দীপ জ্বেলে যাই’১৯৭১ (মুক্তিযুদ্ধের একটি সত্য ঘটনা)
উত্তম-সুচিত্রা জুটির অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা দীপ জ্বেলে যাই সিনেমাটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ঐ যে একটা হাসপাতালে নানা রকম রোগী নিয়ে ডাক্তার-নার্সদের জীবনের গল্প। যেখানে এক বদ্ধ উন্মাদকে সুস্থ করার দায়িত্ব পড়ে সূচিত্রা সেনের উপর। সূচিত্রা তার মমতা আর মানবিক যতেœর মাধ্যমে সুস্থ করে তুলেন সেই উন্মাদকে। যে ছিল একই সাথে উন্মাদ এবং হিংস্র।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তেমনি একটি গল্পের জন্ম দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা পদ্মা রহমান (তৎকালীন নাম পদ্মা রাণী সরকার)। দারোগা টিলায় নির্মিত হাসপাতালে তিনি ছিলেন কর্মরত। মাত্র তিনটি তাবু নিয়ে ছিল সেই হাসপাতাল। একটি ছেলেদের থাকার জন্য একটি মেয়েদের থাকার জন্য আর একটি রোগীদের জন্য। পরবর্তীতে দারোগা টিলা থেকে একটু ভিতরে হাবুল ব্যানর্জির বাগানের মালিক ব্যানর্জি বাবু বেশ কয়েকটি বাগান দিয়ে দেন মুক্তিসেনাদের চিকিৎসা সেবায়। শত শত ফলের বাগান কেটে প্রায় সাড়ে চারশো বেডের হাসপাতাল তৈরি হয় সেখানে।
গ্রামের অতি সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে মালেক। তার দুনিয়া বলতে হয়ত বাবার সাথে কৃষিকাজ কিংবা গ্রামের ছেলেদের সাথে মাছ ধরা, ঘুড়ি উড়ানো। এই অতি সরল সাধারণ ছেলেটিই একদিন দেশ মাতৃকার টানে অস্ত্র হাতে নেমেছিল মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামে। ছেলেটি কখনো যুদ্ধ বা অস্ত্র দেখেনি। কিন্তু ৭১ তাকে নিয়ে আসে যুদ্ধের ময়দানে। তার বুকের ভেতর হয়ত একটা ক্রোধ কাজ করছিল পাকিস্তানী সেনাদের উপর। কিন্তু কেন, কেউ তা জানতে পারেনি কখনো। একটা সম্মুখ সমরে সে ছিল অন্যসব মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। সেই যুদ্ধে পাক সেনারা পরাজিত হয়ে পিছু হটে। আর যাবার সময় ফেলে রেখে যায় তাদের কিছু আহত আর নিহত যোদ্ধাকে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বুঝতে পারল আরেকটি বিজয় তাদের হাতের মুঠোয়। ঠিক তখনই তারা তাকিয়ে দেখে মালেক দৌড়ে চলে গেছে পড়ে থাকা পাক সেনাদের কাছে। খুব সম্ভবত বেয়নেট দিয়ে কেটে ফেলল এক পাক সেনার মাথা। আর সেই মাথার চুল হাতের মুঠোতে নিয়ে দিকবিদিক ছুটাছুটি করতে করতে চিৎকার করে বলতে লাগল “সব কয়টারে কাইটা ফালামু। কে কৈ আছস! সব কাইটা ফালামু....”। সহযোদ্ধারা ছুটে আসলো তার কাছে। কিন্তু মালেক কাউকে পাত্তা না দিয়ে আগের মতোই চিৎকার করতে লাগলো। একটা উন্মত্ততা পেয়ে বসল মালেককে। এবার সে সহযোদ্ধাদের দিকে আগুন চোখে তাকালো। মুক্তিসেনাদের সন্দেহ বাড়তে লাগলো। একসময় তারা সংঘবদ্ধভাবে পাকড়াও করলো মালেককে। নিয়ে গেল মেলাঘর ক্যাম্পে । কিন্তু সেখানেও তার একই আচরণ। একসময় তাকে কোয়ার্টার গার্ড দিয়ে তারা বাধ্য হলো শিকল দিয়ে বেধে রাখতে। এভাবে চলল কিছু দিন। এ সময়ে তাকে কেউ যেমন কিছু খাওয়াতে পারেনি। তেমনি কেউ পারেনি তার কাছে ঘেষতে। যে কাছে গিয়েছে তাকেই মারতে উদ্যত হয়েছে মালেক। একসময় ক্যাম্পের সবাই বুঝতে পারলো মালেকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। উদ্যোম তারুণ্য নিয়ে সে যুদ্ধে গিয়েছিল। কিন্তু রক্ত আর লাশ তার সোজা সরল মনটাকে খুব সহজেই কাবু করে ফেলেছে। ফলে সে মানসিকভাবে হারিয়েছে স্বাভাবিক জ্ঞান। হয়ে গেছে বদ্ধ পাগল। তাকে বেধে নিয়ে আসা হলো ব্যানার্জি বাবুর বাগানে বানানো হাসপাতালে।
