কেউ কেউ মহাবিরক্ত হয়। প্রতি সপ্তাহে মসজিদে এইসব কি? হাত পা দিব্যি আছে, চোখেও যে ছানি পড়া তেমনও নয়। হ্যা, চুল টুল পেকে একাকার বটে ! তা এই বয়সেও বাবা সবাই ঘানি টেনে যাচ্ছে। কিন্ত এ ব্যাটা শর্টকার্ট ধরলো কেন? জুম্মার নামাজ শেষ হতে না হতেই, ভেতরেই একেবারে দরজার সামনে হাত পেতে দাড়িয়ে থাকা। কেন বাবা? বাইরে যে দুর্ভাগাদের লাইন, সেখানে বসে পড়লেই তো হয়! নাকি ভিখারির আবার লজ্জা?
এসব বিরক্তি মাখা ফিসফাস শব্দ যে আমার কানেও আসে না তেমন না। ঠিকই তো। হাত পেতে দাড়িয়ে থাকি, তো লাইনে দাড়ালেও তো হতো। পারি না। বিশ্বাস করুন পারি না। চেয়ারম্যান সাহেবের পরিবার বছরে দুটো করে লুঙ্গি গেঞ্জি আর পাঞ্জাবি দেয়। যতটা পারি পরিস্কার পরিছন্ন হয়েই মসজিদে আসি। যদি কেউ দয়া করে। একই জাত হলেও কেন জানি নিজেকে বাকি ভিখারিদের সাথে কোনভাবেই মেলাতে পারি না।
যে বস্তিতে থাকি, সেখানেও ওরা কেমন জানি এড়িয়ে চলে। অবশ্য অনেক অনেক দিন কথা না বলতে বলতে আমিও তো প্রায় বোবা। তাই আগ বাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলা হয়ে উঠেনা। ব্যাতিক্রম শুধু জমিলার মা। কিছু টাকা দেই, সে দুবেলা সামান্য ভাত তরকারি দিয়ে যায়। তার সাথেই যা দুই একটা কথা বলা। মানে সে বেটি রাজ্যের কথা ঘটনা বলে যায়। আমি হু হা করে কাটিয়ে দেই।
মেলাতে পারি না। কিছুতেই মেলাতে পারি না। জীবনের হিসেব মেলেনি। অথচ এই হাতে, বিশ্বাস করুন, কুঁচকে যাওয়া চামড়া নির্জীব হয়ে যাওয়া এই দুটো হাতে কোম্পানির কত হিসেব মিলিয়েছি। রাতের পর রাত দিনের পর দিন, এই হাতের হিসেবের ফাক গলে কোম্পানির কর্মচারিদের বেতন হয়েছে। শুভংকরের ফাকি রোধ করেছি, ফলে মাসে মাসে মালিকের গিন্নির শাড়ি গয়না আর বিলাস দ্রব্যের ঘাটতি হয়নি। আগে ছিল একটা এর পর মালিকের কয়েক্টা আপিস হয়েছে। ব্যাংক ব্যালেন্স বেড়েছে। সবকিছুর হিসাব এই আমি, জীবন সংগ্রামে পোড়া মুখের এই আমি, সৃস্টির সেরা মানুষের মধ্যে একজন রেখেছে।
না না। গল্প উপন্যাসের মত অত্যাচারি মালিক, শোষন আর বঞ্চনার ইতিহাস এটা নয়। তিনি ভালো লোক। নইলে ট্রাকের তলায় পড়েও বেচে যাওয়া এই আমাকে সুস্থ করতে তিনি এতো টাকা খরচ করতেন? কিন্ত আমি যে সুস্থ হতে পারলাম না। ডাক্তার বলে ট্রাকের ধাক্কার মাথার কোথায় যেন একটা ক্ষতের সৃস্টি হয়েছে। সারাতে অস্রপ্রচার লাগবে, তবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নেই।
আমি নাকি কোন এককালের ধনি মানুষের বংশধর। হাহাহা... সরকারি অফিসে কলম পেষা সৎ মানুষের মুখে কতবার যে এই কথা শুনেছি তার ইয়াত্তা নেই। বিশেষ করে এই সৎ মানুষটি, মানে আমার বাবা , মাসের টাকার কম পড়লেই, এই রুপকথা শুনিয়ে সান্তনা দিতেন। রুপকথা ছাড়া আর কি বলবো বলুন? যা দেখিনি, তাকে বিশ্বাস করা যায়? অফিসের কলিগরা কতবার বলেছে, সিস্টেমের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। কে শোনে কার কথা। তার কথা একটাই হারাম খাবেন না। বউ পোলাপানের যাই হোক না কেন? যেন দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার মধ্যেই সবকিছু।
ঢাকা শহরে থাকছি, সমাজ বলেও তো কিছু আছে? আত্মিয় স্বজনের বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ পার্বণ, স্কুলের হাতখরচ। সবকিছুতেই এত টান টান। তাই আমরা তিনটি ভাই বোনে সব যায়গায় খুব গুটি সুটি হয়ে থাকতাম। মায়ের দামও ছিল না তার পিত্রালয়ে। তাই আস্তে আস্তে যেন সমাজে থেকেও সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে বেড়ে উঠলাম আমরা।
বোনটার বিয়ে হয়েছে অনেক ধনি মানুষের সাথে। ওর কি স্বপ্ন ছিল জানি না। সারাক্ষণ যারা গুটি সুটি হয়ে হয়ে থাকে, না তাদের মেরুদন্ড থাকে, না থাকে সাহস। স্বপ্ন থাকলেও, বলবে কি করে? বর দেখে সবাই মুখ টিপে হেসেছিল। বলেছিল, টাকাওয়ালা দেখে একটা আধা বয়সি উদ্ধতের সাথে মেয়েটার বিয়ে দিলো। স্বল্পবিত্তের মেয়ে, উচ্চবিত্তের ঘরে কি দাম পায়?
