যারা কখনও বান্দরবান যাননি তাদের জন্য এই লেখাটি কাজে লাগতে পরে।
প্রথমেই সাধারণ কিছু তথ্য: বান্দরবানের আয়তন ৪,৪৭৯.০৩ বর্গকিলোমিটার। এটা বাংরাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম জেলা। উপজেলা আছে ৭টি। বান্দরবান সদর, রোয়ংছড়ি, রুমা, লামা, থানচি, আলীকদম, নাইখংছড়ি। বাংলাদশের সবচে উচু পাহাড় এ জেলাতে আছে।
নামকরণ: এক সময় এ জেলাতে বিপুল সংখ্যক বানর ছিল। বানররা খাল পারাপারের সময় পরস্পর গা ঘেসাঘেসি করে একটি শেকলের মত লাইন তৈরী করত। এই শেকলকে স্থানীয় মারমা অধিবাসীরা ‘মোকসে’ বলে ডাকতো। বাংলায় মোক অর্থ বান্দর আর সে অর্থ বান্দ বা বন্দ বা বান্দা। এই মোকসে থেকেই এ জেলার নাম হয়েছে বান্দরবান।
হঠাৎ করেই আমাদের প্ল্যান তৈরী হয়। সেভাবেই প্ল্যান তৈরী হয়েছে এবার। চন্দনের সাথে ফোনে ফোনে ঠিক করলাম বান্দরবানের কোন দিকে যাওয়া যায়। যেহেতু বান্দরবান দুর্গম পাহাড়ী জনপদ। তাই বাংলাদেশের এই বিশাল জেলা একযাওয়ায় শেষ করা যাবে না। ডিসিশন হল এবার থনচি উপজেলা থেকে সাঙ্গু নদী ধরে আন্ধার মানিক পর্যন্ত যাব। এটা এবারের রুট।
ফেসবুকে পেয়ে গেলাম অতি উৎসাহী একজন ট্রাকার সিবলীকে। তাকে দায়িত্ব দিলাম একদিন আগে বান্দরবান শহরে যেয়ে থানচি যাওয়ার জিপ ও পথের খাবার দাবার, ঔষধ ইত্যাদি ইত্যাদির আয়োজন করার। পুরাতন বন্ধু মনা ভাইকে পেয়ে গেলাম সাথে। উনি আমাদের দেখে শুনে রাখার দায়িত্ব নিলেন। সাথে সাথী হলেন ফটোগ্রাফার শারমীন। আমার ক্যামরা এক্সপার্ট রাহাদতো থাকবেই। ২নভেম্বর রাতের সৌদিয়া বাসে চড়ে রওনা হয়ে গেলাম বান্দরবান।
ঢাকা থেকে বান্দরবান রুটে শ্যামলী, এস আলম, ইউনিক, ডলফিন, সৌদিয়া এই পাচটি বাস সাির্ভস চালু আছে। ভাড়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। ঢাকা থেকে বান্দরবান ৩৮৮ কিলোমিটার যেতে সময় লাগার কথা ৬ থেকে ৭ ঘন্টা।
সকাল ৬টার দিকে বাস চট্টগ্রাম আসলে চন্দন ৫টা লাইফ জ্যাসেট ও পাহাড় বাওয়ার সরম্জাম নিয়ে আমাদের সাথে বাসে উঠলো। সকাল সাড়ে আটটার দিকে বাস পৌছে গেল বান্দরবান শহরে।
এই সেই বাস যা রাস্তায় তিনবার নষ্ট হইছে।
শিবলী সাড়ে ৩ হাজার টাকায়া ভাড়ায় একটা টয়োটা জিপ নিয়ে হাজির ছিল বাসস্ট্যান্ডে। বাস থেকে সরাসরি মালামাল তুলে দিলাম জিপে। বান্দরবান শহরে না দাড়িয়েই জিপ ছুটলো থানচির পথে।
চলছে ক্যামেরা... উঠছে চলমান ছবি।
যারা প্রথম বান্দরবান আসবেন তারা অবশ্যই শহর ও তার আশপাশ বেড়াতে যান। যার মধ্যে স্বর্ণ মন্দির, মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরি, শৈলপ্রপাত, প্রান্তিক লেক, চিম্বুক, মিলনছড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি দেখতে যান। যেহেতু আমাদের টারগেট সাঙ্গু নদী তাই থানচী যেতেপথে প্রথমেই চোখে পড়ল... শৈলপ্রপাত।
উপর থেকে শৈলপ্রপাত।
শৈলপ্রপাত: এটা একটি ঝিরির অংশ। পাহাড়ের খাজে খাজে পানি নেচে নেচে নিচের দিকে গড়িয়ে যাওয়ার দারুন দৃশ্য পর্যটকেররা উপভোগ করেন এখানে। বান্দরবান শহর থেকে ৮ কিলোমিটার নীলগিরির পথে ফারুকপাড়ায় শৈলপ্রপাত অবস্থিত। শহরের খুব কাছে হওয়ায় এখানে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। শৈলপ্রপাতের উপরে একটা ছোট্ট আদিবাসীদের বাজার আছে। মজার মজার অনেককিছু কিনতে পারবেন ওখান থেকে। তবে দামটা একটু বেশী নেবে।
