লোকমুখে শোনা, স্টুডেন্ট লাইফে টিউশনি না করলে নাকি স্টুডেন্ট লাইফের কোন মজাই থাকে না! এ কথার মর্যাদা রাখার জন্যই হোক অথবা হাত খরচের টাকা যোগানোর জন্যই হোক, জীবনে একাধিকবার টিউশনি করিয়েছি। প্রতিবারই কোন না কোন বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সম্প্রতি ঘটে গেল এরকম আরেকটি বিচিত্রময় ঘটনা।
এক ভাই ফোন দিয়ে বলল তার একটু উপকার করতে হবে। তার এক বান্ধুবীর ভাইকে প্রাইভেট পড়াতে হবে। এলাকার বড় ভাই মানুষ। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। তো গেলাম সে বাসায়।
বাসায় ঢুকার সাথে সাথে আঙ্কেল আন্টি মিলে আপ্যায়নের পাশাপাশি নানান ধরণের গল্প করতে লাগলেন। কিভাবে আঙ্কেল এ অবস্থায় উঠে এসেছেন তার সবিস্তার বর্ণনা শুনলাম। এক ঘন্টা ধরে লেকচার শোনার পর মাথাটা যখন প্রায় ঝিমঝিম করছে এবং নিজেকেই যখন ছাত্র বলে মনে হচ্ছিল তখন আঙ্কেল বললেন, অনেক তো কথা হল এবার পড়ানো শুরু কর! আমি মনে মনে বললাম, এ কি সর্বনাশ! আমার পড়ানোর সময়ে তো আপনিই আমাকে পড়ায়ে দিলেন। এখন আমার প্রস্থানের সময়। যা হোক, আসছি যখন কিছু না কিছু পড়ায়ে যাই।
তা যাকে পড়াব তার নাম আকিব। সেই আকিবই নাই! আঙ্কেল রুম থেকে প্রস্থানের পূর্বে হঠাত করেই আকিব আকিব করে চিল্লালেন। তার চিল্লানি আকিব না শুনলেও আমার সামনে রাখা জুসের গ্লাস শুনেছে বলে মনে হল। দেখি জুসের গ্লাস কাঁপছে!
যাওয়ার আগে আঙ্কেল আবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বাবা তুমি যেভাবে নিজে পড়ে এ পিলাচ পেয়েছ আমার ছেলেকেও ঠিক সেভাবে পড়াবা!
আমি এবার গম্ভীর স্বরে বললাম, এটা তো সম্ভব না আঙ্কেল!
আঙ্কেল বোধ করি কিঞ্চিত তব্দা খেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? ঘটনা কি?
আমি বললাম, আঙ্কেল আমার এসএসসি আর এইচএসসির রেসাল্টে তো আমার কোন অবদান নাই! আমার আম্মা আমাকে পড়িয়েছিল। আমার তো পড়াশোনার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নাই। উনার চিল্লাচিল্লির জন্যই আমি পাশ করেছি! আমার বদলে পরীক্ষা আম্মু দিলে শুধু এ পিলাচ না, অবশ্যই গোল্ডেন পেত। আঙ্কেল আস্তে করে বিড়বিড় করলেন, “লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা......”
মনে মনে ভাবছি এ বাসা থেকে এখনই প্রস্থান করা লাগবে। এখানে প্রাইভেট পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না। তো আন্টি আবার বলছেন, “বাবা, আমার ছোট মেয়েটা ক্লাস নাইনে উঠবে। তুমি একটু কষ্ট করে তোমার মাকে বল যেন উনি আমার মেয়েটাকে পড়া দেখিয়ে দেয়।” আমি আস্তে করে বললাম, “আন্টি, আম্মু তো প্রাইভেট পড়ায় না!” আন্টি আবার বলা শুরু করলেন, আমার একমাত্র ছোট মেয়ে। একটু কষ্ট করে বল বাবা! আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, আচ্ছা!