যখন চাকরিতে ঢুকলাম তখন সবার মনে আনন্দ। ছোটকালের মতই, মাথায় ওই সৎ থাকার উপদেশটা দিতে ভোলেননি বড় কর্তা। না বললেও হতো। ওই সব শুনে শুনে আমার মগজে তখন ও নীতি আদর্শ ভালোই গেড়ে বসেছিল।
কিন্ত ভাইটা যে মনে মনে এর উল্টো করবে বলে ভেবে রেখেছিল, কে জানতো।
যে ঘরে বড়লোক মেয়ে জামাই, ছোট ছেলের শন্য শন্য উন্নতি, তখন সাধারণ পরিবারের একটা মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি বলে ঘরেও খানিকটা অসন্তোষের গরম হাওয়া, সেটা টের পেয়েছিলাম। আমার বউ এর দামটাম তেমন ছিল না। আমার শশুড় পক্ষাঘাতে পঙ্গু। শাশুড়ির নানা রকম রোগে আক্রান্ত। শালিগুলি সবে কলেজে পড়ছে। শুধু আমাকে ভালোবাসার কারনে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ের পীড়িতে বসেছে। শর্ত একটাই। বিয়ের পর ওকে চাকরি করতে দিতেই হবে। মানা করিনি। আমার অবস্থা তো এমন নয়, যে শশুড়বাড়ি পালতে পারবো। তার চেয়ে সে যদি চাকরি করে পরিবারের ভরণপোষন করতে পারে ক্ষতি কি?
দিনটার কথা খুব মনে আছে। সারা রাত বৃস্টির আচ সেই ভোর বেলাতেও লেগেছিল। কদিন ধরেই বউ এর উপর মন খারাপ। চাকরি করো ভালো কথা, তার অনেক কস্ট হয়, সেটাও বুঝি। কিন্ত তাই বলে, অফিসের হতাশা আমার উপর কথার খোচার বইয়ে দেয়া? কি করে যেন মাও শুনেছিলেন। তো সন্তানের পক্ষ্যে তিনিও বউকে দুকথা শুনিয়েছেন। উত্তরে বউও আমার আয় নিয়ে কম কথা শোনায়নি। দুপক্ষ্যের মধ্যে পড়ে আমি হয়ে পড়েছিলাম কিংকর্তব্যবিমুঢ় !
সারা রাত ভেবেছিলাম। অনেক হয়েছে। উচ্ছন্নে যাক আদর্শ সততা। কি হবে এসবে? এসব করে একজন তো আমাদের জীবন নরক করে দিয়েছে। আমার সন্তানরাও সে কস্টে থাকবে কেন? আমার মালিকের তো কম টাকা নেই। কি ক্ষতি সেখান থেকে কিছু টাকা সিস্টেম করলে? সমুদ্র থেকে ক বালতি পানি সরালে সমুদ্রের কোন ক্ষতি হতে পারে?
বাসা থেকে বের হইয়ে সেই চন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এত সকালে ট্রাফিক জ্যাম ট্র্যামের বালাই তেমন ছিল না। এর পর কিসের আঘাতে খুব গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম।
হাসপাতালে সবাই এসেছিল দেখতে। প্রাথমিক সব চিকিৎসার খরচ দেবার পর, বাড়তি ওই খরচের কথা শুনে মালিক এড়িয়ে গেলেন। ভাইটির ভ্রু কুঞ্চিত হলো। বউ এর মুখ কালো। মা বাবার অসহায় চোখ দেখে আমার নিজের বুকটাই ভেঙ্গে গেলো।
ডাক্তার বললেন বেড রেস্ট। বাকিটা দোইবের উপর। সস্তা ডিস্টেপার করা চার দেয়ালের মাঝে অতীত রোমন্থন করে সময় কাটতো। সকালে নাস্তা দুপুর আর রাতের খাওয়া ঘরেই আসতো। প্রথম কদিন মা আর বউ মিলেই দিতো। এর পর কাজের বুয়া। সক্ষম মানুষ যখন পঙ্গু হয়ে যায়, তখন বোধ করি সংসারে তার প্রয়োজনও থাকে না। রাতে বউ কে কাছে টানলে, মুখ ঝামটা " আহ সরো তো ! সারাদিন খাটাখাটনি করে একটু শান্তিতেও থাকতে পারি না।"
একদিন পাশের ঘর থেকে শুনলাম, ভাই বলছে, ভাইয়া তো আর সুস্থ হবে না। তাই ওকে জানানোরও দরকার নেই। বাড়িটা রিয়েলস্টেটের কাছে দিয়ে দেই। যা ভাগে পাওয়া যাবে, সেখান থেকে না হয় মাসে মাসে কিছু টাকা ওকে দেয়া যেতে পারে। তাছাড়া ভাবিরও ইনকাম আছে। ওর চলে যাবে।
তার কয়দিন পর দুর সম্পর্কের শালা এসেছিল। আমার ভালবাসার মানুষটিকে নাকি তার প্রবাসি একজন দুর সম্পর্কের আত্মিয়র সাথে বেশ ঘুড়তে দেখা যাচ্ছে। একদিন ভাইও বললো, ভাবিকে এক লোকের সাথে দেখলাম রেস্টুরেন্টে? কিছু জানো নাকি?
