somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জলছবি - তৃতীয় পর্ব

৩০ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব

পরদিন সকালে বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ঠিকানা অনুযায়ী হাজির হলো শায়লা। ঠিকানায় পৌছে অবাক হলো সে। ভেবেছিল কোনো অফিসের ঠিকানা, এখন দেখছে বাসার ঠিকানা। কয়েকবার মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো ঠিকানা ঠিকই আছে। দুইতলা ডুপ্লেক্স বাসা। বাসার দারোয়ানকে ১১টার অ্যাপয়েনমেন্টের কথা বলতেই ভিতরে ঢুকতে দিল।ভিতরে গিয়ে একজনকে পাওয়া গেল যে ঘরের সব ঠিকঠাক করছে। তাকে অ্যাপয়েনমেন্টের কথা বলার পর বললো- স্যার এখনও ঘুমাচ্ছেন। আপনি বসেন, আমি ডেকে দিচ্ছি।
একরাশ বিরক্তি শায়লাকে চেপে বসলেও তা প্রকাশ করলো না। চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। রুমটার চারপাশে খেয়াল করলো। অনেক পেইন্টিং। একপাশে ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবি মোনালিসা ঝুলছে। তার নিচেই জীবনান্দের বনলতা সেন কবিতার পোস্টার। ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারিয়েছে দিশা।’ ভিঞ্চির মোনালিসা আর জীবনান্দের বনলতা এই বাসার দেয়ালের পেইন্টিং রাখার কারুকার্যে এক হয়ে গেছে ভেবে হাসি পেল শায়লার। কিছুক্ষণ পর খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে রুমে একজন ভদ্রলোক প্রবেশ করলো। বয়স ৩০-৩৫ হতে পারে। কিংবা এর বেশিও হতে পারে। তবে ভদ্রলোককে দেখে কমবয়সী মনে হচ্ছে।
স্যরি আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। আমি খুবই লজ্জিত। আসলে গত রাতে একটা বই পড়তে গিয়ে দেরি করে ঘুমিয়েছি। ভদ্রলোকের কথা শুনে মনে হচ্ছে তিনি এই দেরিতে খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত। শায়লাও কিছু বলছে না।
যাই হোক। আপনাকে আমিই ফোন করেছিলাম। আমার নাম জামিলুর রহমান। জামিল নামে পরিচিত। আমার লেখালেখির কাজে সহযোগিতার জন্য একজন পিএস দরকার। কম্পিউটারের ওয়ার্ডে টাইপ করতে পারেন তো? শায়লার ইতিবাচক জবাবে আরও একগাধা কথা বললো জামিল। একটা এক্সিডেন্টে হাতে ব্যথা পেয়েছি। ব্যান্ডেজ দেখেই নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন। হাত দিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছি, কিন্তু লেখালেখির কাজ করতে পারছি না। লেখালেখির কাজ না করলে আমার চলছে না। ডাক্তার বলেছে চার মাস হাত দিয়ে লেখার চাপ না নিতে। এরজন্যই একজন পিএস খুঁজে দেখা। তবে আগেই বলে নেই, চাকরির মেয়াদ মাত্র চার মাসের। আপনি ইফিসিয়েন্ট হলে স্যালারি বেশ ভালো দিতে পারবো বলেই মনে করি। এবার আপনি বলুন, কাজটা কি করতে চান?
আমার কর্মস্থল কি এই বাসা? শায়লা জানতে চাইলো।
হ্যা, এই বাসায়। অফিসের কাজ ছেড়েছি ছয়-সাত মাস হয়ে গেছে। এখন লেখালেখি করেই দিন চলে। রিচার্সের লেখার কাজই করি বেশি। কাজটা করবেন?
একা বাসায় কাজ করার উচিত অনুচিতঘটিত চিন্তাভাবনা পেয়ে বসলো শায়লাকে। ভেবে চিন্তে জানালো, একা বাসায় আমি কাজ করতে আগ্রহী না। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।
উত্তর শুনেই হা হা করে হেসে ফেললো জামিল। বলো- আমি জানতাম মেয়েদের ইনটিউশন পাওয়ার বেশ প্রবল। তারা কোনো পুরুষের সামনে দাড়িয়েই বুঝতে পারে পুরুষটি তার জন্য ক্ষতির কারণ হবে কি-না। যদি মনে হয় আমার এইখানে আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন কিংবা যদি ভাবেন আমার দ্বারা কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে তাহলে আপনার ভাবনাকে আমি শ্রদ্ধা জানাতে চাই। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন। আমার কার্ডটি রেখে দিন।

স্যালারির ব্যাপারে জেনে জামিলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল শায়লা। বাসায় পৌছে মা আর ছোটবোনের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলো। ছোট বোন লায়লার প্রশ্ন- ভদ্রলোককে দেখে তোর কেমন মনে হলো?