আঙ্কেল-আন্টি প্রস্থানের পর ভাবলাম আকিব আসবে। আসছে না। আসল এক তরুণী! প্রথম দর্শনে তাঁকে ভিট অথবা লাক্সের কোন মডেল বলে মনে হল! তিনি এসেই বললেন, আমি আকিবের বড় বোন। তারপর তোমার কি অবস্থা? আছ কেমন?
মনে মনে বললাম, আপনাদের বাসায় আসার আগ পর্যন্ত তো ভালই ছিলাম। এখন সব গুবলেট গুবলেট লাগছে! তবে মুখ দিয়ে বললাম, অবশ্যই! অবশ্যই! বেশ ভাল লাগছে!
উনি বললেন, কি অবশ্যই অবশ্যই করছ! আচ্ছা তুমি কি পড়াশোনা কর না? নিজে পড়াশোনা করলে পড়ানোর এত টাইম পাও কই?
আমি বললাম, জ্বি, না মানে ইয়ে, করি তো!
উনি বললেন, কি মানে মানে করছ! আমার তো মনে হয় তুমি নিজে পড়াশোনা কর না! তোমার সম্পর্কে তো আমি খোঁজ খবর নিয়েছি। তুমি তো টিউশনিই করাও!
আমি আস্তে করে হাসলাম আর মনে মনে বললাম, পড়াশোনার সাথে আমার রিলেশন ব্রেক-আপ হল প্রায় দু বছর হয়েছে!!
আবার উনি জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা তোমার এইম ইন লাইফ কি?
আমি মনে মনে বললাম, পড়াতে এসে এইম ইন লাইফ দিয়ে কি হবে! এর কি মাথায় সমস্যা নাকি! এতদিন জানতাম মানবকুলে আমারই মাথায় সমস্যা! আমি ছাড়াও যে এই টাইপ পাব্লিক আরও আছে জানতাম না! আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, আমার এইম ইন লাইফ হল হিমু হওয়া। আমি সে পথেই আগাচ্ছি! এই টার্মে দুই তিনটায় ফেল করলেই আমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে!
আপু গম্ভীর স্বরে বললেন, কি বল এগুলা! যা হোক, এগুলা তোমার বন্ধু-বান্ধবরা কি করছে? মানে পড়া-শুনা আর কি।
আমি মনে মনে বললাম, আজীব কাহিনী! আসলাম পড়াতে আর এখন কি না আমার বন্ধু-বান্ধবের খোঁজ খবর দেওয়া লাগছে! পুরাই আজীব।
আমি বললাম, আমার কোন বন্ধু-বান্ধব নাই!
উনি বললেন, এটা কি বল? মানুষের কোন বন্ধু নাই এটা কেমনে সম্ভব!
আমি বললাম, দেখুন বিখ্যাত লেখক মানিক বাবুর কোন বন্ধু ছিল না! লোকমুখে শোনা উনি বই উৎসর্গ করার মত কোন বন্ধুও পান নি! সেক্ষেত্রে আমার মত নাদান কোন ছাড়!
আপু গম্ভীর স্বরে বললেন, “আই সি, আই সি!”
এইবার আমি সোফার আসন ছেড়ে উঠলাম। এবার রুমে ঢুকল এক ছেলে! কানে ইয়ার ফোন। ভাবলাম, এ বোধ করি আমাকে গান বিষয়ক কোন উপদেশ দিবে! আমি আগ বাড়িয়েই বললাম, ভাইয়া আমিও সারাদিন গান শুনি! টুকটাক গিটারও বাজাই! তবে এফ কর্ডটা ঠিক মত ধরতে পারি না!
ছেলে গম্ভীর স্বরে বলল, আপনি তো আমাকে পড়াবেন ভাইয়া!
আমি আস্তে করে বললাম, ও আচ্ছা! কিন্তু ভাইয়া আমি তো তোমাকে পড়াতে পারব না! অন্য কেউ পড়াবে! আমি এখন যাচ্ছি!
বলেই আমি বাসা হতে এক দৌড়ে বিদায় নিলাম।