আমার ভালবাসায় কমতি ছিল কিনা সারাদিন বসে বসে ভাবতাম। দামি কিছু দেবার সামর্থ ছিল না, তাই বলে পালা পার্বন্যে কার্পন্য করেছি বলে মনে পড়ে না। তাছাড়া দুপুরের খাবারে পাউরুটি চাবিয়ে যে সাশ্রয় অথবা মাঝে মাঝে সিগারেট টানার বিলাসিতা দমন করে, যাইই জমতো, সবই তাকেই দিয়েছি।
ব্যাপারটা নিয়ে খুব আলতো করেই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাতেই চেচিয়ে বাড়ি মাথায় করেছিল। আমরা নাকি ছোটলোক, ছোটমনের মানুষ। তাই আত্মিয় স্বজনের সাথে ঘোরাঘুরি করলেও, বাকা চোখে দেখি। আমার দেহের সাথে মনেরও পঙ্গুত্ব ঘটেছে ইত্যাদি ইত্যাদি !
এর পর বেশিদিন থাকেনি সে। প্রবাসে কত প্রাচুর্য, কত স্বপ্ন। আমার সাথে পড়ে থাকলে, বাবা মা ভাই বোনসহ না খেয়ে থাকবে। তার চেয়ে বিদেশে চলে যাওয়াই উত্তম। এই সব বলে একদিন বউও বিদায় নিলো। পরিবারের কারো কাছ থেকে কোন সমর্থন পাইনি। কি করে পাবো? আমি নিজেই তো পছন্দ করে বিয়ে করেছি।
পরিবারের কেউ নই। ভালোবাসার মানুষটির কাছে অচেনা। আমার তো মরে যাওয়াই ভালো ছিল। কিন্ত ঐ যে ! গুটি সুটি হয়ে বেড়ে ওঠারা কাপুরুষ দুর্বল ভীরু হয়েই থাকে সারা জীবন।
রক্তে এগুয়েমি। চরিত্রে একরোখা। না। আমি যখন মরতে পারবো না, তখন বেচে থাকবো। অনেকের কাছে গেলাম। একটা চাকরি যদি মেলে? চলতে গেলে পা কাপে, মাথায় তীব্র যন্ত্রণা দেখা যায়, শ্বাসকস্টে মনে হয়, এই বুঝি ওপারের ডাক এসে গেলো। এরকম মানুষকে কাজ কে দেবে বলুন?
রিয়েল এস্টেটের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছিলাম। সেটা দিয়ে চলেছে কিছুদিন। ভাইয়ের কাছে হাত পাতবো? কেন পাতবো? কিছুদিন আগেও মা কে বলছিল, বসে খেলে নাকি রাজার রাজত্বও শেষ হয়ে যায়।
স্বল্পবিত্তের ছেলে আমি। আত্মসম্মান তীব্র। অদমনীয় জেদ। আমি ইচ্ছে করে তো বেকার নই। ঠিক আছে, তবে ভিক্ষার থলিই জুটুক এই ললাটে। অচেনা মানুষের কাছে ভিক্ষা নেব। ক্ষতি কি? এরা তো আমার আত্মিয় স্বজনও নয় যে সামাজিক লজ্জায় পড়বো? গালি দিলে দেবে। লাথি খেলে খাবো। তবু সেটা অতি আপনজনদের দেয়া কাটার আঘাতের চেয়ে তীব্র হতে পারে না কোনমতেই।
আমি বেঁচে থাকবো। বেঁচে থেকে ব্যাঙ্গ করে প্রতিশোধ নেব। আমার মরণে তোদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সেই আনন্দ বঞ্চিত করে আমি চরম প্রতিশোধ নেব। যে ভাবে দিনের পর দিন, নিঃসঙ্গতা আর অবহেলায় আমাকে ঠেলে দিয়েছিস, ঠিক সেভাবে আমিও বেঁচে থেকে তোদের যন্ত্রণা দিয়ে যাবো। সমাজ জীবন সবার উপর প্রতিশোধ নেব।