দেখেতো ভালোই মনে হলো। মনের ভিতর কি আছে কে জানে।
তুই যদি ভালো মনে করিস তাহলে জয়েন করে ফেল। স্যালারিতো অনেক ভালো। তোর আগের চাকরির তিনগুন স্যালারি পাচ্ছিস।

তিনদিন পর ফোন করলো শায়লা। জানালো সে কাজ করতে আগ্রহী।
প্রথম প্রথম একা বাড়িতে লেখালেখির কাজে বিরক্তি ধরে গেল শায়লার। তার স্যার তাকে ডিকটেশন দিতো, সেই অনুযায়ী লেখতে হতো তার। লেখা গুছিয়ে আবার পড়ে শোনাতে হতো। কিন্তু একটা পর্যায়ে কাজ উপভোগ করা শুরু করলো শায়লা। বেশির ভাগ সময়ই স্যারের লেখার মুড থাকে না। তখন নানান বিষয়ে কথা বলেন তিনি। শায়লার কাছে এগুলোকে গল্পের মতো মনে হয়। শায়লা তখন কাজে আগ্রহ পাওয়া শুরু করলো। মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যা করে বাড়ি ফিরে। এক পড়ন্ত বিকালে শায়লার সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে বললো, আপনি কি অনিরুদ্ধ রহমানের ‘বিরহ বসন্তে’ বইটা পড়েছেন?
পরিচিত বইয়ের নাম শুনে শায়লা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। জবাব আসলো, হ্যা, এই বইটা আমার অনেক প্রিয়।
তাই, ছোট কথায় মাথা নেড়ে মুচকি হাসলো জামিল। পরের প্রশ্ন আসলো- নাটক-সিরিয়াল কেমন দেখেন?
দেখি সময় পেলে। কেন স্যার?
‘অচেনা ভোর’ সিরিয়ালটা কী দেখেন?
জ্বী স্যার, নাটকটা এই সময়ের খুবই জনপ্রিয় নাটক। আমার ছোটবোন রেগুলার দেখে। তার সঙ্গে বসে দেখা হয়।
এই সিরিয়ালটি অনিরুদ্ধ রহমানের লেখা।এইটুকু বলেই কিছুক্ষণ চুপ থাকলো জামিল। তারপর কী একটা ভেবে যেন বললো- শায়লা আপনি কি অনিরুদ্ধ রহমানের সঙ্গে পরিচিত হতে চান?
জ্বী স্যার, পরিচিতি হতে পারলে খুশি হবো। শায়লা একটু বেশিই উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ফেললো।
জামিল মুচকি হেসে বললো, আমার কিন্তু মনে হয় না, আপনি অনিরুদ্ধ রহমানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হবেন। খুবই বিরক্তিকর ধরনের একজন লোক। তাছাড়া শুরুতে তার পিএস হতে আপনি রাজি হননি।
কথা পুরোটা শেষ হতেই শায়লা বলে ফেললো- তার মানে কী স্যার?
