উত্তম-সুচিত্রা জুটির অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা দীপ জ্বেলে যাই সিনেমাটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ঐ যে একটা হাসপাতালে নানা রকম রোগী নিয়ে ডাক্তার-নার্সদের জীবনের গল্প। যেখানে এক বদ্ধ উন্মাদকে সুস্থ করার দায়িত্ব পড়ে সূচিত্রা সেনের উপর। সূচিত্রা তার মমতা আর মানবিক যতেœর মাধ্যমে সুস্থ করে তুলেন সেই উন্মাদকে। যে ছিল একই সাথে উন্মাদ এবং হিংস্র।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তেমনি একটি গল্পের জন্ম দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা পদ্মা রহমান

গ্রামের অতি সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে মালেক। তার দুনিয়া বলতে হয়ত বাবার সাথে কৃষিকাজ কিংবা গ্রামের ছেলেদের সাথে মাছ ধরা, ঘুড়ি উড়ানো। এই অতি সরল সাধারণ ছেলেটিই একদিন দেশ মাতৃকার টানে অস্ত্র হাতে নেমেছিল মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে। ছেলেটি কখনো যুদ্ধ বা অস্ত্র দেখেনি। কিন্তু ৭১ তাকে নিয়ে আসে যুদ্ধের ময়দানে। তার বুকের ভেতর হয়ত একটা ক্রোধ কাজ করছিল পাকিস্তানী সেনাদের উপর। কিন্তু কেন, কেউ তা জানতে পারেনি কখনো। একটা সম্মুখ সমরে সে ছিল অন্যসব মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। সেই যুদ্ধে পাক সেনারা পরাজিত হয়ে পিছু হটে। আর যাবার সময় ফেলে রেখে যায় তাদের কিছু আহত আর নিহত যোদ্ধাকে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বুঝতে পারল আরেকটি বিজয় তাদের হাতের মুঠোয়। ঠিক তখনই তারা তাকিয়ে দেখে মালেক দৌড়ে চলে গেছে পড়ে থাকা পাক সেনাদের কাছে। খুব সম্ভবত বেয়নেট দিয়ে কেটে ফেলল এক পাক সেনার মাথা। আর সেই মাথার চুল হাতের মুঠোতে নিয়ে দিকবিদিক ছুটাছুটি করতে করতে চিৎকার করে বলতে লাগল “সব কয়টারে কাইটা ফালামু। কে কৈ আছস! সব কাইটা ফালামু....”। সহযোদ্ধারা ছুটে আসলো তার কাছে। কিন্তু মালেক কাউকে পাত্তা না দিয়ে আগের মতোই চিৎকার করতে লাগলো। একটা উন্মত্ততা পেয়ে বসল মালেককে। এবার সে সহযোদ্ধাদের দিকে আগুন চোখে তাকালো। মুক্তিসেনাদের সন্দেহ বাড়তে লাগলো। একসময় তারা সংঘবদ্ধভাবে পাকড়াও করলো মালেককে। নিয়ে গেল মেলাঘর ক্যাম্পে । কিন্তু সেখানেও তার একই আচরণ। একসময় তাকে কোয়ার্টার গার্ড দিয়ে তারা বাধ্য হলো শিকল দিয়ে বেধে রাখতে। এভাবে চলল কিছু দিন। এ সময়ে তাকে কেউ যেমন কিছু খাওয়াতে পারেনি। তেমনি কেউ পারেনি তার কাছে ঘেষতে। যে কাছে গিয়েছে তাকেই মারতে উদ্যত হয়েছে মালেক। একসময় ক্যাম্পের সবাই বুঝতে পারলো মালেকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। উদ্যোম তারুণ্য নিয়ে সে যুদ্ধে গিয়েছিল। কিন্তু রক্ত আর লাশ তার সোজা সরল মনটাকে খুব সহজেই কাবু করে ফেলেছে। ফলে সে মানসিকভাবে হারিয়েছে স্বাভাবিক জ্ঞান। হয়ে গেছে বদ্ধ পাগল। তাকে বেধে নিয়ে আসা হলো ব্যানার্জি বাবুর বাগানে বানানো হাসপাতালে।
এই হাসপাতালে কর্মরত ডা. নাজিম
সেদিন ডিউটি শেষে পদ্মা তার অন্য সহকর্মীদের সাথে ফিরছিলেন তাবুতে
এর মাঝে অনেকেই মালেককে ঠান্ডা দেখে কাছে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অন্য যে কারো উপস্থিতি মালেককে উন্মত্ত করে দিত। সে সহ্য করতে পারতো না। চিৎকার করে গালি দিত। আর আগের মতোই কাইটা ফালামু, সবগুলারে কাইটা ফালামু বলে আক্রমণ করতে আসতো। পদ্মা যখন হাসপাতালে থাকতো তখন চিৎকার করে ডাকতো অই পদ্মা, কখনোবা অই পদ্মা আপা। যখন যা ইচ্ছে করতো তাই ডাকতো। দিনরাত যখন খুশি তখন পদ্মার নাম ধরে ডাকাডাকি করতো। পদ্মা এলে একদম চুপ। টুকটাক কথা বলতো। পদ্মা তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিত। কখনো কখনো মালেক আবদারের স্বরে বলতো, “তুইও খা”। পদ্মা হয়তবা একটু আধটু খেত। কিন্তু সমস্যা হয়ে যেত বিশেষ একটি ঘটনায়। ৭১ সালে হিন্দু পরিবারের একটি মেয়ে পদ্মা রাণী সরকার যখন মুসলমান ছেলে মালেককে গরুর মাংস দিয়ে ভাত মেখে খাওয়াতো আর মালেক যখন আবদারের স্বরে বলতো তুইও খা! দুটোর যে কোনটাই ছিল পদ্মার জন্য কঠিন পরীক্ষা। পদ্মাকে তখন নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হতো কোন রকমে মালেককে খাইয়ে নিজে না খেয়ে থাকার জন্য। কিন্তু তৎকালীন সময়ে একজন হিন্দু মেয়ে গরুর মাংস দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে একজন মানসিকভাবে উন্মাদ এক মুক্তিযোদ্ধাকে এটা একটি দেশের জন্য একজন অন্তপ্রাণ মানুষের কত বড় আত্মত্যাগ তা কি ভাবা যায়!
যাই হোক, সেই মালেক এক সময় সুস্থ্য হয়ে আবার ফিরে যায় যুদ্ধে। যাবার দিন অনেকেই মজা করে জিজ্ঞেস করলো, কিরে! তোর পদ্মারে নিয়ে যাবি না! মালেক লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। কিন্তু যাবার ঠিক আগে আগে পদ্মাকে ধরে সে কি কান্না! সবাই কাঁদলো। মালেক চলে গেল।

বি.দ্র. পদ্মা রাণী সরকার দেশ স্বাধীনের পর একই ক্যাম্পের লিঁয়াজোর দায়িত্বে থাকা ২ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা সাদেক রহমানকে

