আজ কদিন থেকেই দুলাভাইয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চেহারায় ঘোর অমাবস্যা! দুলাভাই দেখতে অবশ্য কুদর্শন নয়। তবে নামের আগে ‘কু’ আছে। প্রায়ই তিনি সে কথা স্মরণ করে পরানের গহীন ভেতর থেকে বায়বীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। নাম কুদরত কিন্তু কপাল খুলল না সারাজীবনেও! জীবনে না লাগল ভেলকি, কপালে না লাগল লটারি!
অবশ্য এ নিয়ে দুলাভাইকে তেমন চিন্তিত বলে মনে হয় না। দোষের মধ্যে শুধু তার কথোপকথন উচ্চস্বরে পৌঁছালে ফোর হুইলের গিয়ার চেঞ্জ করার মত নাসারন্ধ্র দিয়ে ঘোত ঘোত শব্দ ওঠে। এটা অনেকের কাছে ভীতিকর মনে হলেও আপা ওসব পাত্তা দেন না। এ নিয়ে দুলাভাইয়ের অবশ্য গুপ্ত মনোকষ্ট আছেÑসে শুধু আমরাই বুঝি। আর কী? না তাকে নিয়ে বলার আর তেমন কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, দুলাভাইয়ের ছাদে চুল কম কিন্তু সে তুলনায় বুদ্ধি বেশ! আর আছে দশাসই স্বাস্থ্য। সে কারণেই কিনা কে জানে হালকা রসিকতা কিংবা পাতলা বুদ্ধির ধার তিনি ধারেন না। তার সবকিছুতেই ‘ওয়েট’ থাকে। ওয়েট বজায় রেখে চলাটাই তার স্বভাব। কিন্তু অভাব হলো সময়ের। যে কারণে প্রায় সময়ই তিনি অন্যদের ওয়েটিংয়ে রাখেন। ফলে অনেক সময়ই দেখা যায় আজকের কাজ কাল তো নয়ই, পরশু এমনকি তরশুও আর করা হয়ে ওঠে না।
প্রতিবছর কোরবানির ঈদ এলেই দুলাভাইকে আপার কাছে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। এবার আপা ঠিক করেছেন দেশি গরু কোরবানী দিবেন। ইন্ডিয়ান কিংবা ওইসব বেজাত অস্ট্রেলিয়ান গরু হলে হবে না। খাঁটি দেশি গরু হতে হবে। আপার ধারণা এতে দেশি পণ্য কিনে যেমন ধন্য হওয়া যাবে তিমনি সোয়াবও মিলবে বেশি। এ জন্য আপা কিছু শর্তও দিয়েছেন। ঘাপলার শুরু এখান থেকেই। যেমন গরুর ফিগার হতে হবে হলিউডের নায়কদের মতো। চোখ দুটো টানাটানা, লেজের চুলগুলো স্ট্রেইট, লোমগুলো হতে হবে সিল্কি, রঙ হতে হবে রোদে পোড়া তামাটে, যাকে বলে ইস্টম্যান কালার। স্বভাব হবে বাপুরাম সাঁপুরের সেই সাপের মতো। অকারণে ফোঁসফাস করবে না। খোঁচা দিলেও শিং বাকিয়ে তেড়ে আসবে না। মাংস হতে হবে বেশি সে তুলনায় দাম হতে হবে কম। যদিও কোরবানীর গরুর প্রকৃত ক্রয়মূল্য প্রতিবেশীদের কাছে অপ্রকাশিতই থাকবে এ ব্যাপারে বাসার কাজের বুয়ার প্রতিও আপার কড়া নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু দুলাভাই নির্দেশ পালন করছে না দেখেই আপার মেজাজ টং। দুলাভাইয়ের চোখেমুখে তাই ঘোর অমাবস্যা।
ঈদের সময় যত ঘনিয়ে আসে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আপার পরিকল্পনাও বাড়তে থাকে। সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাতে গিয়ে দুলাভাইকে প্রতিবছর দৈনিক পত্রিকায় ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনের মত ‘সুদর্শন গরু চাই’ বিজ্ঞাপন দিতে হয়। এবার বিজ্ঞাপনেও কাজ হচ্ছে না। অথচ সময় বয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশীরা প্রায় সকলেই গরু কিনে ফেলেছেন। সেকথা তারা জানানও দিচ্ছেন বেশ জোরেশোরে।
