মেঘ
হাতের মুঠোয় অরণ্য এবং অন্ধকার । দৃষ্টি-সুদূর - ছায়াচ্ছন্ন পাখি , অতল চোখে বিষণ্ণতা । আমি হেঁটে হেঁটে পার হয়ে যাই একটা মনোটোনাস দুপুর ; রৌদ্র-শায়িত ঘাস-বাগান । বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে হলুদ পাখির দীর্ঘশ্বাস ; উড়ে যায় অনির্দিষ্ট দিকে - ধূসরতায় । আমি হাটি , আমি দৌড়াই , আমি থামি । সে আমার পিছু পিছু আসে ,
- ও দাদা , কয়েকটা ফুল নেন না !
আমি দেখি - উজ্জ্বল দুপুরটা ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে মোমের মত , অদূরে রঙ্গন-গাছটা ক্রমশ রূপান্তরিত হচ্ছে মেঘে – ধোঁয়াশা । এখনই কি বৃষ্টি হবে , ধেয়ে আসবে সুদীর্ঘ-প্রাচীন ঝড় ? হায় ! , একটা শীতল পুকুর খুঁজতে এসে কোথায় যে হারিয়ে গেলাম !
- ফুল ? কি ফুল ?
সে আমার হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় । আর আমি জ্বরগ্রস্তের মত কাঁপতে থাকি । হাতের মুঠোয় ফুলগুলো ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে । উত্তপ্ত হতে হতে সেগুলো হয়ে যায় – কয়েকটি বালিহাঁস । আমি ছুড়ে ফেলি । বালিহাঁসগুলো অস্ফুটে বলে – ব্যথা । তারপর পাখা মেলে উড়ে যায় । আর আমি একটি মনোরম ভোরের অপেক্ষায় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ি ।
ফুল
প্রতিটি অনিন্দ্যসুন্দর ভোরে আমি আসলে একজোড়া নূপুরের শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে থাকতাম । আমাদের ঘরের পেছনে ফুল বাগান , আমাদের ঘরের পেছনে জল-পুকুর , আমাদের ঘরের পেছনে এক মস্ত সকাল আটকে আছে । । সে চুপি চুপি বাগানে আসে , ফুল তুলতে । শিশিরে পা ফেললেই চমকে উঠে নিক্বণ , ঘাসে পদছাপ । তার বিষণ্ণ চোখ , বিষণ্ণ নাক-ফুল । আমার পাশের ঘরে মা সুরেলা কণ্ঠে কোরান পড়েন , সে সুর উড়ে আসে হাওয়ায় । আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখি - সে সুর ছড়িয়ে পরছে বাগানে , নিমতলায় তারপর পুকুরপাড় হয়ে ডানা মেলে দিচ্ছে আকাশে । আমি সে সুর এবং নূপুরকে পাশাপাশি রেখে বের হয়ে আসি ঘর থেকে । মা ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলেন
- ও বাজান কই যাসরে ... ?! মার আহ্বান প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আনুভূমিক ঝুলতে থাকে বাতাসে ।
আমি সেই আনুভূমিক প্রশ্নচিহ্ন কে পাশ কাটিয়ে নিরুত্তর পৌঁছে যাই বাগানে । তাকে দেখি , সে হাসে , সে মাথা ঝাঁকায় , সে ফুল তোলে । আর নিশ্চুপে ছড়িয়ে দেয় নিক্বণ ।
- এত ফুল দিয়ে কি হয় ?
- ঠাকুরকে পুজো দেই , দাদা ।
- আচ্ছা , তুমি আমাকে দাদা ডাক কেন ?
- এমনি , হি...হি...
তার হাসি ছড়িয়ে পরে ফুল বাগানে । প্রতিধ্বনিত হয় পাতায় , পাপড়িতে । চারপাশে ভেসে বেড়ায় কেবল- হি...হি...হি ...........................
আমি সে হাসির গভীর অতলে ডুবে যেতে যেতে উঠে আসি । প্রতিধ্বনি থেকে তুলে রাখি কিছু শব্দসমষ্টি ।
- আমাকে মালা গাঁথা শিখাবে ?
- হ্যাঁ , শিখাব । আপনি আমাকে ছবি আঁকা শিখাবেন ?
