ঋতুর পরিবর্তন আল্লাহ তাআলার এক মহান নেয়ামত। একেক ঋতুর রয়েছে একেক বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিকুলের জীবন ধারনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহ তাআলা ঋতু পরিবর্তন করান। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আমরা এখন শীতকাল অতিবাহিত করছি। শীতকালে নানারকম শাক-সবজি, তরু-তরকারি পাওয়া যায় এটি আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। এ নেয়ামত নেককার-বদকার সকলে সমানভাবে ভোগ করেন। কিন্তু শীতকাল আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ইবাদতের এক বিশেষ মৌসুম। এ নেয়ামত একমাত্র তাঁর খাস বান্দাগণই উপভোগ করেন।
শীতকালকে রাসূল (সাঃ) নেককারদের বসন্তকাল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “শীতকাল হচ্ছে- মুমিনের বসন্তকাল”। [মুসনাদে আহমাদ ও ইমাম বায়হাকী]। বায়হাকীর রেওয়ায়েতে আরেকটু বাড়তি ভাষ্য রয়েছে সেটা হচ্ছে- “শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাত্রিকালীন নফল নামায আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে”।
তাইতো সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ থেকে শীতকাল সম্পর্কে অনেক স্বগোক্তি বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা শীতকালকে স্বাগত জানাতেন। ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে তিনি বলতেন-“শীতকাল তোমাকে স্বাগতম। শীতকালে বরকত নাযিল হয়। শীতকালে রাত দীর্ঘ হওয়ায় নামায আদায় করা যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা যায়।” হাসান বসরী (রহঃ) বলেন: “শীতকাল মুমিনের জন্য কতই না উত্তম। রাত দীর্ঘ হওয়ায় নামায পড়া যায় এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা যায়।”
শীতকাল নফল রোজা পালনের উত্তম মৌসুম। এ ঋতুতে রোজা পালন করতে গ্রীষ্মের মত তৃষ্ণার্ত হতে হয় না। আমের ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন: “শীতল গনিমত হচ্ছে- শীতকালে রোজা রাখা।”[তিরমিযি (৭৯৭), আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন] হাদিসটির ব্যাখ্যায় খাত্তাবী বলেন- শীতল গনিমত মানে- সহজলভ্য গনিমত। যেহেতু শীতের রোজায় রোজাদার গরমের তৃষ্ণা অনুভব করে না। মুআয (রাঃ) এর মৃত্যুসময় ঘনিয়ে এলে তাঁকে তাঁর ক্রন্দনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। তখন তিনি বললেন: “আমি মৃত্যুভয়ে কাঁদছি না। বরঞ্চ (রোজার কারণে) গ্রীষ্মের দুপুরের তৃষ্ণা,শীতের রাত্রির নফল নামায এবং ইলমের আসরগুলো হাজির হয়ে আলেমগণের সুহবত হারানোর জন্য আমি বিলাপ করছি।”
শীতের রাতে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করার সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যায়। শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদের জন্য সহজে জেগে উঠা যায়। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি কি তোমাদেরকে শীতল গণিমত কী সেটা বলে দিব না? শ্রোতারা বলল: অবশ্যই। তিনি বললেন: সেটা হচ্ছে-শীতকালে রোজা রাখা ও রাতে নামায পড়া।
শীতের ঠাণ্ডা আমাদেরকে জাহান্নামের তীব্র ঠাণ্ডার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বান্দা যদি শীতের ঠাণ্ডা অনুভব করে জাহান্নামের ঠাণ্ডা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায় আল্লাহ তাকে আশ্রয় দেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন নবী (সাঃ) বলেছেন: যদি কোন তীব্র ঠাণ্ডার দিন আল্লাহর কোন বান্দা বলে: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (নেই কোন সত্য উপাস্য আল্লাহ ছাড়া)। আজকের দিনটি কতই না শীতল। হে আল্লাহ! জাহান্নামের যামহারির হতে আমাকে মুক্তি দিন। তখন আল্লাহ জাহান্নামকে বলেন: নিশ্চয় আমার এক বান্দা আমার কাছে তোমার যামহারির হতে আশ্রয় চেয়েছে। আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি: আমি তাকে আশ্রয় দিলাম। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করল: যামহারির কী? নবী (সাঃ) বললেন: যামহারির এমন একটি ঘর যাতে কাফেরদেরকে নিক্ষেপ করা হবে এবং এর ভিতরে তীব্র ঠাণ্ডার কারণে তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে।[আমালুল ইয়াওম ওয়াল লাইলা (৩০৬)]
