আজকে ব্ল্যাক হোল নামের যে বস্তুটির সাথে আমরা পরিচিত সেটি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রেরই একটি অবদান।মহকর্ষ নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে নিউটনের পরবর্তী সময়ের অনেক বিজ্ঞানীর মাথায়ই এই প্রশ্ন আসে যে এই আকর্ষন বল উপেক্ষা করা যায় কিভাবে?নিউটনের সূত্রের সাহায্যে দেখা যায় পৃথিবী তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরে এবং সূর্যের আকর্ষনে কেন সূর্যের দিকে সরে যায় না।কারন হল পৃথিবী সুর্যের কাছ থেকে সেই বেগে ছুটে যাচ্ছে যা ঠিক সূর্যের আকর্ষন বলের সমান।ফলে দুটি বল পরস্পরকে ব্যালেন্স বা সমতা সাধন করছে।কিছু বিজ্ঞানী (ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো টাইপ) চিন্তা করল যদি কোন আকাম কইরা পৃথিবীর স্পিড বাড়িয়ে দেয়া যায় তাইলে কি হইব?যুক্তি দিয়া চিন্তা করলে তখন পৃথিবী সুর্যের আকর্ষন ছিন্ন করবে...অর্থাৎ আকর্ষন থেকে মুক্তি পাবে...
যেই বেগে কোন বস্তু চললে তা অন্য একটা বস্তুর মহাকর্ষ বল থেকে মুক্ত হতে পারে তাকেই বলা হয় মুক্তি বেগ...উদাহরন্স্বরুপ বলা যায় পৃথিবীর মুক্তি বেগ ১১.২ কিমি/সেকেন্ড(প্রায়)।যার মানে হল রকেট বা কোন মহাকাশ যানকে পৃথিবীর আকর্ষন মুক্ত হয়ে মহাশুন্যে যেতে হলে কমপক্ষে এই গতিতে ছুটতে হবে।অন্যদিকে এই বেগের কোন রকেট বৃহস্পতির আকর্ষন থেকে কখনোই মুক্ত হতে পারবে না কারন বৃহস্পতির ভর পৃথিবী থেকে বেশী ফলে মহাকর্ষ বলও।অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীর(গ্রহের) জন্য মুক্তি বেগ ভিন্ন হবে।বিখ্যাত কল্পবৈজ্ঞানিক উপন্যাস লেখক আইজ্যাক আজিমভ বলেন,
“পৃথিবী থেকে কম ভরের গ্রহের পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ কম আর বেশী ভরের গ্রহে বেশী...কাজেই সৌরজগতে বৃহস্পতির পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক...প্রকৃতপক্ষে তা পৃথিবীর ৫.৪ গুন...”
গ্যাস এবং পাথুরে কণার ধ্বংসাবশেষ যা একটি ডিস্ক তৈরী করে ধীরে ধীরে ব্ল্যাক হোলে হারিয়ে যাচ্ছে
অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিছু বিজ্ঞানী অধিক ভরের বস্তু যাদের মুক্তিবেগ আরো অনেক বেশি এমন বস্তু নিয়ে চিন্তা করা শুরু করেন।এই বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন হলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন মিচেল(সিসমোলজির বা ভূমিকম্পবিদ্যার জনক,বাইনারি স্টার ধারনার প্রবর্তক),যিনি নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন।এটা তখনই পরিষ্কার হয় যে মহাবিশ্বে সূর্যের থেকেও ভারী নক্ষত্র আছে।নক্ষত্রের ভরের কোন উচ্চসীমা আছে কিনা তা মিচেল জানতেন না।কিন্তু তিনি প্রস্তাব করলেন যে,তাত্ত্বিকভাবে বিশাল ভরের নক্ষত্র থাকতে পারে যার মহাকর্ষ বল অত্যন্ত তীব্র।তাছাড়া এই সব দানব নক্ষত্রের মুক্তিবেগও অনেক বেশী হবে।