কলিংবেল বাজিয়েও যাদের দরজা খোলা যায় না তারা স্বেচ্ছায় দরজা হাট করে খুলে রাখছেন হাট থেকে কেনা গরু দেখানোর জন্য। পাহাড় আকৃতির সব গরু। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। কেউ আবার দুইয়ের অধিক কিনেছেন। সঙ্গে খাসিও আছে। সফিক সাহেবের কথাই বলি। অবসর নিয়েছেন। রোজ নিয়ম করে সকালে কাজের ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে বের হন। এখন গরু নিয়ে বের হচ্ছেন। সামনে সফিক সাহেব, পেছনে গরু। তার পেছনে ছাগল। মোতালেব সাহেব বিকেল হলেই ট্রাউজার, কেডস পরে বাগানে পানি ছিটাতেন। এখন গরুর ঘাসে দুবেলা পানি ছেটান। হেনা আপা পরচর্চার চেয়ে রূপচর্চাকেই শ্রেয় মনে করেন। বাসায় গেলেই দেখা যায় অমুক গাছের ছাল, কচি পাতা, শুকনো লতা বুয়াদের দিয়ে বাঁটছেন। সেই বাড়ি থেকে গরম মসলা, আদা, এলাচের ঘ্রাণ ভুরভুর করে বের হচ্ছে। অথচ আপার গরু এখনও কেনাই হলো না।
হায় কপাল! সš§ান পাউডারের মত গুড়াগুড়া হতে আর বুঝি দেরি নেইÑআপা আর্তনাদ করে ওঠেন। দুলাভাই সুরসুর করে পালিয়ে বাঁচেন। কারণ দুলাভাইকে ‘কু’ ছাড়ে না। অবশেষে দুলাভাই যন্ত্রের শরণাপন্ন হলেন। ডিজিটাল সময় বলে কথা! ওয়েবসাইটের অন্তজালে ঘুরতে লাগলেন টইটই করে। ঘরে বসেই গরু খোঁজা শুরু করলেন। দেখে ফেললেন সারা দুনিয়ার গরু। অবশেষে অনেক সাইট ঘেটে নিউজিল্যান্ডের একটা গরু পছন্দ হয়ে গেল। আপাকেও দেখালেন। যদিও আপার চেহারায় কোনো পরিবর্তন ধরা পরল না। কিন্তু দুলাভাইয়ের উৎসাহ দেখে কে? নিউজিল্যান্ড থেকে গরু আসছে এ কি চাট্টিখানি কথা! উত্তেজনায় দুলাভাইয়ের নাসারন্ধ্র দিয়ে ঘোত ঘোত শব্দ বের হতে লাগল। আপা টিকতে না পেরে ‘মিনসের কাণ্ড দেখ’ বলে ঘর থেকেই বেড়িয়ে গেলেন।
দুলাভাই অনেক কসরত করে কার্সার বসিয়ে ‘বাই নাউ’ ক্লিক করলেন। মনিটরে ভেসে উঠল, হান্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যাডভান্স। গরুর ভিসা, বিমান ভাড়া, বিমানবন্দর চার্জ ক্রেতাকে বহন করতে হবে। ল্যারকার চে ল্যারকার গু ভারি! দুলাভাই ও পথ আর মারালেন না। কাঁধ ব্যথা হলো। মাউসে হাত রাখতে রাখতে আঙুল ব্যথা হলো। মনিটরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে পানি পর্যন্ত গড়াল কিন্তু আপার মন ভিজল না।
পরদিন দুলাভাই নিজেই ছুটলেন কোরবানীর হাটে। কিন্তু বিয়ের পাত্রী দেখার মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গরু দেখেও দুলাভাই স্থির করতে পারলেন না কোন গরু কিনলে আপার মানভঞ্জন হবে। দুলাভাইয়ের পকেটে ঘি আছে সুতরাং রাধাকে তিনি নাচিয়েই ছাড়বেন এই হলো প্রতিজ্ঞা। কিন্তু হাট ঘুরে দেখা গেল গরুর রঙ মিললে রুচিতে মেলে না, স্বাস্থ্যের তুলনায় শিং বড়Ñদেখেই ইচড়েপাকা গরু বলে মনে হয়। দেশি গরুর চেহারার এমন জীর্ণ দশা দেখে দুলাভাইয়ের জয়নুলের আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবির কথা মনে পড়ে গেল। এরা ফুসফুসে সবটুকু বাতাস টেনে নিয়ে যখন হাম্বা ডেকে ওঠে তখন সেখানে পৌরুষের তেজ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অথচ তাদের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা নাদুস-নুদুস ফার্মের গরুগুলো দেখলেই হিংসে হয়। দুলাভাইয়ের একটু লজ্জাও লাগে। সেম সাইজ বলে কথা! কিন্তু গরু না কিনে বাসায় ফিরলে যে সাইজ হতে হবে সেকথাও তাকে মাথায় রাখতে হয়।
সবুরে মেওয়া ফলে একথা আপা কিছুতেই বুঝতে চান না। দুলাভাইয়ের সবকিছুতেই যে ‘ওয়েট’ সেটা তো তিনি সাধে করেন না। কিন্তু আপাকে কে বুঝাবে সে কথা? দুলাভাই গোবর বাচিয়ে হাটে গরু খুঁজতে থাকেন। আহারে! দেশী গরুর প্রতি অবহেলা তাকে ব্যথিত করে। বাইরের গরুগুলো কেমন সুন্দর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পত্রিকাওয়ালারা ক্লিক ক্লিক শব্দে ছবি তুলছেন। নোটবুকে টুকে নিচ্ছেন দাম। যেন ‘মিস্টার কাউ প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়ে গেছে। একটু পরেই রেজাল্ট ঘোষণা হবে। সে কি উত্তেজনা!
