বিডিনিউজ ২৪ এর সূত্রে জানা যায় যে, গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার হাসেম রোডে তাওহিদা নামের একটি মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এলাকাবাসী ছেলে ধরা সন্দেহে পথচারী গার্মেন্টস কর্মী মাহমুদাকে পিটুনি দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এদিকে তাওহিদা নামের ওই শিশুটিকে পরে হাসেম রোডেরই আরেকটি বাসায় খুঁজে পাওয়া গেছে। সেখানে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছিল সে। খবরে আরো বলা হয়েছে- এই মাহমুদাকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিশের ৩ জন সদস্য আহত হয়েছেন।
মানুষের হাতে মানুষ হত্যার খবর প্রতিদিনই আমাদের দেশের পত্রপত্রিকার পাতা জুড়ে থাকে। অধিকাংশ হত্যাকান্ডগুলো সন্ত্রাসীচক্র বা দুষ্টচক্রের হাতে ঘটে থাকে। ধনী দরিদ্র, আমলা, মন্ত্রী, কূটনৈতিক কেউই আমাদের দেশে নিরাপদ নয়। যে কোন মূহূর্তে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে সন্ত্রাসীর হাতে, ছিনতাইচক্রের হাতে, দুষ্কৃতিকারীর হাতে - এ আশংকায় সবার মন সবসময় দুরু দুরু থাকে। কিন্তু মাহমুদার হত্যাকান্ডটি প্রমাণ করে শুধু দুষ্টচক্র নয় আমাদের সমাজের সাধারণ জনগণ সহিংস হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের চরিত্রে সহিংসতা, নির্মমতা, বর্বরতা স্থান করে নিয়েছে। যে কোন সমাজ বা সভ্যতায় কিছু দুষ্ট লোক বা দুষ্টচক্র থাকতে পারে। এরা গোটা সমাজের প্রতিবিম্ব নয়। কিন্তু হরহামেশা নিতান্ত তুচ্ছ কারণে যেইভাবে আমাদের দেশে মানুষ মারা হচ্ছে তাতে মনে হয় আমাদের গোটা সমাজ বা সমাজের অধিকাংশ মানুষ সহিংস হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র নিছক সন্দেহের বশবতী হয়ে একটা মানুষ মেরে ফেলা এবং তাকে রক্ষা করতে গিয়ে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আহত হওয়া প্রমাণ করে আমরা কত বেশী সহিংস ও নির্মম হয়ে উঠেছি।
আমাদের দেশের মানুষ গুজবে হুজুগে খুব বেশী প্রতিক্রিয়াশীল- এটা সবার জানা। কিন্তু আমরা এতবেশী প্রতিক্রিয়াশীল কিভাবে হলাম যে, একটা মানুষের জীবনের উপর হামলা করার আগে একটিবারের জন্য সে মানুষটিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিলাম না। আঘাতের পর আঘাত করে বর্বর এ মানুষগুলো নিরীহ নারীটিকে নিস্তজ করে দিল একটিবার তার অপরাধের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন উপলধ্বি করল না। কেউ যদি অপরাধী হওয়ার ১০০% প্রমাণ পাওয়া যায় তবুও জনসাধারণ কর্তৃক আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার পৃথিবীর কোন আইনে নেই। কোন প্রকার প্রমাণ ছাড়া রাস্তা থেকে ধরে নিরপরাধ একজন নারীকে হত্যা করা কত্তবড় অপরাধ, কত্তবড় বর্বরতা ও হিংস্রতা। আমরা কি কোন হায়েনাদের সমাজে বাস করছি!!
হারিয়ে যাওয়া "তাওহিদা" নামের শিশুটির নাম শুনে বুঝা যায় শিশুটি মুসলিম পরিবারেরর। সুতরাং ধরে নেয়া যায় যারা এ হত্যাকান্ডের সাথে যারা জড়িত তারাও সবাই মুসলমান। মাহমুদাকে গণপিটুনিতে অংশ নেয়ার সময় এই মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাস কোথায় উবে গেল। একটিবার তারা তথ্যটির সত্যতা যাচাই করল না কেন? আল্লাহ কি বলেননি "হে ঈমানদারগণ যদি কোন ফাসেক (কবীরাগুনাহগার) তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশংকায় যে, অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।"[সূরা হুজুরাত: ৬] এমনকি যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর পরিচয় নির্ধারণে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকলে তাকেও রেহাই দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দয়ালু আল্লাহ তাআলা। তিনি বলেছেন "হে মুমিনগণ, যখন তোমরা আল্লাহর রাস্তায় বের হবে তখন যাচাই করবে এবং যে তোমাদেরকে সালাম দেবে দুনিয়ার জীবনের সম্পদের আশায় তাকে বলবে না যে, 'তুমি মুমিন নও'।[সূরা নিসা: ৯৪] তাহলে এ হত্যাকারীরা মুসলমান হলে আক্রমণ করার আগে অপরাধীর অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না কেন!? এরা মুসলমান হলে হত্যা করা মহাপাপ তাদের এ অপরাধবোধ কোথায় গেল!! আল্লাহ কি বলেননি "হত্যার অপরাধ ছাড়া অথবা দুষ্কৃতির অপরাধ ছাড়া যে ব্যক্তি কোন মানুষকে হত্যা করল সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল।"[সূরা মায়িদা: আয়াত ৩২] "যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করে তার শাস্তি হচ্ছে চিরস্থায়ী জাহান্নাম, আল্লাহর গজব ও তাঁর লানত এবং আল্লাহ তাঁর জন্য কঠিন শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।" এই হত্যাকারীরা যদি মুসলমান হয়ে থাকে, জান্নাত জাহান্নামে বিশ্বাস করে থাকে এই হত্যার ব্যাপারে কোন জিনিস তাদেরকে প্ররোচিত করল। যে হাত দিয়ে তারা নিরীহ নারীকে আঘাত করল একটিবারের জন্য তাদের হাত কেঁপে উঠল না, থেমে গেল না!!
