ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষায় একটা মন্ত্র পারলেই পাশ। সেটা হল উড়ার মন্ত্র। জ্বিনিদের স্কুলে এই ক্লাসে আজ পর্যন্ত কেউ ফেল করেনি। সেই দিক দিয়ে ভাবলে আমাদের এই গল্পের জ্বিনিটা একদম ইউনিক! কারন সে এই ক্লাসেই ফেল করে বসে আছে!!! একটা জ্বিন উড়তে পারেনা, এমনটা কি ভাবা যায়? যাকে বলে একেবারে ‘ওয়ান-অফ-এ-কাইন্ড’!! ফেল করার অবশ্য উপযুক্ত কারনও আছে। এমনিতেই এই জ্বিনিটা বোকা টাইপের। এসব জটিল তন্ত্র মন্ত্র তার মাথায় ঢুকেনা। তার উপর এসব পেরেই বা হবেটা কি। শেষ মেষ তো তাকে সেই একটা চেরাগের মধ্যে ভরে, বাজারজাত করে দেবে। মানুষের মত একটা পুচকে প্রানীর গোলামী করতে হবে তখন!!
তবে পড়াশুনা করলে লাভ যে নেই তা না। ভাল রেজান্ট করলে লাভ কিছুটা আছে। তাদের দাম হয় অনেক বেশি। অনেক বড় বড় বাদশা, আর সউদাগররা তাদের কেনে তখন! এদের কাজ করেও মজা!! সেই যে, তাদের স্কুলের সবচেয়ে সেরা ছাত্র যে, একে বারে রেকর্ড মারক্স পেয়ে ফার্স্ট স্টান্ড করা!!! তার মনিব ছিল শাহ্জাদী দুনিয়া। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী আর মায়াবতী রাজকন্যা সে! শাহ্জাদী দুনিয়াকে পালঙ্কে বসিয়ে যখন সে বাগদাদ শহরের উপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেত কোহেকাফের দিকে। সব লোকজন মুগ্ধ হয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতো তাদের!! আরো একজন বিখ্যাত ছাত্র আছে তাদের স্কুলের। তার যাদু শক্তি ছিল সবচেয়ে বেশি! তার মনিব ছিল আলাদিন। তাদের গল্প তো সবার মুখে মুখে!! এদের মত জ্বিনি হওয়া হচ্ছে জ্বিনি স্কুলের সবার জীবনের স্বপ্ন।
আমাদের বোকা জ্বিনিটা কি আর করবে! সে তো আর এদের মত ভাল ছাত্র না। তাই ঐ রকম মনিবও তার আর জুটবেনা। আর জুটলেই বা এমন কি? সেই গোলামীই তো করতে হবে তখন। তার চেয়ে এই ভাল! তার চেরাগটা কেউ নেয় না! চেরাগটা দেখতেও ভালনা বেশি একটা। সে খালি বসে বসে চেরাগের মধ্যে ঘুমায়। একবার এক গরীব কৃষক কিনেছিল সেটা! তখন খুব খারাপ কেটেছে সময়টুকু। সে তো কিছুই পারেনা! তাই কৃষক প্রদীপটাকে বাতি হিসেবেই ব্যবহার করত। কেরসিনের গন্ধ সহ্য হয়না বোকা জ্বিনির। তার উপর আগুন জ্বাললে চেরাগ গরম হয়ে যায়! এসময় সে বাইরে থেকে ঘুরে হাওয়া টাওয়া খেয়ে আসে। পরে চেরাগ ঠান্ডা হলে ফিরে এসে আবার ঘুম!
তার পর অনেক অনেক দিন কেটে গেছে। কেউ আর চেরাগটা বাতি হিসেবেও জ্বালায় না। সে একবার কৌতুহলি হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে। কেমন উচু উচু সব দালান!! দালানের গায়ে শত শত বাতি জ্বলছে! কিন্তু সে সবের কোনটাতেই কেরসিনের গন্ধ নেই!! এই গুলো মনে হয়ে কোন বড় জাদুকর বানিয়েছে। কি অবাক কান্ড!! ধ্যাত, তার চেরাগের একমাত্র ব্যবহারটাও গেল।
তার পর আবারো অনেক দিক কেটে গেছে। একদিন হঠাৎ কে যেন তার চেরাগটা জ্বেলে দিল! কেবলই জ্বিনিটা স্বপ্নে, তাদের ভার্সিটি থেকে পাশ করেছে। রীতিমত গোল্ড মেডেল পেয়ে! নিজুক্ত হয়েছে শাহজাদি দুনিয়ার খেদমতে। যেই তাকে পালঙ্কে বসিয়ে উড়তে যাবে! অমনি এই বিপত্তি!! মেজাজ কার ঠিক থাকে? যে এই কাজ করেছে আজকেই তার ঘাড় মটকাতে হবে!! কোন মাফ নাই। নো মাফ!