ইসলাম মানুষের সহজাত ধর্ম বিধায় ইসলামের প্রতিটি বিধিবিধান অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। তাইতো স্থান, কাল ও পাত্রের ভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিধান জারী করেছে। শীতকালের জন্য রয়েছে বেশকিছু স্বতন্ত্র বিধিবিধান। তাই এ বিষয়ে প্রাচীন ও নবীন আলেমগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। শীতকাল সম্পর্কিত হাদিসগুলোর সংকলন করেছেন সুয়ুতী – আহাদিসুশ শিতা (শীতকালের হাদিসসমূহ)। শাইখ ইউসুফ বিন আব্দুল হাদি সংকলন করেছেন- ইরশাদুল ফাতা বি আহাদিস শিতা। শাইখ আব্দুল্লাহ উবাইলান লিখেছেন- আসসালাতু ফির রিহাল ইনদা তাগাইয়ুরিল আহওয়াল (আবহাওয়ার পরিবর্তনে নিজগৃহে নামায আদায়)। এ পর্যায়ে শীতের বিশেষ কিছু মাসয়ালা তুলে ধরব।
শীতকালে সঠিকভাবে ওজু করা, ওজুর অঙ্গ ধোয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা না করা। প্রতিটি অঙ্গের যতটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো ফরজ ততটুকু স্থানে পানি পৌঁছানো। ঠাণ্ডার ভয়ে এ ক্ষেত্রে অবহেলা না করা। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- “তিনটি আমল পাপমোচন করে। ... তীব্র ঠাণ্ডা সত্ত্বেও সঠিকভাবে ওজু করা।”[আদদোয়া লিত তাবারানী (১৪১৪)] মুসলিম শরীফে এসেছে- রাসূল (সাঃ) বললেন: আমি কি তোমাদেরকে জানাব না- কিসে তোমাদের পাপমোচন করবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন: অবশ্যই; হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন: কষ্ট সত্ত্বেও ঠিকভাবে ওজু করা।[সহীহ মুসলিম (২৫১)] ইমাম কুরতুবী বলেন: অর্থাৎ তীব্র ঠাণ্ডা অথবা শরীরে ব্যাথ্যাবেদনা অথবা এ জাতীয় কোন সমস্যা সত্ত্বেও পূর্ণাঙ্গভাবে বা সঠিকভাবে ওজু করা।
শীতকালে মোজার ব্যবহার বাড়ে। শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ হাতে ও পায়ে মোজা পরে থাকেন। ওজুর ক্ষেত্রে পা না ধুয়ে মোজার উপর মাসেহ করা ইসলামী শরিয়ত অনুমোদন করে। তবে এ ক্ষেত্রে ওজু করে মোজা পরিধান করতে হবে। মুসাফির ব্যক্তি ৩ দিন ৩ রাত পর্যন্ত মাসেহ করে যেতে পারবেন এবং সংসারী ব্যক্তি ১ দিন ১ রাত মাসেহ করে যেতে পারবেন। এ সময়সীমার পর ওজুর প্রয়োজন হলে মোজা খুলে পা ধুয়ে ওজু করতে হবে। কোন কোন মাযহাবে শুধু চামড়ার মোজার উপর মাসেহ করা অনুমোদন করে। কিন্তু মুগীরা ইবনে শুবা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি কাপড়ের মোজা (জাওরাবাইন) ও জুতার উপর মাসেহ করেছেন।[তিরমিযি (৯৯) ও আবু দাউদ (১৫৯), আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন] এ হাদিসের ভিত্তিতে অন্যান্য মাযহাবে কাপড়ের মোজা ও পুরো পায়ের পাতা আবৃতকারী জুতার উপর মাসেহ করা অনুমোদন করে।
ঠাণ্ডার তীব্রতা যদি কারো সাধ্যের বাইরে চলে যায়, পানি গরম করে ব্যবহার করার সুযোগ না থাকে এবং পানি ব্যবহারে শারীরিকভাবে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে তিনি ওজু বা গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করতে পারেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত তিনি বলেন: শীতের মধ্যে একব্যক্তির উপর গোসল ফরজ হয়েছে। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন: এ অবস্থায় তার জন্য কোন অবকাশ আছে কি? উত্তরে তাকে গোসল করার নির্দেশ দেয়া হল। ফলে লোকটি মারা গেল। পরবর্তীতে বিষয়টি নবী (সাঃ) এর নিকট উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন: তাদের কি হয়েছে? তারা লোকটিকে হত্যা করেছে। তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ হোক (তিনবার)। আল্লাহ তাআলা তো মাটিকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন।”[বায়হাকী ১/২২৬]
কথায় বলে ঋতুর রাজা বসন্ত। কিন্তু মুমিনের জন্য ঋতুর রাজা শীত। সলফে সালেহীনদের অনুসরণে আমরা শীতকালকে ইবাদতের ঋতু হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্ক বাড়ানোর মৌসুম হিসেবে কাজে লাগাতে পারি। আল্লাহ তাআলা শীতকালকে গনিমত মনে করে শীতকালীন ইবাদতে মশগুল হওয়ার তাওফিক আমাদেরকে দান করুন। আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৫০