এই হাসপাতালে কর্মরত ডা. নাজিম রোগীটিকে খুব ভালমতো দেখলেন। জানলেন তার পেছনের গল্প। তারপর ভাবতে বসলেন কিভাবে এই উন্মাদকে সুস্থ করা যায়। ঠিক তখনই তার মনে পড়ল কিছুদিন আগে দেখা একটি ঘটনা। তখনও হাসপাতালে আহত রোগীদের ভীড় বাড়েনি। বেশীর ভাগ রোগী আসতো পেট খারাপ, জ্বর, ম্যালেরিয়া এসব নিয়ে। এমনি এক রোগী একদিন বমি করার জন্য গামলা খুঁজছিল। পাশেই ছিলেন সেখানে কর্মরত পদ্মা। তিনি তাড়াতাড়ি একটা গামলা নিয়ে সেই রোগীর মুখের সামনে ধরার আগেই রোগীটি বমি করে বসলো পদ্মার মুখে। পদ্মা প্রথমে হোচট খেলেও সরে যান নি। তিনি বাম হাতে চোখ মুখ থেকে বমি পরিস্কার করলেন। কিন্তু সেই গামলাটি ধরে রাখলেন সেই রোগীর সামনে যতক্ষণ সে বমি করল। ... সেদিনের সেই ঘটনা ডা. নাজিমের মনে গেথেছিল। তাই তিনি ধারণা করলেন, একমাত্র পদ্মাই পারবে এই রোগীকে ভাল করতে। কিন্তু কিভাবে তিনি বলবেন...!
সেদিন ডিউটি শেষে পদ্মা তার অন্য সহকর্মীদের সাথে ফিরছিলেন তাবুতে । এমন সময় ডা. নাজিম তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সবাইকে বললেন চলে যেতে। শুধু পদ্মাকে বললেন, “তুই থাক তোর সাথে কথা আছে”। পদ্মাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুই কি উত্তম-সূচিত্রার দীপ জেলে যাই সিনেমাটা দেখেছিস? পদ্মা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো যুদ্ধের সময় এত রসের কথা আসে কিভাবে? তারপরপরই হ্যা সূচক উত্তর দিল। তখন তিনি বললেন, আচ্ছা সেই সিনেমায় সূচিত্রা যে একটা পাগলকে সুস্থ করে... সেটা মনে আছে? পদ্মা জানালো, হ্যা আছে তো! তো এখন কি হয়েছে? তখন ডা. নাজিম থলের বিড়াল বের করলেন। বললেন, আচ্ছা মনে কর তোকে যদি এখন এমন একটা পাগলের দায়িত্ব দিই, তাহলে তুই তাকে সুস্থ করতে পারবি না! পদ্মা বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন। তারপর মজা করেই বলেন, পারবো। তখন তিনি পদ্মাকে জানান মালেকের কথা। পদ্মা সাথে সাথে মালেককে দেখতে যায়। একটা তাবুতে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে। পদ্মা দূর থেকে ডাকলো, মালেক! এই মালেক! মালেক! মালেক অনেকক্ষণ পর চোখ তুলে পাশ ফিরে তাকালো পদ্মার দিকে। পদ্মা একটু যেন ঘাবড়ে গেল। মালেকের চোখে যেন শরীরের সব রক্ত জমা হয়েছে। আগুন যেন ঠিকরে উঠছে সে চোখ দিয়ে। একটা ক্রোধ ফেটে বেরোবে। পদ্মা চলে আসেন। পরদিন সকালে আবারও যান মালেকের কাছে। নিরাপদ দূরত্ব রেখে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু মালেকের কোন সাড়া পান না। মালেক হঠাৎ চিৎকার করে উঠে, “সব কাইটা ফালামু, সব মাইরা ফালামু”। দিন তিনেক পর দূর থেকে পানির পাত্র এগিয়ে দেন। মালেক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে পানির পাত্র টেনে নিয়ে গলায় ঢালে। এভাবে আরো কিছুদিন যাবার পর মালেক যেন একটু আশ্বস্থ হলো যে, পদ্মা তার জন্য ক্ষতিকর কিছু না। পদ্মা যখন তার কাছে যায়, তখন একবার ফিরে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে। আর পদ্মাও প্রতিদিন হাসপাতালে একটু সময় কাটিয়ে চলে আসে মালেকের কাছে। আরো কিছুদিন যাবার পর পদ্মা তার খুব কাছে গিয়ে বসে। খুব অল্প কথা বলে। এভাবে কেটে গেল আরো কিছু দিন।
এর মাঝে অনেকেই মালেককে ঠান্ডা দেখে কাছে যাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অন্য যে কারো উপস্থিতি মালেককে উন্মত্ত করে দিত। সে সহ্য করতে পারতো না। চিৎকার করে গালি দিত। আর আগের মতোই কাইটা ফালামু, সবগুলারে কাইটা ফালামু বলে আক্রমণ করতে আসতো। পদ্মা যখন হাসপাতালে থাকতো তখন চিৎকার করে ডাকতো অই পদ্মা, কখনোবা অই পদ্মা আপা। যখন যা ইচ্ছে করতো তাই ডাকতো। দিনরাত যখন খুশি তখন পদ্মার নাম ধরে ডাকাডাকি করতো। পদ্মা এলে একদম চুপ। টুকটাক কথা বলতো। পদ্মা তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিত। কখনো কখনো মালেক আবদারের স্বরে বলতো, “তুইও খা”। পদ্মা হয়তবা একটু আধটু খেত। কিন্তু সমস্যা হয়ে যেত বিশেষ একটি ঘটনায়। ৭১ সালে হিন্দু পরিবারের একটি মেয়ে পদ্মা রাণী সরকার যখন মুসলমান ছেলে মালেককে গরুর মাংস দিয়ে ভাত মেখে খাওয়াতো আর মালেক যখন আবদারের স্বরে বলতো তুইও খা! দুটোর যে কোনটাই ছিল পদ্মার জন্য কঠিন পরীক্ষা। পদ্মাকে তখন নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হতো কোন রকমে মালেককে খাইয়ে নিজে না খেয়ে থাকার জন্য। কিন্তু তৎকালীন সময়ে একজন হিন্দু মেয়ে গরুর মাংস দিয়ে ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে একজন মানসিকভাবে উন্মাদ এক মুক্তিযোদ্ধাকে এটা একটি দেশের জন্য একজন অন্তপ্রাণ মানুষের কত বড় আত্মত্যাগ তা কি ভাবা যায়!
যাই হোক, সেই মালেক এক সময় সুস্থ্য হয়ে আবার ফিরে যায় যুদ্ধে। যাবার দিন অনেকেই মজা করে জিজ্ঞেস করলো, কিরে! তোর পদ্মারে নিয়ে যাবি না! মালেক লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। কিন্তু যাবার ঠিক আগে আগে পদ্মাকে ধরে সে কি কান্না! সবাই কাঁদলো। মালেক চলে গেল। তারপর আর কেউ জানে না শেষ পর্যন্ত মালেকের পরিণতি কি হয়েছে। সে কোথায় আছে কিংবা আজো বেঁচে আছে কিনা!
বি.দ্র. পদ্মা রাণী সরকার দেশ স্বাধীনের পর একই ক্যাম্পের লিঁয়াজোর দায়িত্বে থাকা ২ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা সাদেক রহমানকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পদ্মা রহমান নাম গ্রহণ করেন। এখানে মুক্তিযোদ্ধা পদ্মা রহমানের যুদ্ধকালীন জীবনের বিশাল বর্ণময় ইতিহাসের ক্ষুদ্র একটি অংশ তুলে ধরা হলো। ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১ সালে পর পর তিনবছর মুক্তিযোদ্ধাদের গ্যাজেটে নাম তালিকাভুক্তির আবেদন করেও প্রতিবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন পদ্মা রহমান ও সাদেক রহমান।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন