পোকা খাওয়া দাঁতের চিকিত্সা করাতে ডেন্টিস্টের চেম্বারে বাবা ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। ডাক্তার রোগের বিবরণ শুনতে শুনতে, নাকের উপর চশমা বসিয়ে, পেন্সিল টর্চ বের করে, ছেলেকে ‘দ’ আকৃতির চেয়ারে শুইয়ে দিতে দিতে কমল কণ্ঠে বললেন, বাবা দেখি একটু হা করতো।
শুনে ছেলে হা করা তো দুরের কথা রা পর্যন্ত করল না! ডাক্তার আবার বললেন। কোনো কাজ হলো না। এবার বাবা নিজেই ছেলের মুখ খোলাতে এগিয়ে এলেন।
: বাবা হা করো। ছি ছি ডাক্তার আঙ্কেল কী বলবে! হা করো।
ঠ্যাটা ছেলে তবু মুখ খোলে না। অনন্যোপায় হয়ে ডাক্তার অন্য পথ ধরলেন। ড্রয়ার থেকে চকলেটের প্যাকেট বের করে ছেলেটির হাতে গুজে দিলেন। ব্যস্! ছেলের মুখ এতক্ষণে হা হলো। সেই হা মুখ দেখে স্বয়ং ডাক্তারও হা হয়ে গেলেন। এইটুকুন ছেলে সেও কিনা ঘুষ খায়!
সুযোগ পেয়ে ঘুষ অনেকেই খান। তবে বিশেষ কিছু পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেই নামটা বেশী শোনা যায়। এই যেমন বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা।
: পাত্র কি করে?
: সরকারি চাকুরে।
: তা উপরি কত?
: এ আবার কেমন কথা! সবাই কী ঘুষ খায়?
: কেন খাবে না? আরে ভাই যা দিনকাল পড়ছে। সংসারটা তো চালাতে হবে। মাসের বেতনের টাকা তো মোবাইল বিল দিতেই চলে যায়। তারপর বাসা ভাড়া, ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, বউয়ের বায়না এসবও তো মেটাতে হবে নাকি?
এবার পাত্রপক্ষ ভাবতে বসেন। কিন্তু মুখ খোলেন না। কারণ ঘুষই একমাত্র খাদ্য যা মুখ না খুলেই খাওয়া যায়। আসল কথা হলো, নগদ প্রাপ্তিতে সবাই খুশী। পিয়ন থেকে শুরু করে অফিসের বড়কর্তা সবাই তত্পর এই ঘুষের কারণে। তুমি আমাকে ঘুষ দাও আমি তোমাকে ফাইল দেব। সহজ গাণিতিক সমাধান। ঘুষ না খেলে শুনেছি অনেক কর্মকর্তার হুশ থাকে না। ঘুষ পেলে তারা খুশ থাকেন। মানুষের দেখাদেখি না মানুষেরাও এখন ঘুষ খেতে শিখেছে। চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে যতোই ভেংচি কাটেন, বানর কিছুতেই সাড়া দিবে না। ও ব্যাটা ঠিক ‘লিভ মি এলোন’ ভাব নিয়ে বসে থাকবে। একটা কলা ছুড়ে দিন। এবার দেখুন বানরের বাদরামো। আবার টিউবওয়েলের কথাই ধরুন। সকাল থেকে চাপাচাপি করছেন, পানি বের হচ্ছে না। অথচ যন্¿পাতি সব ঠিক আছে। টিউবওয়েলের মধ্যে একটু পানি ঢালুন। এবার চাপতে থাকুন। দেখবেন জোয়ারের মত পানি বেড়িয়ে আসছে। এ আসলে ঘুষের ব্যারাম। মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মতো ঘুষ নিয়ে ঘুষাঘুষিও এখন নিত্যনৈমেত্তিক ব্যাপার। পার্থক্য শুধু নামে। কেউ একে বলেন উপহার, কেউ বলেন ডোনেশন আবার কেউ বলেন পার্সেন্টেজ। যে যেভাবে নেয় আরকি! যেমন ডাক্তাররা ঘুষ খান না। জ্ঞানী লোকের গোপন কর্ম, তারা খান পার্সেন্টেজ। পেসক্রিপশনের নিচে লেখাই থাকে, ‘টেস্টগুলো অমুক ল্যাব থেকে করাবেন’। ডাক্তারের কথামত করালে ভালো, না করালেই মহাভারত অশুদ্ধ। বুঝুন অবস্থাটা! সোনামনিকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাবেন সেখানে লাগবে ডোনেশন। ভুলেও ঘুষের কথা মুখে আনবেন না। সংকোচ না করে ডোনেশনটা দিয়ে দিন, দেখবেন খুশকিমুক্ত চুলের মতো অলক্লিয়ার। চাইলে যাদুমনির সার্টিফিকেটটাও অগ্রিম পেয়ে যেতে পারেন। শুধু কি তাই, এখন তো খেলার ফলাফলও নাকি অগ্রিম জানা যায়। ভদ্রলোকেরা এর নাম দিয়েছেন স্পট ফিক্সিং। ভাত খাওয়ার পর তিনবেলা ওষুধ খাওয়ার মতো ব্যাপার! খেলার শুরুতে বোলিং পেলে ওয়াউইড কিংবা নো বল করার জন্য, দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাট করার সময় সজোরে ব্যাট চালিয়ে বোল্ড হওয়ার জন্য, এমনকি ফিল্ডিং করার সময় অনেক চেষ্টা করে ক্যাচ মিস করার জন্যও নাকি ঘুষের ব্যবস্থা আছে। অর্থাত্ ক্যাচ মিস মানেই এখন আর ম্যাচ মিস নয়। ক্যাচ মিস মানে মানি মিসও বটে! আর মানি এভাবে কেই বা মিস করতে চায় বলুন? রাজ্য-রাজকন্যা পেলে ঘরজামাই হতেও আপত্তি নেই ছেলের। শুধু আপত্তি ওঠে পুলিশের বেলায়। একটা ট্রাকের অপেক্ষায় ল্যাম্প পোস্টের মত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাফিক পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের অপেক্ষায় বসে থাকে সরকারি কর্মকর্তা। বড় মামলার অপেক্ষায় উকিল, ট্রান্সমিটার ব্লাস্টের অপেক্ষায় বিদুত্ অফিসের কর্মী, গ্রাহকের ল্যান্ড ফোনের তার চুরি হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকে টিঅ্যান্ডটি। কারণ দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে মানুষ যত তাদের কাছে আসবেন, উপরি আয়ের সম্ভাবনা ততই বাড়বে। তবে এদের মধ্যেও যে ব্যাতিক্রম নেই তা নয়। গল্পের এই বড়বাবুর কথাই ধরুন। বেকার গ্র্যাজুয়েট ছেলের কাছে এক বড় কম্পানির ইন্টারভিউ লেটার এসেছে। ছেলেটি কায়দা করে আগে থেকেই সেই অফিসের বড়বাবুর সাথে ভাব জমিয়ে তাকে একদিন বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলেন। এ কথা, সে কথার পর ছেলেটির বাবা বড়বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী খাবেন বলুন? বড়বাবু যেন এতক্ষণ এ কথাটিই শুনতে চাইছিলেন। তিনি সুযোগটা লুফে নিলেন। বললেন-
: ঘুষ!