ওরে এটা আমি।
শৈলপ্রপাত।
শৈলপ্রপাতে কিছু সময় কাটিয়ে রওনা হলাম চিম্বুকের পথে।
চিম্বুক: বান্দরবান শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার থানচীর রাস্তায় চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। এখানে মোবাইল ফোনের টাওয়ার সহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাম্প সহ রেষ্টহাউজ ও দোকান আছে। এখান থেকে দুরে বহুদুরের পাহাড়, পাহাড়ে মেঘের খেলা দেখতে পাবেন। অনেকেই ২২শ ফিট উচ্চতার চিম্বুককে বাংলাদেশের সবচে উচু স্থান মনে করে ভুলে করেন।
চিম্বুকের মোবাইল ফোন টাওয়ারের সাথে আমি।
চিম্বুকে বাংলাকলা খেয়ে রওনা হলাম নীলগিরির পথে। ১কিলোমিটার মত এগুয়েই পেয়ে গেলাম বিডিআরের ক্যান্টিন। কিন্তু বিধিবাম। খাবার শেষ। অগত্য ক্ষিদে পেটে ছুটলাম নীলগিরি উদ্দেশ্যে। আকাবাকা পাহাড়ী রাস্তা ধরে জিপ সা সা করে ছুটে চলছে। দুপাশের অদেখা দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে চলে এলাম নীলগিরিতে।
নীলগিরিতে মজা লই।
নীলগিরি: এটি পাহাড়ের উপরে আরমিদের একটি হিলটপ রির্সোট। সুন্দর করে সাজানো। ৪/৫টি কটেজ আছে। তাছাড়া তাবুর ব্যবস্থাও আছে। ভাল রেষ্টুরেন্ট আছে। কটেজগুলোর ভাড়া প্রতি রাত ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা। থাকতে সেনাবাহিনীর পারমিশন লাগে। নীলগিরি শহর থেকে থানচির পথে ৪৬ কিলোমিটার এবং সমুদ্রপিষ্ঠ থেকে ২৪শ ফিট উপরে অবস্থিত।
ইহাকেই বলে নীরগিরি।
নীলগিরিতে পেয়ে গেলাম মুরগির কম্বো খিচুড়ি। এক বাটি (ছোট) ৪০ টাকা। বাটি হাতে পেয়ে শুধু গাপগুপ গাপগুপ শব্দ হল।আহ্...এবার রওনা দিলাম থানচির উদ্দেশ্যে। এতক্ষনে বিকেল ৪টা বেজে গেছে। বান্দরবান শহর থেকে থানচির দুরুত্ব ৮৮ কিলোমিটার। সেরকম রাস্তা। সিংগেল-চিকন, উচু কখনও ঢালু.... তবে জিপ চলছে উড়ে উড়ে
আমাদের পঙ্খিরাজ জিপ।
যেতে পথে বলিপাড়া বিডিআর ক্যাম্পে জিপ চালক রিপোট করে এলো। এরপর ভর সন্ধ্যায় পৌছে গেলাম থানচীতে।
থানচি সাঙ্গু নদীর উপর নতুন ব্রীজ তৈরী হচ্ছে। ব্রীজ তৈরী শেষ হয়ে গেলে গাড়ি সরাসরি থানচী শহরে (বাজারে) চলে যাবে। অগত্য মালামাল নিয়ে একজন পের্টারকে সাথে করে আমরা সবাই নামলাম সাঙ্গু নদীর ধারে। অন্ধরার হয়ে গেছে। খেয়াল করলাম কুট কুট করে কি যেন কামড় দিচ্ছে। সিবলী মশা রোধক অডোমস বের করতেই মাঝি জানালো এগুলো মশা না। এদের নাম হাতি পোকা। জীবনে প্রথম হাতিপোকার কামড় খাইলাম।
থানচি বাজারে এসেই ছুটলাম একমাত্র রেষ্টহাউসের দিকে। বাজার থেকে একটু উপরে এর স্থান। যেয়েই ৫ রুমের দোতলা থানচী রেষ্টহাউসের ২টি রুম পেয়ে গেলাম। তারপরও ওরা কেউ রুমে থাকলো না। টানানো হল আমাদের বিলাশ বহুল বিশাল তাবু। এর মধ্যে বেশ কজন মাঝি আমাদের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করল। আমি আর চন্দন দামদর ঠিক করতে লাগলাম। ফটোগ্রাফার শারমীন আর ম্যানেজার সিবলী ছুটলো বাজারে খাবার খুজতে। দাদাভাই মুনা আর ক্যামেরাম্যান রাহাদ লেগে গেলেন রাতের ক্যাম্প ফায়ার আর বার-বি-কিউয়ের আয়োজনে।
দারুন এক শীতের আমেজে আমরা টের পেলাম আকাশ ভরা তারা মাঝে আজ থেকে পরপর তিন দিন চাঁদের দেখা পাওয়া যাবে না। ঘোর আমাবশ্যা চলছে।
আকাশ ভরা তারা।
(...চলবে)
আরো কিছু ছবি দেখতে এইখানে ক্লিক করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১১ রাত ৮:৫৮