অবশেষে অনেক ঘোরাঘুরির পর দুলাভাই গরু কিনে তার গলায় মালা পড়িয়ে সগর্বে বাসায় ফিরলেন। এ আনন্দে বাসার পুরো পরিবেশটাই পাল্টে গেল। শুধু পাল্টালো না আপার মুখশ্রী। একটা ছাগল সাইজের গরু উটের দামে কিনে এনে দুলাভাই যে রামছাগলের পরিচয় দিয়েছেন এ ব্যাপারে আপার কোনো সন্দেহ নেই। নাতিদীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিয়ে আপা ক্যালকুলেটর নিয়ে বসলেন কত কেজি মাংস হবে সেই হিসাব করতে। শাড়ি হলে ভিন্ন কথা ছিল কিন্তু কোরবানির হাট থেকে গরু কিনে সেটা তো আর ফেরত দেওয়া যায় না, তাই আপা বিষয়টি মেনে নিলেন। আপার কাছ থেকে ছাড়পত্র পাবার পর দুলাভাইয়ের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
দুলাভাই গরু গোসলের ব্যবস্থা করতে বললেন। এবং গোসল করাতে গিয়েই ঘটল এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা। কোরবানির গরু কিনতে গিয়ে দুলাভাই যে এভাবে প্রতারিত হবেন তা বোধহয় তিনি নিজেও ভাবেননি। হালাল সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে গরুকে গোসল করানোর সময় দেখা গেল গরুর লেজটা হালাল নয়। আপার নির্দেশে দুলাভাই যখন গরুর লেজের চুলে অর্গানিক শ্যাম্পু মাখিয়ে ঘষতে শুরু করলেন ঠিক তখনই টিকটিকির লেজের মত গরুর লেজ দুলাভাইকে বোকা বানিয়ে মাটিতে খসে পড়ল। সেইসঙ্গে খসে পড়ল দুলাভাইয়ের কোরবানির ঈদের আনন্দ। প্লাস্টিকের লেজটি হাতে নিয়ে দুলাভাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
খবরটা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। আপা দুলাভাইয়ের দিকে হাইস্পিডে তেড়ে এলেন ‘আমি এই গরুর চেহারা দেখেই বুঝেছিলাম এর মধ্যে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। বিয়ের আগে তোমার চেহারা দেখেও যে বুঝতে পারিনি তা নয়। কিন্তু বাবার কথা ফেলতে পারিনি।’
আপার কথা শুনে দুলাভাইয়ের দুঃখটা বেড়ে গেল। ইস! তিনিও যদি চেহারা দেখেই সবকিছু চিনতে পারতেন তাহলে কত ভালোই না হতো। কিন্তু এ কথা তো আর বলা যায় না। দুলাভাই মিনমিন করে শুধু বললেন, তুমি ফেললেও হতো না। কুদরতে লেখা ছিল।
আপা এবার তেলেবেগুণে জ্বলে উঠলেন। তারপর কিছু না বলে যে স্পিডে এসেছিলেন তার দ্বিগুণ স্পিডে চলে গেলেন। কারণ দুলাভাইয়ের ততক্ষণে ঘোত ঘোত শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এটা যে সবসময় তর্কের জন্য নয় ভয়েও মাঝেমধ্যে এমন হয় দুলাভাইয়ের আর সেকথা বলা হয়ে ওঠে না। ঘোত ঘোত শব্দটা বাড়তেই থাকে।