ব্লগে প্রচুর ফ্লাশব্যাক লেখা চোখে পড়ে। কারণটা সহজে অনুমেয়। একটা সময় এসে মানুষ নিজের কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে। আসলে হয়ত সবসময়ই করে। একটা তরল কারণও আছে অবশ্য। ভেবেচিন্তে চিত্রকল্প সাজিয়ে, কাহিনীর সূতো জুড়ে দিয়ে একটা ঝকঝকে গল্প দাঁড়া করানো যথেষ্ট আয়াসসাধ্য। রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি নিয়ে লেখাটা আরো ঝক্কি, বিশ্লেষণের ভুলটা সব প্রচেষ্টাকে নিরর্থক করে দিতে পারে। তারচে আয়নায় নিজেকে ভাজিয়ে নেয়া বেশ শর্টকাট। আমি মন দিয়ে সে ভাজানো লেখাগুলো পড়ি। আত্মবিশ্লেষণের ব্যক্তিক ধাঁচগুলো একটা মোহনায় এসে মিলে যায়। আমরা তাড়িত হই অতীতের ভুলে, ভুল স্বপ্নে অথবা স্বপ্ন দেখানোয়। হতাশার ঢেকুর ওঠে দায়বোধ এড়ানোর বদহজমের কারণে। ফিরতি ট্রেনে মনের বাড়ি ফেরার একেকটা অভিজ্ঞতা একেকটা উতকৃষ্ট গল্প আমার কাছে। আমি তেমন গল্প বলিয়ে নই। কিন্তু ট্রেনের কু ঝিকঝিক শোনানোর লোভ আমারও হয়।
বলছিলাম ভন্ডামি, প্রতারণা নিয়ে। ছায়ার সাথে। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে কেউ করেনি? আছেননি এমন কোন ভাইবোন? উপায় হোসেন গোলাম নেই। ভন্ডরা বেঁচেবর্তে থাকে ঠিকই, হিলের পেরেক হয়ে আত্মশ্লাঘাটা খুঁচিয়ে যায়। আমার এক নিদারুণ ভন্ডামি জীবনের সপ্ত কি অষ্ট বর্ষে। খেলার সাথীকে আচ্ছাসে কিলিয়ে রানারের মত পায়ের মল বাজিয়ে বাজিয়ে ছুটে এসেছিলাম ঘরে। এসেই অপরাধ ঢাকতে ওয়াক্ত ছাড়া নামাজে সোজা সেজদায়। উদ্দেশ্য হল আব্বু-আম্মাকে একটা ভালমেয়ের ইমেজ দেয়া, একটু আগের কিলিং অ্যাকশনের রিঅ্যাকশনকে লঘু করা। ১২/১৩ বছর বয়সে বাসায় তদপেক্ষা বড় কোন ছেলে আসলে খাঁচার পাখি দাপাদাপি করত। একটু চোখাচোখি হওয়ার লোভে নাস্তা বানিয়ে বসার ঘরে যেতে কালক্ষেপণ হতনা। ক্লাসে ভাব ধরে থাকতাম, পড়া ছাড়া দ্বিতীয় প্রেম নেই, অথচ ফার্স্টবয় অন্য কোন মেয়ের সাথে কথা বললে শালীটাকে ছিঁড়ে খেতে ইচ্ছা হত। একটা গোলাপের পাপড়িকে ডয়েরীর ভেতরে শুটকি হতে দিয়েছি অনেকদিনের জন্য, আম্মার চোখ এড়িয়ে অনেক যত্নে। স্রেফ ভন্ডামি, নাটক সিনেমার নায়িকার ভাবটুকুকে পুঁজি করে। ছাদে কাপড় আনার ছলে মনচোখের রাডার স্থির হত সামনের বাসার জানালায়, যে রুমে কৈশোরোত্তীর্ণ কিছু ঝলমলে সুদর্শন ছিল।
মা-বাপের সাথে ভন্ডামি তো এক ইতিহাস, কারণে অকারণে। এটাই যেন বিনোদন, ঠকানোর গোল্ডকাপ জেতা। ভাব ধরি গরীবের কষ্ট বুঝি। হাঃ, স্রেফ ইতরামি। কাজের মেয়েটা যখন যা বলে এনে দিই, কিন্তু যেদিনই ঠিক আমার মত জুতা চাইল, কড়া গলায় বললাম - ওটা তোমার জন্য্ না। আমি প্রভু, তুমি নত থাক। সমতা চেয়োনা। ঈদের দিনে ওকে কোন কাজ করতে দেইনা কিন্তু এক ভীষণ শীতের রাতে ওকে মেঝেতে শুতে না দিয়ে এক বিছানায় শোয়ার আইডিয়া জঘন্য মনে হয়। বুয়ার অসুখ হলে রান্নাঘরে খুন্তি নাড়তে যাই, অথচ আম্মা একমাথা জ্বর নিয়ে উনুন সামলায় যখন, ফিরেও চাইনা। আমি যে মানবতাবাদী।
বিরাট গবেষকের ভংগিমায় আমার সদর্প চলায় ল্যাবের ইট-কাঠ ধন্য হয়। আমি প্রাণান্তকর চেষ্টায় সবাইকে বোঝাতে সমর্থ হই যে, পড়াটা আমার কাছে জগতের শ্রেষ্ঠ বিনোদন। এরচে বড় কোন মিথ্যা রচিত হয়নি আমি জানি। জ্ঞানরাজ্যে নুড়ি জমাতে আমার মত পাথরশ্রমিকের প্রয়াস নেহাত গিভ এণ্ড টেকের। ভালো আর্থিক নিরাপত্তা দরকার, নিষ্ঠা বেচব। আরেকজন বড় টোপ দিবে, তাকেও বেচব। বেচাটাই সার, চাঙ্গে উঠুক শালার গবেষণা।
প্রিয়জনের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখার লোভে নিজের স্বপন শোনাই। দেশে গেলে নিজের বিনোদন থেকে প্রতি মাসে একটা অঙ্ক যাবে পথশিশুদের জন্য। ঈদে দামি কিছু কিনবনা, পিঙ্ক গোল্ড অথবা কিউবিক যিরকোনিয়ার হার চাইনা আমার। বছরে একটা দিন গরীবের কালো হাড় জিরজিরে কিছু পোলাপাইন খুঁজে একসাথে ঘুরতে যাব। মাথায় হাত বুলিয়ে দিব, দামি আইস্ক্রিম খাবে ওরা। আমি রঙপেন্সিল আর একটা ছবির বই দিয়ে দশটা মন কিনে নেব। হেন করেংগা, তেন করেংগা। আসলে শালার লোভের পেটেই পুজোর অর্ঘ্য দান করেংগা। আজ পর্যন্ত একটা মানুষের জন্যও কিছু করতে পারলাম্না। কব্বরে যাক শুভবোধ, জয়ী হবেই ভন্ডামি আর লালসাময় বীরেরা। দিন এখন আমাদেরই।
লেখাটা লিখতে লিখতে ভাবছি কতগুলান প্লাস পড়বে। কী লিখলাম সেটা বড় নয়, হিসাবটাই বড়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০০৮ দুপুর ২:২১