- সুন্দরপুর যাবেন?
- হ যামু, চলেন।
দরদাম না করে রিক্সায় উঠে পড়ে রাকিব। কারন এত রাতে একটি নির্জন বাজারে রিক্সা পেয়েছে তাও বেশি।
রাত প্রায় ১২টা। শরতের রাত। পূর্নচন্দ্র আকাশে। নিরব রাতে নিজেকে এতক্ষন অশরীরী মনে হচ্ছিল রাকিবের। রিক্সাওয়ালা কে দেখে বুকে বল পেল সে।
রাকিব রিক্সাটি পেল ভাগ্যক্রমে। সারা বাজার ঘুরেও রিক্সা বা টেম্পু না পেয়ে প্রায় হতাশই হয়েছিল সে। বাজারের এককোনায় রিক্সাটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে। রিক্সাওয়ালা ঘুমুচ্ছিল। চাদর গায়ে দিয়ে। বেশি ঘুম পাওয়ার কারনে হয়ত বাড়ি যেতে ভুলে গিয়েছিল রিক্সাওয়ালা।
- সুন্দরপুর কোন বাড়ি?, রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করে।
- রফিক ডিলারের বাড়ি।
রফিক ডিলার রাকিবের বাবা। এখন নাকি বেশ অসুস্থ্য। বিকালে মোবাইলে কল দিয়ে রাকিবের মা রাকিবকে জানিয়েছিল। বাবার অসুখের খবর শুনে বিকালেই ঢাকা হতে রওনা দেয় রাকিব। রাত ৮টার ভিতরই পৌছিয়ে যাবার কথা ছিল রাকিবের।
কিন্ত পরদিন বিরোধি দলের ডাকা হরতালের কারনে রাস্তায় জ্যামে পড়ে রাকিবের গাড়ি। রাকিবেদের নিকটস্থ বাজারে নামিয়ে দেয় রাকিবকে।
রিক্সাওয়ালা প্রায় নিরবে রিক্সা চালাতে থাকে। শরীরের গঠন দেখে বুঝা যায় প্রায় বৃদ্ধ। এ এলাকার রিক্সাওয়ালা সবই প্রায় রাকিবের চেনা। কিন্ত এ রিক্সাওয়ালা কে ঠিক সেভাবে চিনতে পারে নি রাকিব।
হয়ত পাশের জেলা থেকে এসেছে। দু-এক মাস আগে নদী ভাঙ্গনে হাজারখানেক মানুষ গৃহ হারা হয়েছিল। অধিকাংশই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কামলা খাটে , রিক্সা চালায় , দিনমজুরি করে।
কয়টা বাজে? সময় দেখার জন্য রাকিব পকেটে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মোবাইল বন্ধ। তার মনে পরলো, গান শুনতে শুনতে চার্জ শেষ মোবাইল বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাস থেকে নামার আধা ঘন্টা আগে। এখন তার লাইটারের মিনি বাল্ব টাই ভরসা।
- মামা, কতক্ষন লাগবে যেতে?
একঘেয়েমি কাটাতে প্রশ্ন করে রাকিব। বেশিক্ষন লাগার কথাও না। ২-৩ কিলোমিটারের পথ। তাছাড়া পথ তারার পরিচিত।
- প্রায় চইলা আইছি।
- কতদিন ধরে রিক্সা চালান?
- ২ মাস হইব।
রিক্সাওয়ালার ভাবসাবে কথা বলার মুড নাই দেখে রাকিব আর কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলো না।
********************************************************************
উফ! এই শরতের বাতাসের মধ্যেও রিক্সা চালিয়ে ঘামিয়ে গেল রিক্সাওয়ালা করিম। বুঝতে পারলো না কেন ঘামাচ্ছে। ছেলেটিকে দেখে যতটা ওজন হবে ধারনে করেছিল, কিন্ত রিক্সা চালানোর সময় সে কোন ভার অনুভব করলো না।
হয়ত বাতাসের অনুকূলে থাকার কারনে। কিন্ত ঘামাবে কেন সে?
করিম কি ভয় পাচ্ছে?
এককালের পালোয়ান করিম কি ভয় পায় কিছুকে? এখন হয়ত সে বন্যায় তার বাড়িঘর , পরিবার হারিয়ে পথে। কিন্ত কখনো কি সে কারো কাছে মাথা নত করেছিল?
নানা চিন্তা ভাবনা করতে করতে করিম পৌছে গেল রফিক ডিলারের বাড়ি। এলাকার বিখ্যাত লোক। সবাই একনামে চিনে।
বাড়ির গেটে রিক্সা থামিয়ে পেছন ফিরে তাকায় করিম।
আরে! একি! রিক্সায় কেউ নেই। একদম খালি। এমনকি ছেলেটির হাতে থাকা ব্যাগ টাও নেই।
রিক্সা থেকে নেমে গেলে টের পাওয়া যেত। রিক্সা হালকা হয়ে যেত। আশে পাশে কাউকে দেখতে পেল না করিম।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলতে বলতে জোরে প্যাডেল চাপে করিম। এ মাঝরাতে খুপড়িতে না গিয়ে রিক্সায় ঘুমানো ভুলই হয়েছে করিমের।
********************************************************************
জায়নামাজে বসে আছেন রফিক সাহেবের স্ত্রী, রাকিবের মা সাহেলা বেগম। জিকির করছেন তিনি। রফিক সাহেব অসুস্থ্য। ঘুমুনোর জো নেই।
হঠাত, দরজায় আঘাত।
- মা মা, দরজা খুলো জলদি।
আরে! এ যে আমাদের রাকিব। জায়নামাজ থেকে উঠে দৌড় দিয়ে যান সাহেলা।
দরজা খুলেন।
রাকিব। কিন্ত একি চেহারা তার।
- এই, কি হয়েছে তোর? পথে কোন সমস্যা হয় নি তো? এতদূর আসলি কিভাবে? চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন?
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন সাহেলা বেগম।
- রিক্সায় আসছিলাম। বাড়ির সামনে নেমে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি
রিক্সা এবং রিক্সাওয়ালা কেউ নেই।
এ কথা বলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রাকিব।