গত বছরের মতো এবছর আর কানাডার প্রধানমন্ত্রী ঈদের শুভেচ্ছা জানাননি। রোজার শুরুতেও “রামাদান করিম” শুভেচ্ছাবচনটি কেউ পাঠায়নি। আগে যখন ট্রুডো ঈদের ঠিক আগে আগে সরকারি দপ্তর থেকে কানাডার মুসলিম অভিবাসীদের উদ্দেশে শুভেচ্ছাবাণী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতেন, তখন ফেসবুকে সেটা দেখলেই আমার স্ত্রী আমাকে দেখাতে অধীর হয়ে যেতেন। “দেখ দেখ ট্রুডো ঈদের শুভেচ্ছা দিয়েছে।” খুব খুশি হয়ে ফোন এগিয়ে দিতে দিতে বলতেন তিনি। তখন আমি এই প্রচারগুলো লিবারেল দলের লোক দেখানো কৌশল হিসেবেই দেখতাম। কিন্তু আজ যখন বার্তাগুলো একেবারেই হারিয়ে গেল, তখন বুঝলাম, সেই লোক দেখানো শুভেচ্ছাবাণীরও একটা মূল্য আছে, তাৎপর্য আছে।
এ বছরের শুরুতে জনসাধারণের বিরাগভাজন হয়ে ট্রুডো দলীয় প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করেন। এ মাসের শেষে কানাডায় ভোট হবে, এবং সম্ভাবনা হল "রক্ষণশীল" বিরোধী দল অনেক ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসবে। তাদের নেতা পিয়েরে পলিয়েভের সঙ্গে মুসলমানদের ঈদের শুভেচ্ছার বিষয়টি একেবারেই যায়না। তাই মনে হয়, এখন থেকে কানাডার মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর প্রথা একপ্রকার উঠে গেল।
যতটুকু মনে পড়ে, আমেরিকায় ওবামার প্রেসিডেন্সির সময় মুসলিম সমাজকে ওবামা ঈদের শুভেচ্ছা জানাতেন। কিন্তু ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকে সে প্রথায় ছেদ পড়ে। এই মেয়াদে সেটা শুধু বেমানান তা নয়, বরং অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে “ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও”। পরিস্থিতি এখন এত খারাপ যে ঈদের শুভেচ্ছা দূরের কথা, হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে না দিলেই হয়। আর যদি বেরই করে দেয়, তবু যেন অন্তত দুহাজার পাউন্ডের বোমাগুলো আমাদের সন্তানদের গায়ে না পড়ে।
প্রতিবেশী দেশে যখন ভয়ঙ্কর অশুভের খেলা শুরু হয়েছে, তখন প্রশ্ন থেকে যায়, কানাডা কতদিন তার অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়ে এই অশুভের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে?
ট্রুডোর দুই টার্মে তার মন্ত্রিসভায় ৩৭ জনের মধ্যে প্রায় ১৫-১৬ জনই ছিলেন সংখ্যালঘু অভিবাসী। পাঞ্জাবি-তামিল ভারতীয় যেমন ছিলেন, তেমনি গুজরাটি-আফগানি-সোমালিয়ান মুসলিম, ফিলিপিনো, চীনা বা চিলিয়ান সদস্যরাও ছিলেন। এই বৈচিত্র্যই ছিল ট্রুডো সরকারের শক্তি।
কয়েক বছর আগে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ভারতে মোদী সরকারের হিন্দুত্ববাদী নীতি নিয়ে বলেছিলেন, “আজ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও নেতৃত্বে যারা আছেন, সকলেই হিন্দু। কিন্তু আপনি যদি মাত্র বারো বছর আগে, ২০০৭ সালের কথা ভাবেন, দেখবেন রাষ্ট্রপতি ছিলেন মুসলমান, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শিখ এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান ছিলেন একজন খ্রিষ্টান।”
একটি গণতান্ত্রিক দেশে ঈদের শুভেচ্ছা এবং মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। বিশ্ব পরিস্থিতির এই প্রতিফলন বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা অভিবাসী নয় এবং তারা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং তাদের জীবনধারা আমাদের সংস্কৃতির গভীরে গাঁথা। তবু যদি এমন কোন ব্যক্তি বা দল ক্ষমতায় আসে যারা সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানানোর মতো সৌজন্যবোধ দেখানোর যোগ্যতা না রাখে বা সেই কাজে মানানসই না হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমরা একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে নেমে পড়েছি। তখন বলতে হবে, আমাদের দেশেও সেই ভয়ঙ্কর অশুভের খেলা শুরু হয়ে গেছে।
(ছবিটি প্রথম আলোর "ঈদ আনন্দমিছিল" থেকে সংগৃহীত)