতে দেখা যায় । মা কবুতরটা খুব একটা নড়তে চড়তে চায় না। বাচ্চাটা বড় দুষ্ট।