প্রমাণ দিচ্ছি,আপনার সামনেই অনিরুদ্ধ রহমান বসে আছে। অথচ তার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আপনি মোটেও খুশি হচ্ছেন না।
আমি স্যার কিছুই বুঝতে পারছি না।
শায়লা, আমিই অনিরুদ্ধ রহমান। এই ছদ্মনামে লেখালেখি করি। প্রকাশক ও নাট্যনির্মাতারাই কেবল এই নামে আমাকে চেনে। বলতে পারেন ইচ্ছা করেই আমি পরিচয় গোপন করে রেখেছি।
অনিরুদ্ধ রহমানের নাটক এর আগেও শায়লা দেখেছে।লেখা বইও পড়েছ অনেক। সেই মানুষটিকে সামনে পেয়ে রোমাঞ্চিত হয়ে গেল শায়লা। এমনিতেই স্যারের প্রতি দিন দিন মুগ্ধ হচ্ছিল সে, তার ওপর অনিরুদ্ধ রহমানের কথা শুনে আরও মুগ্ধ হয়ে গেল।বাড়ি ফিরে ছোটবোন লায়লাকে জামিলের কথা বললো, অনিরুদ্ধ রহমানের কথা বললো। লায়লা অনিরুদ্ধ রহমানের সঙ্গে দেখা করার বায়না ধরে বসলো। তারপর থেকে প্রায়শই ছোটবোনের কাছে স্যারের গল্প বলতো, কাজের প্রশংসা করতো। একদিন লায়লা দুষ্টুমি করে বলে ফেললো, আপু আমার মনে হয় তুই লেখক ভদ্রলোকের প্রেমে পড়ে গেছিস।
বেশি পেকে গেছিস তুই। কপট রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শায়লা।

যতোই দিন যাচ্ছিল শায়লা বুঝতে পারছিল সে জামিলের প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে।এখন বেশিরভাগ সময়ই গল্প করার সময় ইচ্ছে করে ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ টেনে আনে শায়লা। আলাপে আলোচনায় বুঝে নেয়, হয়তো জামিল অবিবাহিত। কিন্তু এতো বয়স হওয়ার পরও সে বিয়ে করলো না এই ভাবনার কূল খুঁজে পেল না। এক পড়ন্ত সন্ধ্যায় কথা কথায় শায়লা বললো-
স্যার আপনি অনেক বিষয় নিয়েই গল্প লেখেন। আমাদের পরিচয় নিয়ে গল্প লেখতে পারেন না?
এই গল্প জমবে না। জামিলের সহজ জবাব।
ধরা যাক, ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করতে আসা মেয়েটা আপনার প্রেমে পড়ে গেল? তাহলে কি গল্প জমবে না?
হা হা হা, গল্পের প্লট ভালোই সাঁজিয়েছেন। আপনিই গল্পটা লেখে ফেলুন।
কিন্তু স্যার যদি মেয়েটা বাস্তবেও লেখকটিকে ভালোবেসে ফেলে?
শায়লার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো জামিল। তারপর গলার স্বর নিচু নামিয়ে বললো- সে সম্ভব নয়।
কেন সম্ভব নয়? একটা মেয়ে কি ভালোবাসতে পারে না?
হুমম, অবশ্যই ভালোবাসতে পারে। কিন্তু মেয়েটি যাকে ভালোবেসেছে সে বিবাহিত।
মুহুর্তেই শায়লার মাথায় যেন বাঁজ পড়লো। কিন্তু তাহলে আপনার স্ত্রী কোথায়?
সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো জামিল।
তাতেও আমার সমস্যা নেই।
সমস্যার সমাধান এতো সহজ নয় শায়লা। শুধু জেনে রাখো এমনটা কখনোই সম্ভব নয়।

ভালোবাসার প্রস্তাবে প্রত্যাখিত হয়ে ১০ দিন বাকি থাকতেই জামিলের কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিল। জামিল ফোন করলে বলে দিয়েছে, কাজটি করতে আগ্রহী নয়। নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো জামিল। হঠাৎ ভালোবাসা ও ভালোবাসা থেকে প্রত্যাখান শায়লাকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিল। বাসা থেকে বের হওয়া কমিয়ে দিল।শায়লার এমন অবস্থা দেখে তার মা ও ছোটবোন খুবই চিন্তিত হলো পড়লো। বড়বোনের কাছে সব শুনে জামিলের ওপর চরম বিরক্ত হয় লায়লা। তার কাছে মনে হতে থাকে জামিল ইচ্ছা করেই তার বোনকে নিজের প্রতি দূর্বল করে তুলছে। এখন তাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে। বড়বোনের কষ্ট দেখে জামিলের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

প্রথম লায়লাকে চিনতে পারে না জামিল। পরিচয় জিজ্ঞেস করতে লায়লা বলে, আমি শায়লার ছোটবোন।
ওহ, শায়লা কেমন আছে?
তা জেনে আপনি কি করবেন? আমি আপনাকে স্পষ্ট করে একটা কথা জানিয়ে দিতে এসেছি, আমার বোনের এই অবস্থার জন্য আপনি দায়ী।
আগে ঘটনা শুনবে না? তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, তাই না?