- শিখাব । দুপুরে চলে এসো বারান্দায় ।
তুমি বলতে অন্যকোন জন্মে তুমি পাখি ছিলে । তোমার পিঠে সেই পাখিজীবনের পাখার দাগ রয়ে গেছে এখনো । একদিন এই দাগ থেকে আবার পালক গজাবে , পাখা উঠবে । আর তুমি উড়ে যাবে মেঘ থেকে মেঘান্তরে ।
- দ্যাখো , এখানে একটি নদী থাকলে সমস্ত দৃশ্যপট পাল্টে যাবে ।
- হুম ! আর নদীর উপর সারি সারি হলুদ পাখি ।
- হলুদ কি খুব পছন্দ ?
- হ্যাঁ , আমি তো বেছে বেছে কেবল হলুদ ফুলই তুলি !
হলুদ বালিকা আমার ! তুমি কেন পাখি হতে চেয়েছিলে ? তুমি কেন হাতের মুঠোয় একটি রৌদ্রস্নাত দুপুর নিয়ে ঘুরতে ? তুমি কেন হাসতে , ফুল তুলতে ?
কতদিন ছবি আঁকা শিখাতে শিখাতে ভেবেছি , একদিন দৃশ্যপটে হারিয়ে যাব অনির্দিষ্ট , উদ্দ্যেশ্যহীন ।
- আচ্ছা , আপনি না কবিতা লিখেন ?
- মাঝে মাঝে লিখি দু একটা !
- একটা পড়ে শুনাবেন ?
- তুমি কবিতা ভালোবাস ?
- হুম ! রবি ঠাকুর প্রিয় । তার অনেক কবিতা পড়েছি ।
- একটা শুনাবে ?
সে চলে গ্যালো লজ্জিত হয়ে । আমি একটা অশ্রুত কবিতার বেদনা নিয়ে বসে রইলাম । আমি দেখলাম আমার বেদনার প্রান্ত বেয়ে ঝরে পরছে অজস্র বাতাবিলেবু ফুল , অনিঃশেষ তার সুঘ্রাণ । আমি ফুসফুসে কিছু সুঘ্রাণ জমা করে ছবি আঁকতে শুরু করি !
তারপর হয়তো বহুকাল তার সাথে দেখা হয়না । মা বলতেন – ওরা হিন্দু ! ওদের সাথে মিশতে নেই । পাপ হয় ! তবুও কোন নিঃসঙ্গ দুপুরে ছবি আঁকতে আঁকতে , হায় ! আমার কেবল তার কথাই মনে পরে । মনে পরে তার চোখের বিষণ্ণতা , হাওয়ায় ভেসে যাওয়া এলো-চুল !
হাওয়াঘর
কোন কোন সন্ধ্যায় আমাকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয় । আমি ফিরতে ফিরতে গান গাই , কবিতা আওড়াই , দৃশ্য-কল্প আঁকি । আমাকে ফিরতে হয় ফুলবাগান দিয়ে ,আমাকে ফিরতে হয় পুকুরের পাশ ঘেঁষে ! আমি দেখি একটি মনোহর সন্ধ্যা ক্রমশ পুকুরের অইপারে ডুবে ডুবে যাচ্ছে , নেমে আসছে সুদীর্ঘ শীতল রাত । হেঁটে হেঁটে আমি ফুল বাগানে এসে শুনি – কেউ একজন কাঁদছে । তার কান্না বিলাপের মত ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধ্যার বাঁকে বাঁকে । আমি কাছে গিয়ে দেখি – সে , বসে আছে ধুসর ঘাসে , মৃদু কাঁপছে ।
তার চুল এলোমেলো , তার গালে গলায় দাঁতের গভীর ক্ষত । তার ঠোঁট থেকে ঝরে পরছে রক্ত , তার শাদা শাড়ী এলোমেলো । তার পিঠের অদৃশ্য ডানা লুটিয়ে আছে কিছুদূর , হয়তো উড়তে চেয়েছিলো ! এমন আহত পাখি আমি আর একটিও দেখিনি ! কোন এক ব্যাধ তাকে হরণ করে চলে গ্যাছে সুদূরে রাতের পাতায় । তাকে কি আর কোনদিন খুঁজে পাব ?
আমি তার আশ্চর্য বিষণ্ণ দৃষ্টির সামনে মৃত ফুল হয়ে টুপ করে ঝরে পরি !
***