মিচেল চিন্তা করলেন একটি নক্ষত্রের মুক্তি বেগ তাহলে সর্বোচ্চ কত হতে পারে??এই যুক্তির সাহায্যে তিনি চিন্তা করলেন যে যদি কোন নক্ষত্রের মুক্তি বেগ ১৮৬০০০ মাইল/সেকেন্ড এর থেকে বেশী হয় তাহলে কি হবে?এই যুক্তির সাহায্যে তিনি বললেন যে, আলোও এই সব নক্ষত্র থেকে বের হতে পারবে না।১৭৮৪ সালে প্রকাশিত একটি পেপারে তিনি বললেন, “যদি মহাবিশ্বে এমন কোন বস্তু থেকে থাকে যার ব্যাসার্ধ আমাদের সূর্য থেকে ৫০০ গুন বেশি,তাদের প্রবল শক্তিশালী মহাকর্ষ বল থাকবে এবং এই বস্তুর মুক্তিবেগও অনেক বেশী হবে।ফলে এইসব বস্তু থেকে বের হওয়া আলোকরশ্মি এদের মহাকর্ষের টানে ওই বস্তুতেই ফিরে আসবে।আর যেহেতু আলো এই বস্তু থেকে বের হতে পারবে না কাজেই আমরা দৃষ্টিশক্তির সাহায্যে এ ধরনের বস্তুর কোন তথ্য পাব না।অন্যভাবে বলতে গেলে, এই নক্ষত্রগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে...ফলে আমরা চোখ বা টেলিস্কোপের সাহায্যে তাদের দেখতে পাব না।কাজেই মিচেল এই বস্তুগুলোর নাম দেন ‘ডার্ক স্টার’। ”
প্রকৃতপক্ষে তার সময়ে মিচেলই একমাত্র বিজ্ঞানী নন যিনি তীব্র মহাকর্ষ বলের প্রভাব নিয়ে প্রবল্ভাবে আকর্ষিত হয়েছিলেন।১৭৯৫ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে সাইমন ল্যাপলাসও স্বতন্ত্রভাবে একই উপসংহারে আসেন।তিনি লিখেন, “মহাবিশ্বে কোথাও না কোথাও নক্ষত্রের সংখ্যার মত বিশাল সংখ্যায় এমন বস্তু(নক্ষত্রের ন্যায়) থাকতে পারে যার ঘনত্ব হয়তো আমাদের পৃথিবীর ঘনত্বের মতই কিন্তু ব্যাস আমাদের সূর্যের প্রায় আড়াইশ গুন বেশি।এইসব বস্তু তাদের প্রবল আকর্ষন(মহাকর্ষ) বলের কারনে তাদের মধ্য থেকে কোন রশ্মিকেই(আলোক) বের হতে দেয় না।এই কারণেই হয়তবা মহাবিশ্বের সবচাইতে উজ্জ্বলতম এই বস্তুটি আমাদের অদেখাই রয়ে গেছে।”
এই উপসংহারের উপর ভিত্তি করে ল্যাপলাস এই বস্তুগুলোর নাম দেন ‘লেস কর্পস অবসকিউরস’ বা ‘অদৃশ্য বস্তু’
মজার বিষয় হল মিচেল এবং ল্যাপলাস যখন ব্ল্যাক হোল ধারনার প্রবর্তন করেন তখন হাইগেনস এর আলোর তরঙ্গতত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত।পরবর্তীকালে অবশ্য প্রমানিত হয়েছে আলো আসলে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ।আমরা জানি কন বস্তু যার ভর আছে কেবল্মাত্র তাই মহাকর্ষ বল দ্বারা আকৃষ্ট হবে...আমরা এটাও জানি যে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গের(যেমন দৃশ্যমান আলো) কোন ভর নাই।তাহলে কিভাবে আলো মহাকর্ষের দ্বারা আকৃষ্ট হয়।জানতে পড়ুন পরবর্তী পর্ব যাতে থাকছে...
“বেন্ডেবল স্পেস এন্ড গ্রাভিটি ওয়েল”
আগের পর্বগুলোর লিংকঃ
ব্ল্যাক হোল-৩(ব্ল্যাক হোলের প্রাথমিক ধারণাসমূহ)
ব্ল্যাক হোল-২(ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে জানা প্রয়োজন কেন?-এস্ট্রোফিজিক্স
ব্ল্যাক হোল-১( অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-অসম্ভব অজানার মুখোমুখি)