রাগে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে আসে বোকা জ্বিনি। বেরিয়ে দেখে বেশ অন্ধকার একটা ঘর। শুধু তার চেরাগ টাই জ্বলছে। ঘরটা কেমন যেন ভাঙ্গাচোরা। অবশ্য এমনই হবার কথা। তাকে কি আর ধনী কেউ কিনবে? প্রদীপের সামনেই বসে আছে ফুট ফুটে একটা পিচ্চিমেয়ে!! জ্বিনিটা রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “এই তুমি কি এই চেরাগ টা জ্বালিয়েছ?” মেয়েটা বলে, “হুমম। কিন্তু তুমি কে?”...“আমি হলাম এই চেরাগের জ্বিন!” মেয়েটা বলে, “ধুর বোকা! চেরাগে কি কখনো জ্বিন থাকে! ওসব তো গুল্প” আর তুমি এ বড় মানুষ চেরাগের মধ্যে থাক কি করে?” ...“আমি মানুষ না! আমি হলাম জ্বিন” জ্বিনির বোকামি দেখে মেয়েটা এবার হাসে। বলে,“তাইলে তুমি কি আলাদিনের সেই জ্বিন?” ...“ না আমি সে না। আমি হলাম অন্য জ্বিন।” মেয়েটা এবার অবাক হবার ভান করে। বলে,“ওমা! আরো জ্বিনি আছে নাকি!!”...“হুমম আছে। কিন্তু তুমি এই চেরাগ টা জ্বালিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে কেন? কি মজার একটা স্বপ্ন দেখছিলাম! সেই জাদুর বাতিটা জ্বালাতে পারতে তো। ঐ যে যেটাতে কেরসিনের গন্ধ নেই।” মেয়েতা বলে“ঐ টা জ্বালানো মানা! আব্বু বলেছে রাতে ঐটা জ্বালালে তারার ফুল পড়তে পারে ঘরে। তার উপর আজ বিকাল থেকে সেটা জ্বলছেও না।”...“তারার ফুল!! সে আবার কি?”...“তারার ফুল আমার খুব প্রিয় একটা জিনিশ! আরেকটু পরেই দেখতে পাবে।”
অনেক কথা হয় বাচ্চাটার সাথে। এক সময় মেয়েটা বলে,“আচ্ছা জ্বিনি, তুমি কি উড়তে পার? পারলে আমাকে একটা তারার ফুল এনে দিবা”। এই বার জ্বিনিটা লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা চুলকে বলে, “না মানে, ইয়ে উড়াটা শিখতে পারিনি। সেকারনেই তো ক্লাস ফাইভে ফেল করলাম!”...“ওমা! তুমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছ। আমি পড়ি ক্লাস ওয়ানে। তবে এখন স্কুল বন্ধ।”
এই মেয়েটা কে মনিব হিসেবে বেশ পছন্দই হয় বোকা জ্বিনির। শাহ্জাদী দুনিয়ার চেয়ে অনেক ভাল! কি সুন্দর! আর বুদ্ধিমতি। শাহ্জাদীদের মত হুকুম দিয়ে কথাও বলেনা। নাহ্! এর ঘাড় মটকানো যাবেনা। এর গোলামী করা যেতে পারে। মনে মনে খুশি হলেও একটু রাগী রাগী কন্ঠে সে বলে, “আমার চেরাগটা তুমি যখন জ্বালিয়েই ফেলেছ তখন আমি বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি। অনেক দিন বাগদাদ শহরটা দেখিনা” মেয়েটা বলে, “যাও ঘুরে আস। কিন্তু একটু সাবধানে!” সে হাতনেড়ে বিদায় জানায়। বোকা জ্বিনিটার এত ভাল লাগে! মনে হয় থাক বাইরে যেতে হবেনা। তার চেয়ে এখানে বসে মনিবের সাথে গল্প করি। কিন্তু বিদায় জানানো তো শেষ! তাই সে বাইরে চলেই যায়।
একটু পরেই হন্ত দন্ত হয়ে ফিরে আসে সে। মেয়েটা তখনো সেই ভাঙ্গা ঘরে বসে আছে। একা। মেয়েটা বলে শোন জ্বিনি তোমার জন্য একটা রাইমস বানিয়েছি! এর পরই হাত তালি দিতে দিতে সে ছড়া কাটে...
জ্বিনি জ্বিনি ব্যাড জ্বিনি
জ্বিনি কান্নট ফ্লাই,
ফাই ফাই ফাই!
