“তুই একটা অপদার্থ”। আমি নিশ্চিত, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিবার এই কথা শুনেছি আমি। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিবার এই কথা বলেছেন আমার বাবা। পদার্থ বিজ্ঞান পড়েছি ক্লাস নাইনে উঠে। কিন্তু অপদার্থের সংজ্ঞা জেনে গেছি তার অনেক আগেই। আমার বাবা আমাকে শুধু অপদার্থ বলেই ক্ষান্ত হননি। আমি যাতে ঠিক মত অপদার্থ হয়ে বেড়ে উঠি তার উপযূক্ত ব্যবস্থাও করেছেন! যদিও তার ধারণা ছিল আসলে সে আমাকে মানুষ বানাচ্ছে!!
বাসায় নতুন কোন গৃহশিক্ষক নিয়োগ করার সময় বাবা একটা কথা সব সময়ই বলে, ‘স্যার, এই ছেলের খালি হাড্ডি গুড্ডি আমার, ছাল চামড়া মাংস সব আপনার!’ মফস্বল এলাকার স্যাররাও ছাল চামড়া আলাদা করার ওস্তাদ। পরের দিনই সেসব কাজের ইন্সট্রুমেন্ট, মানে বেত, নিয়ে হাজির। তার পর চলে ছাল চামড়া আলাদা করার ব্যপক কর্মকান্ড! রাতে বাবা বাড়ি এসে বলে, ‘দেখিতো, তোর পড়াশুনা কেমন হচ্ছে? এদিক আয়। জামা খোল!’ তখন জামা খুলে আমার গায়ের বিভিন্ন যায়গায় ‘পড়াশুনার’ চিহ্ন দেখাতে হয়। বাবা সন্তুষ্ট চিত্তে মার দিকে ফিরে বলে, ‘বুঝলে এইটা জাদরেল টিচার!’
মাঝে মাঝে গা দেখে বোঝা যায় যে, ‘পড়াশুনা’ আজ তেমন হয়নি। তখন আমাকে নিয়ে বসে ট্রানস্লেশন সেখাতে। তখন ‘ডাক্তার আসার আগে’ এমনকি ‘রোগী মরারও অনেক আগেই’ আমার ‘পড়াশুনা’ হয়ে যায়। এর পর বাবা বসে জেনেটিক্স নিয়ে। আমার মামারা কেন সব গাধা গরু। এবং কি ভাবে সেই জিন আমার মায়ের মাধ্যমে তার ছেলের জিন কে মডিফাই করে গাধাগরু বানিয়ে ফেলেছে, সেইসব এর বিশদ বর্ণনা!
এভাবে প্রতিটা দিন শেষ হয়। পরদিন সকালে যখন আমাদের মাস চুক্তির রিক্সাওয়ালা বাসার সামনে টুন টুন বেল বাজায়। স্কুলে নিয়ে যাবার জন্য। দেখা যায় আমি তখনো আমার জুতার ফিতা নিয়ে কসরত করছি। বাবা আবার ‘তুই একটা অপদার্থ’ বলে এসে আমার জুতার ফিতা বেধে দেয়। আর সাথে দেয় ফিতা বাধার ইন্সট্রাকশন। ঘটনাটা প্রায় প্রতিদিনই ঘটতে থাকে। তার পর কোন একদিন হুঠ করে ফিতা বাধা শিখে ফেলি আমি! অভ্যাস বসে আমার জুতার ফিতা বাধতে এসে ‘তুই একটা অপদার্থ’ বলার পর বাবা যখন দেখে ফিতা বেধে ফেলেছি তখন বাবা যেন একটু থমকেই যায়। হয়তো তার অপদার্থ ছেলেটা বড় হয়ে যাচ্ছে দেখেই! ততদিনে সকালে আমার জুতার ফিতে বেধে দেওয়া টা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। বাবা বলে, ‘এহ হে! এভাবে বাধে নাকি!’ তার পর সেই গিট খুলে আবার বেধে দেয়।
আসলেই বাবার বেধে দেওয়া গিটে যে ভালবাসা টুকু থাকে সেটা তো আর আমার গিটে থাকেনা। তাই সেই সুযোগটা আমিও দেই তাকে। তারপর আবারো বরাবরের মতই আরেকটা দিন। আবারো সেই ‘পড়াশুনা’ আরো দু-দশবার অপদার্থ পরিগনিত হওয়া...। এভাবেই দিন গুলো কাটে। আমি বড় হই। বড় হতেই থাকি। সকাল বেলায় এই ফিতে বেধে দেওয়ার ছোট্ট নাটিকাও টি অভিনিত হতেই প্রতিদিনই।
এভাবেই কাটে অনেক অনেক দিন। একসময় আমার এইচ, এস, সি, পরীক্ষা। সেই ফিতা বেধে দেওয়ার খেলাটা তখনো চলছে। সকালে বাবা যথারীতি আমার জুতার ফিতা বেধে দিচ্ছে। এসময় পাশের বাসার আঙ্কেল এসেছে পরীক্ষার্থি কে একটু অভয় টভয় জানাতে। এসে দেখে এই অবস্থা! সে চক্ষু ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছে। তার চোখে তখন বড় হরফে লেখা ‘কত্ত বড় অপদার্থ!’ তাকে দেখে আমি যারপরনাই লজ্জা পেয়ে গেছি। বাবা তখন জুতা থেকে চোখ উঠিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বুঝলেন ভাই। আমার ছেলেটা একটা অপদার্থ!’
তার পর আমি পরীক্ষা দিতে যাই। পদার্থবিজ্ঞান!