আপনি আর কি বলবেন তা আমার জানা আছে। আপনাদের মতো একটু জনপ্রিয় মানুষরা নিজেদের প্রয়োজনে হাজারটা বাহানা তৈরি করে নিতো পারে।
ঠিক আছে আমি চা করে নিয়ে আসি। তারপর তোমাকে ঘটনা খুলে বলবো।
লায়লাকে ড্রয়িং রুমে বসে নিজেই চা বানাতে গেল। দুই কাপ চা নিয়ে এসে লায়লার সামনে বসলো। চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে জানালো- চিনি বেশি দরকার পড়লে আলাদা নিতে পারো। আমি চিনি কম খাই। বেশিরভাগ সময়ই কম চিনির চা বানাই। এইসব আলোচনায় লায়লা বিরক্ত হচ্ছে বুঝতে পেরে মূল প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করলো জামিল।
শোনো লায়লা, আমি একজন বিবাহিত পুরুষ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই যার সঙ্গে প্রেম তাকে বিয়ে করি। তিন বছরের প্রেমের পর আমাদের বিয়ে। রেশমা আমার চেয়ে দুই বছরের জুনিয়র ছিল। ভুল বোঝাবুঝির পর রেশমা এখন তার বাবা-মার বাড়িতে থাকে। কিন্তু আমাদের এখনও ডিভোর্স হয়নি। রেশমার বাবা মার সাথে এখনও আমার নিয়মিত কথা হয়। বাবার অফিসে গিয়ে মাঝেমধ্যেই আড্ডা দিয়ে আছি। রেশমার মাও আমার বাসায় মাঝেমধ্যে আসে। বিয়ের পর থেকে রেশমার বাবা মা আমাকে তাদের নিজের সন্তানের মতোই মনে করে। আমিও নিজের বাবা-মার মতোই শ্রদ্ধা করি তাদের। শৈশবের বাবা-মাকে হারিয়ে আমি খালার কাছে বড় হই। বাবা-মার আদর ভালোবাসার অভাব সবসময়ই টের পেতাম। রেশমার বাবা-মার সঙ্গে পরিচয় হয়ে সেই অভাববোধ পূরণ হয়। রেশমার সঙ্গে দূরত্ব হলে কী হবে...তার বাবা মার সঙ্গে দূরত্ব হয়নি।
এখনও রেশমাকেই ভালোবাসি। মাঝেমধ্যে ওর পুরনো ছবিগুলো দেখি, পুরনো চিঠি পড়ি। একই ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে পড়ি। চাইলে প্রায় প্রতিদিনই দেখা করা সম্ভব ছিল। তারপরেও সে আমাকে চিঠি লেখতো। সেই চিঠি আবার নিজের হাতে পৌছে দিতো। বেশিরভাগ চিঠিই ছিল সংসার জীবনকে কেন্দ্র করে। সংসার কেমন হবে, দুজনে কেমন করো থাকবো এইসব বিষয়াবলী।
একসময় সংসার হলো। আমরা পাশাপাশি থাকা শুরু করলাম। মাঝরাতে আকাশ-মাটি আলো করা চাঁদ উঠলে রেশমাকে আমি ঘুম ভাঙ্গিয়ে উঠিয়ে ছাদে নিয়ে যাই। কোন কোন আকুল করা জ্যোসনা রাতে রেশমা কিন্নর কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনায়। আজ জ্যোসনা রাতে সবাই গেছে বনে...। বর্ষামুখর অনেক দুপুরে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজি। আক্ষরিক অর্থেই প্রথম একবছর ছিল আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।
এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর নানা বিষয়ে আমাদের মধ্যে দ্বিমত তৈরি হতে লাগলো। শুরুর দিকে যেসব বিষয় আমিও এড়িয়ে যেতাম সেইসব বিষয়েই রেশমার ভুল ধরা শুরু করলাম আমি। এর উল্টোটাও ঘটলো। রেশমাও আমার নানা বিষয়ে ভুল ধরা শুরু করলো।
শুরুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এক বছর যাওয়ার পর আমরা সন্তান নেওয়ার চিন্তা করবো। কিন্তু সন্তান নেওয়া নিয়েই দ্বিমত তৈরি হলো আমাদের। সন্তান নিয়ে আগ্রহ রেশমারই বেশি ছিল। তার লেখা চিঠিগুলোতেও সন্তানের প্রসঙ্গ থাকতো মাঝেমধ্যে। মেয়ে সন্তান হলে কী নাম রাখবো, আর ছেলে সন্তান হলে কী নাম রাখবো তাও ঠিক করা ছিল আমাদের। আমি বলতাম, আমাদের প্রথম সন্তান হবে মেয়ে। রেশমা বলতো, মোটেও না, আমাদের প্রথম সন্তান হবে ছেলে। এ নিয়ে আমাদের বেশ তর্ক হতো। অথচ বিয়ের এক বছর পর যখন সন্তান নেওয়ার সময় আসলো তখন বেকে বসলো রেশমা। সে এখনই সন্তান নিতে আগ্রহী না। কিন্তু যুক্তিটা আমার পছন্দ হলো না। এই মুহুর্তে সন্তান নিলে তার ক্যারিয়ারের সমস্যা হবে। আমার রাগ হলো খুব। সন্তানের চেয়ে ক্যারিয়ার তার জন্য বড় হয়ে গেল ভেবে কিছুদিন কথা বলা বন্ধ রাখলাম। রেশমার ক্যারিয়ার বিষয়ক চিন্তাভাবার শেকড় গজিয়েছিল আমাদের মধ্যকার বিতর্কের জন্যই। নানা কারনে আমাদের মধ্যে ইগো সমস্যার তৈরি হয়েছিল সেই সময়ে। রেশমা ভাবা শুরু করলো, সেও আমার মতো ভালো একটা বিষয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স করেছে। তাহলে আমি নিজের বাড়ি, গাড়ি করে ফেলতে পারলে সে কেন পারবে না। কেবল মেয়ে বলেই সে এসব করতে পারছে না এমন ভাবনাই পেয়ে বসলো তাকে। আমি ও আমার অন্যান্য সম্পত্তি তখন রেশমার কাছে প্রতিপক্ষ। বারবার বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমার সকল সম্পত্তির পেছনে রেশমার অবদান রয়েছে, তবুও সে বুঝতে রাজি না। এই সংঘাত আমরা কিছুতেই কাটাতে পারলাম না। দিনে দিনে অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নেওয়া শুরু করলো। মাঝেমধ্যে এমনও দিন যেতো যখন আমরা কথাই বলতাম না। আমি অফিসে চলে যেতাম তাকে কিছু না বলেই, আবার অফিস থেকে ফিরেও কিছু বলতাম না। এক রাতে রেশমা গভীর রাতে আমাকে ঘুম থেকে জেগে তুললো। আমি ঘুম থেকে উঠে বললাম, কি ব্যাপার? ঘুম আসছে না?
আমাকে অবাক করে দিয়ে রেশমা জানালো, সে আর আমার সঙ্গে এই বাড়িতে থাকতে আগ্রহী না।
তাহলে, তুমি ডিভোর্স চাচ্ছো? হতাশ হয়ে বললাম।
ডিভোর্স চাইবো কেন? কিছুটা আশ্চর্য্য হয়ে বললো রেশমা।
তাহলে?
আমি বলেছি আমি তোমার সঙ্গে এই বাড়িতে আর থাকবো না। কিন্তু আমি মরে করি না যে আমাদের ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে। কিছু বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ রয়েছে। দিনদিন এই মতবিরোধ বেড়েই চলেছে। চূড়ান্ত অবস্থায় যাওয়ার আগেই আমি এই বাড়ি ছাড়তে চাই।
কিন্তু তুমি কেন এই বাড়ি ছাড়বে। তুমি বেশ ভালো করেই জানো এই বাড়ি তৈরির পেছনে তোমারও অবদান আছে। আমার প্রতিটি সাফল্যেই তোমার অবদান আছে। মরিয়া হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু এতোসব বুঝানোতে কোনো লাভ হলো না। পরদিন সকালেই রেশমা তাদের বাড়িতে চলে যায়।
রেশমাকে আমি এখনও ভালোবাসি। সেই ভালোবাসার মাঝে আরেকজনের ভালোবাসাকে আমি কিভাবে স্থান দিবো বলো?
জামিলের দীর্ঘ আলোচনা মনোযোগ দিয়ে শুনলো লায়লা। কিন্তু পাল্টা কোনো কথা বলতে পারলো না। বেশ ভালো করেই বুঝে গেল, জামিল ভাই তার স্ত্রীর প্রতি এখনও দূর্বল। এ অবস্থায় দ্বিতীয় সম্পর্ক দাড়াতে পারে না। শুভকামনা জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো লায়লা।

(চলবে)
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×