ছড়াটা না বুঝলেও। বাচ্চাটার যে খুব বুদ্ধি তা বুঝতেপারে সে। ছড়া টাও ভাল লাগে তার। কিন্তু “একি! শহরটার এই অবস্থা হল কি করে? সেই উচু দালান গুলো কই! ঐ যে যেগুলোয় হাজার হাজার জাদুর বাতি জ্বলে” প্রশ্ন করে সে। মেয়েটা জ্বিনির বোকামি দেখে অবাক হয়। একটু বিরক্তও হয়। বলে, “ধ্যাত, তুমি তো খুব বোকা। কিছুই জান না! ঐগুলোতে তারার ফুল পড়েছে!! তারার ফুল পড়লে খুব আওয়াজ হয়। তার পর বিল্ডিংটা ভেঙ্গে যায়। সেখানে যেসব লোক থাকে তারা আর ফিরে আসে না। আব্বু বলে ওরা সবাই খুব মজার একটা যায়গায় চলে জায়। তবে, সেখানে নাকি এরকম তারার ফুল নেই। তারার ফুল না থাকলে মজাটা থাকলো কি? আব্বুর খুব ভয় তারার ফুলকে! আমার কিন্তু খুব ভাল লাগে” জ্বিনিটা বোকা বলেই হয়তো তারার ফুল ভাল লাগার ব্যাপারটা বুঝতে পারেনা। তার তো কেমন জানি ভয়ঙ্করই মনে হচ্ছে ব্যাপারটা।
মেয়েটা আরো বলে, “আব্বুর ভাল লাগে বৃষ্টি। যদিও সেটা হয় বছরে খুব কম। আব্বু বলেছে, আল্লাহ এখন বৃষ্টির চেয়ে তারার ফুল বেশি দিচ্ছেন। যাতে আমরা সবাই সেই মজার যায়গাটাতে যেতে পারি তাড়াতাড়ি! এই তো কিছুদিন আগেই আম্মু চলে গেল। আম্মু যে হাসপাতালে ডাক্তার ছিল সেখানে একদিন হঠাৎ করে তারার ফুল পড়ল একটা। আব্বু বলে, রাতে আলো জ্বাললে তারার ফুল পড়তে পারে ঘরে। আব্বু খুব মানা করে। তবু আব্বু যখন থাকেনা, তখন আমি ঘরে আলো জ্বেলে দেই। মজার দেশটায় যেতে আব্বু কি যে ভয়! বুঝিনা!! কিন্তু আজ লাইট জ্বলছেনা। সেই জন্যেই তো তোমার চেরাগ টা জ্বালালাম!”
এমন সময় কেমন যেন গর্জন শুরু করে আকাশটা সাথে শো শো আর চিইই করে একধরনের শব্দ। মেয়েটা বলে, “ঐ তো তারার ফুল এসে গেছে। দেখ দেখ!” জ্বিনি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। দেখে আকাশ চিরে তারার মত কি যেন ছুটে যাচ্ছে। শত শত হাজার হাজার। এরা দূরে গিয়ে পড়ছে কোথাও। সাথে সাথে প্রচন্ড একটা শব্দ! জ্বিনিটা বোকা বলেই হয়তো তার কাছে কেমন অসুভ লাগে ব্যপারটা!! এমন সময় শব্দ গুলো যেন এগিয়ে আসতে থাকে তাদের দিকে। একটার পর একটা, ক্রমাগত আরো জোরে শব্দ করতে করতে।
জ্বিনির ভয়টা যেন আতঙ্কে রূপ নেয় এবার। এই ছোট্ট মনিবের প্রতি কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে তার। সে কিছুতেই যেতে দিতে চায় না মেয়েটাকে। সেই মজার দেশে! শব্দ আরো বেড়ে গেছে। তার ছোট্ট বুদ্ধিমতি মনিবটাকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে বোকা জ্বিনি। প্রানপনে দৌড়াতে থাকে সে। সন্ধার অন্ধকারে সেই ভাঙ্গাচোরা একটা শহরের মধ্য দিয়ে। মেয়েটার তারার ফুলে কোন ভয় নেই। এ আর এমন কি! নিয়মিত ব্যপার। মেয়েটা ছড়া কাটতে থাকে...
জ্বিনি জ্বিনি ব্যাড জ্বিনি
জ্বিনি ক্যান্নট ফ্লাই
ফাই, ফাই, ফাই!
জীবনে এই প্রথম উড়তে না পারার জন্য প্রচন্ড আক্ষেপ হয় বোকা জ্বিনির। প্রচন্ড ব্যার্থ মনে হয় তার নিজেকে.....
গল্প এখানেই শেষ হবার কথা। কিন্তু জ্বিনিটা ছুটতেই থাকে, ছুটতেই থাকে। তারার ফুল গুলোর কাছে হেরে যাবার ভয়ে; তীব্র হাহাকারে বাচ্চাটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে সে। তার পর যেন হঠাৎ করেই সে খেয়াল করে, তার চোখটা ভিজে যাচ্ছে পানিতে!!! পাঠক হয়তো ভাববেন, জ্বিনিরা আগুনের তৈরি। তার চোখে পানি আসবে কি করে?!!! আসলে বোকা জ্বিনির কোন দোষ নেই। দোষ হচ্ছে লেখকের। সেই লোকই রূপকথা লিখতে গিয়ে, এরকম একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেছে।
[গল্পটা উৎসর্গ করছি ইরাকের সেই সব শিশুদের প্রতি, যারা বড় হবে তারার ফুল দেখতে দেখতে। অথবা চলে যাবে সেই মজার দেশটাতে! বড় হবার অনেক আগেই...]