এই নিহত ব্যক্তিটি হত্যাকারীদের সহমর্মিতা পাওয়ার একাধিক কারণ ছিল। তিনি একজন নারী। এই হত্যাকারীরা যে ধর্মে বিশ্বাস করে সে ধর্ম তাদেরকে নারীর প্রতি সহমর্মী হওয়ার আদেশ দেয়। দয়ার নবী মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন "নারীদের প্রতি কোমল হও"। তিনি আরো বলেছেন "নারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করার প্রতি একে অপরকে উদ্বুদ্ধ কর।"[বোখারী ও মুসলিম]। যদি ধরে নিই এই হত্যাকারীদের মধ্যে কোন দ্বীনদারি নেই তবে অন্তত হেন মানবিক দয়ার বশবতী হয়েও কী তারা এ হত্যাকান্ডকে এড়িয়ে যেতে পারত না। এ নারীর আর্তনাদ শুনে হত্যাকারীদের মনে তাদের মায়ের চেহারা, বোনের কথা একটিবার মনে পড়ল না। উন্নত গুণের অধিকারী মানুষ যদি তার পিতার হত্যাকারী, মাতার হত্যাকারী, গোটা পরিবারের হত্যাকারীদের শাস্তি নিঃশর্তে মওকুফ করে দিতে পারেন এই হত্যাকারীরা কি মাহমুদাকে না পিটিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করতে পারত না, স্থানীয় কমিশনারের হাতে তুলে দিতে পারত না। মাহমুদা যদি অপরাধীও হতেন তাকে না পিটিয়ে কৌশলে স্বীকার করানোর চেষ্টা করা যেত না। এসব কোন সম্ভাবনাই ঘটেনি। এ হিংস্র ও বর্বর মানুষগুলো মাহমুদাকে কোন সুযোগই দেয়নি। তারা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এই নিরপরাদ, নিরীহ, অসহায় নারীটিকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়েছে।
নিঃসন্দেহে বলতে পারি মাহমুদার মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে, তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন। আল্লাহর কাছে শিরকের পর হত্যার চেয়ে বড় কোন অপরাধ নেই। তাইতো তিনি দুনিয়াতেই হত্যাকারীর শাস্তি কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন- "হে ঈমানদারেরা, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের উপর কিসাস (শিরোচ্ছেদ) ফরজ করা হয়েছে। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, ক্রীসদাসের বদলে ক্রীতদাস, নারীর বদলে নারী। তবে যাকে কিছুটা ক্ষমা করা হবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে তাহলে সততার অনুসরণ করবে এবং সুন্দরভাবে তাকে আদায় করে দেবে। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে হালকাকরণ ও রহমত। সুতরাং এরপর যে সীমালঙ্গন করবে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদয়ক আযাব। আর হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।" [সূরা বাকারা ১৭৮-১৭৯] এই ঘটনা যে আমাদের সমাজের বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা এমনটি বলা যাবে না। এর আগেও আমিনবাজারে ছিনতাইকারী সন্দেহে ৬ জন ছাত্রকে মারা হয়েছে। হরহামেশা আরো ঢাকা শহরে ছিনতাইকারী সন্দেহে কত মানুষ মারা হচ্ছে। এদের হত্যাকান্ডের পরেও কী আমরা সঠিক খবর জানতে পেরেছি- আসলে নিহত ব্যক্তি ছিনতাইকারী ছিল কিনা। কিন্তু এইবারের ঘটনায় ঘটনাটি ঘটার সাথে সাথে হারানো শিশুটি পাওয়া যাওয়াতে নিহত মাহমুদা ছেলে ধরার অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছেন। নয়তো নিহত হয়েও ছেলে ধরার অভিযোগ থেকে তিনি রেহাই পেতেন না।
আপনি যদি সমাজকে রক্ষা করতে এগিয়ে না আসেন কাল সকালে হয়তবা আপনিও এমন কোন ভিকটিম হয়ে যেতে পারেন। বিবেকবানদের উচিত সমাজকে রক্ষার্থে এগিয়ে আসা। এইভাবে একটি মানব সমাজের মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো যদি লোপ পেতে থাকে তাহলে এই সমাজ আর মানুষের সমাজ থাকবে না। হিংস্র জানোয়ারের সমাজে পরিণত হবে। সমাজের এক অংশ আরেক অংশকে জ্যান্ত ভক্ষণ করে নিজেদের ক্ষুধা মিটাবে। সমাজের জ্ঞানী লোকদেরকে, সৎ লোকদেরকে এই সমাজ বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। ভাল কথা, কল্যাণের কথা, উপদেশ সমাজের সকল স্তরে পৌঁছে দেয়ার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। নচেৎ আমরা কেউ রেহাই পাব না।
হে আল্লাহ! আপনি জানেন আমাদের করার ক্ষমতা খুবই কম, সাধ্য একেবারে সীমিত। আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন। বর্বর ও হিংস্র মানুষগুলোকে আমাদের উপর লেলিয়ে দিয়েন না। হে আল্লাহ! মাহমুদাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। তাঁর পরিবারকে ধৈর্যধারণ করার ক্ষমতা দিন। তাঁর সন্তান থাকলে তাদের উত্তম অভিভাবকের ব্যবস্থা করে দিন। তাঁর পরিবারের প্রতি মুমিনদেরকে সহানুভুতিশীল করে দিন এবং সহানুভুতিশীলদেরকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন। ইয়া রাব্বুল আলামীন।